ইমাম গাজ্জালি

ইমাম গাজ্জালি তাবলিগকে বলেছেন দ্বীনের প্রাণ

মঈন চিশতী তাবলিগ দ্বীনের প্রাণ বা জীবন। ইমাম গাজ্জালি তাবলিগকে দ্বীনের প্রাণ মনে করেছিলেন বলেই তার একটি কিতাবের নাম দিয়েছিলেন এহিয়ায়ে উলুমুদ্দীন। সোনারগাঁ পরগণার হাদী মুবাল্লিগে ইসলাম মাওলানা লালপুরীর ভাষায় মানব জীবনে চারটি কাজ ফরজ ১. নবুয়তের কাজ করা। ২. খোদার হুকুমের অধীনে থাকা। ৩. যাবতীয় কাজ এবাদতে পরিণত করা। ৪. জান-মাল আল্লাহর রাস্তায় বিলাইয়া দেয়া।

তাবলিগ জামাতে চিল্লায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ কাজগুলোর বাস্তব নমুনার নকশা অর্জিত হয়। ফলে আমাদের আমলী জিন্দেগী সহজ হয়ে যায়। এ জন্য তিনি তার ভক্তবৃন্দসহ বিশ্ব ইজতেমায় শরিক হয়ে তাদের চিল্লায় উদ্বুদ্ধ করতেন। তাবলিগ নতুন কোনো বিষয় নয়। আদি পিতা আদম আ. থেকে এর সূচনা হয়েছে ইমামুল মুরসালিন নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স.)-এর বিদায় হজের ভাষণের মধ্য দিয়ে উম্মতের ওপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত তাবলিগের পদ্ধতি ভাষা পরিভাষা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেও এর সার্বজনীনতা ও গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়ছে। এখানে প্রশ্ন উঠানো বোকামি হবে। তাবলিগ ইজতেমা মুসলমানদের, এর সাফল্য কামনা করে বিধর্মী ইহুদি নাসারা ব্যানার-ফেস্টুন টানাচ্ছে, না জানি এর পিছনে কী আছে? তারা টানাচ্ছে তাদের ব্যবসার স্বার্থে। খোঁজ নিয়ে দেখুন তারা তা খুশি হয়ে করছে না। এই সময়ে উম্মতের স্কলার চিন্তাশীলদের উচিত হবে এই বিতর্কে কান না দেয়া।

এ বিষয়ে মাওলানা লালপুরী শাহ বলতেন, হাত আলগাইলে সকলের বগলের গন্ধই পাইবে। সেটা না দেখে মানুষের সেইটা না দেইখা মানুষের সৎগুণসমূহ দেখ মন্দগুলো লুকাইয়া রাখ, আল্লাহও তোমার মন্দ লুকাইয়া রাখিবেন। আর এটাই সিরাতুল মুস্তাকিম বা নাজাতের সহজ পথ। ইহদিনাসিসরাতাল মুস্তাকিম বলে আমরা প্রতি নামাজে যে প্রার্থনা করে থাকি। এ প্রসঙ্গে সাহাবিরা নবী (স.)-এর কাছে জানতে চান, ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম সিরাতে মুস্তাকিম কী? তিনি বলেন, মা আনা ওয়া আলাইহে আসহাবি যার ওপর আমি এবং আমার সাহাবিরা আছে। খিলাফতে রাশেদার যুগে কোনো কোনো বিষয়ে সাহাবিদের মতানৈক্য হলেও উম্মতের বৃহৎ স্বার্থে সে মতকে বাদ দিয়েছেন।

সবাইকে দ্বীন প্রচারের কাজে সহযোগিতা ও একরাম করা। মূলত এগুলোই তাবলিগের সার কথা। নিজেদের মতকে বড়দের হুকুমে কোরবানি করতে না পারাও খাহেশাতে নফসানি। আর খাহেশাতে নফসানি থাকলে ইনসানে কামেল হওয়া যায় না। ইন্নান নাফসা লাআম্মারাতা বিসসুইন, নফস অবশ্যই খারাপ কাজের আদেশ দিতে থাকে ইল্লা মা রাহিমা রাব্বি আমার রব যাকে দয়া করে নিরাপদে রেখেছেন তাদের ছাড়া।

কালামে পাকে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর ভাষাটি আল্লাহ এভাবেই উল্লেখ করেছেন, অমা উবাররিউ নাফসি আমি নফসের বড়াই করি না। একজন নবী হয়েও নফসকে যিনি বিশ্বাস করতে পারেন না, আমরা সাধারণ মানুষ হয়ে কী করে পারি। হ্যাঁ আল্লাহর করুণা বা দয়া হলে তা সম্ভব। এই দয়া বা করুণা পাওয়ার আমাদের দয়াপ্রাপ্তদের সঙ্গে থাকতে হবে। মাওলানা রুমীর ভাষায়, এক জমানা সোহবতে বা আউলিয়া বেহতরান্দ সদ সালা ইতাআত বে রিয়া।

অলি আউলিয়া বা আল্লাহর দয়াপ্রাপ্ত বান্দাদের সঙ্গে কিছু সময় অতিবাহিত করা শত বছর বেরিয়া ইবাদত সমতুল্য। অলি আউলিয়া কারা? আল-কোরআনের ভাষায় ইন্না আউলিয়াল্লাহ ইল্লাল মুত্তাকুন, পরহেজগার মুত্তাকিরাই আল্লাহর অলি বা করুণাপ্রাপ্ত বান্দা। কালামে পাকের অন্যত্র একজনকে বান্দা হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। যেমন- ফা অজাদাআ আব্দাম মিন আব্দিনা আতাইনাহুর রাহমাহ, তারা দুজনে খুঁজে পেল আমার প্রিয় বান্দাদের মধ্য হতে একজনকে যাকে আমি আমার করুণায় অভীষিক্ত করেছি।
সহজ ভাষায় যারা দ্বীনের চিন্তায় নিমগ্ন। জিকিরে তাজকিয়ায় লিপ্ত। দ্বীনের দাওয়াতের পথে পথে ফিরে তারাই দয়া বা করুণাপ্রাপ্ত। হাদিসে কুদসির ভাষায় নবী (স.) বলেন, লা ইয়াজমাউ আলা আবদি গুবারু ফি সাবিলিল্লাহ ওয়া দুখানু জাহান্নাম খোদার পথে চলা ধুলায় ধূসরিত বান্দার পায়ের ধূলি আর জাহান্নামের ধোঁয়া একত্রিত হবে না, অর্থাৎ ওই ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না। খোদার পথে চলার বরকতই ভিন্ন। এখানে দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানের কামিয়াবি আছে। অনেকে প্রশ্ন উঠাতে পারেন, আখেরাতের কামিয়াবি বুঝে আসে। দুনিয়ার কামিয়াবি কীভাবে? এই পথে চলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ আপনাকে দিয়ে উপকৃত হবেন, আর তাদের মাধ্যমে আপনার দুনিয়ার প্রয়োজন মিটবে।

এ প্রসঙ্গে কবি শেখ সাদীর জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। মূলত তিনি কবি পরিব্রাজক এবং সুফি সাধক ছিলেন। দেশ দেশান্তরে ঘুরে কবিতার মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত ন্যায় ও সত্যের বাণী প্রচার করতেন। ঘটনাক্রমে এক বিরাণ জনপদে রাত হয়ে যায়। রাত যাপনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এক ঝুপরি ঘরের পাশে গিয়ে হাঁক ছাড়েন বাড়িতে কেউ আছেন? আমি মুসাফির রাতে থাকার একটু আশ্রয় চাই। বাড়িওয়ালার স্ত্রী আসন্ন সন্তান সম্ভবা প্রসব বেদনায় কাতর। একটি মাত্র ঘর অজানা লোক কী করে জায়গা দেয় লজ্জা-শরমের ব্যাপার। বারবার হাঁক মারার ফলে লোকটি ক্ষেপে যান। কিন্তু শেখ সাদী ধৈর্য ধরে থাকেন ব্যবস্থা একটা হবেই। ইন্নাল্লাহা মাআসসোয়াবেরীন আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন। রাগের প্রতিবাদ রাগ দিয়ে নয়, ধৈর্য এবং সহনশীলতা দিয়ে। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। কালামে পাকে আছে, ইদফাআ বিল্লাতি হিয়া আহসান, তাদের খারাবির বদলে তোমরা উত্তম ব্যবহার করো। অনেকে কোরআন হাদিসের যুদ্ধকালীন হুকুম-আহকামকে এর হাকিকত না বুঝে শান্তিকালীন প্রয়োগ করে মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে সমাজ ও দেশের শান্তি-স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে দাওয়াতি পরিবেশ ব্যাহত করছেন।

এবার বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচি এবং ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। ঠিক এই সময় কিশোরগঞ্জের ভৈরব এলাকায় মিলাদুন্নবীর মিছিলে তাবলিগ কর্মীদের হামলার খবরটি শুনে আহত হয়েছি। আমাদের বিধর্মী বন্ধুদের কাছে আমরা লজ্জিত হয়েছি। ঘটনার মূলে কারা জানি না, তবে আমার জানা মতে, তাবলিগী মুরুব্বীরা ঝগড়াঝাটি, তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে দ্বীনি কাজ করার কঠোর পরামর্শ দেন।

তো বলছিলাম কবি শেখ সাদীর কথা। তিনি বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে মনে মনে আল্লাহকে ডাকছেন। তিনিই নিরাশ্রয়ের আশ্রয়। মানুষতো উসিলা মাত্র। এর মধ্যে গৃহিণী স্বামীকে বলছে, ওগো একটা কিছু করো আমার তো আর সহ্য হচ্ছে না, বাইর যাওনা এক দরবেশ কিসিমের মুসাফির দাঁড়িয়ে আছে তার কাছ থেকে আমার জন্য একটু দোয়া-তাবিজ নিয়ে আস। স্ত্রীর কথা মতো বাড়িওয়ালা শেখ সাদীকে বলেন, হুজুর আমার স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতর, আমরা গরিব মানুষ একটি মাত্র ঘর এ জন্য আপনাকে বাইরে দাঁড়িয়ে রেখেছি কিছু মনে করবেন না।

যদি আমার স্ত্রীর জন্য একটু দোয়া-তাবিজের ব্যবস্থা করতেন? কবিরা এমনিতে নরম দিলের মানুষ আবার তিনি সুফি প্রকৃতির কবি। শেখ সাদী যদিও কাউকে তাবিজ-কবচ দেন না, কিন্তু একজন সন্তান সম্ভবা মা কষ্ট পাচ্ছে তাই স্বান্তনা দেয়ার জন্য বলেন, ঠিক আছে, কাগজ-কলম নিয়ে আসুন তাবিজ লিখে দেই। বাড়িওয়ালা কাগজ-কলম নিয়ে এলে তিনি তাৎক্ষণিক রচিত মান জা শুদ খরাম নীয জা শুদ/যনে দেহক্বাঁ বযাইয়া ইয়ানা যাইয়াদ বাখোদা (ভাবার্থ প্রভূ হে আজ নিশিথে আশ্রয় চাই নিজের জন্য আর গাধার জন্যও আমার/এই মহিলার সন্তান হওয়া না হওয়া মাওলা তোমার বিচার) পঙ্তিটি লিখে দিয়ে বলেন, এটি তাবিজে ভরে আপনার স্ত্রীর উরুতে বেঁধে দিবেন।

শেখ সাদীর জীবন ও কর্ম পাঠকরা জানেন, এই তাবিজ বেঁধে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহিলার বাচ্চা খালাস হলে ওই পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে চলে। যার ফলশ্র“তিতে শেখ সাদী ওই বাড়িতে পীরের আসন লাভ করেন এবং তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আর ওই পরিবার তাবিজটি তার তাবাররুক হিসেবে বংশ পরম্পরায় হেফাজত করে তা থেকে উপকৃত হয়েছেন।

এখন যদি প্রশ্ন উঠে এখানে কোনো কোরআন হাদিসের দোয়া লেখা ছিল না তাই এটি ব্যবহার করা বিদাত। প্রশ্নটি যুক্তিসঙ্গত হলেও এর জবাব হল, শেখ সাদী কোনো পেশাদার আলেম বা তাবিজ-কবচ বিক্রেতা ছিলেন না। তার ইচ্ছা ছিল ওই বাড়িওয়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করে রাত যাপন করা। এটা যে কোনো মানুষের স্বভাবগত কৌশল। যেহেতু তিনি মুসাফির আল্লাহর রাস্তার পথিক, তাই তার ইচ্ছা পূরণ করে বাড়িওয়ালার উপকারের উসিলায় রাত যাপনের ব্যবস্থা করেছেন স্বয়ং আল্লাহ।

মানুষ মানুষে চাক্ষুশ উপকার পেলে ধর্মীয় বিধিনিষেধ সহিহ গরিব ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে মানুষকে সাময়িক বিরত রাখা যাবে, কিন্তু তা স্থায়ী হবে না। প্রচলিত তাবলিগের বিষয় কেউ কেউ এমন আপত্তি তোললেও মানুষ এখানে দলে দলে যাচ্ছে, মানুষ এখানে জীবন বদলের দীক্ষা পাচ্ছে বলে। তাবলিগ জামাতের আধুনিক মুবাল্লিগ মাওলানা তারিক জামিলের খোঁজ নিয়ে দেখুন জমিদার বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তার হবে।

আর তার ইচ্ছা ছিল নামকরা মিউজিশিয়ান বা সঙ্গীতশিল্পী হবেন। তাই মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দেশের বাইরে চলে যাবেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তালিম নিতে। ঠিক তার আগমুহূর্তে বাঙালি ক্লাসমেটের দ্বীনি দাওয়াত পেয়ে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। আজকে তিনি মুসাফিরে ইসলাম হিসেবে বিশ্বময় দ্বীনি দাওয়াত দিচ্ছেন।

বলিউডের আলোড়ন সৃষ্টিকারী পিকে ছবির নায়ক আমির খান থেকে শুরু করে ভিনা মালিকসহ অনেকেই তার দ্বীনি দাওয়াতে প্রভাবিত। এক সময়ের ব্যান্ডসঙ্গীত তারকা জুনায়েদ জামশিদ, ক্রিকেট তারকা ইনজামামুল হক, সাঈদ আনোয়ার, ইউসুফ ইউহানার জীবনধারা বদলে দিয়ে দ্বীনের খাদেমে রূপান্তরিত করেছেন তিনি।

তাবলিগ কাকে বলে?
মাওলানা লালপুরীর ভাষায়, আল্লাহ ও রাসূলের (দ.) হুকুমকে নিজে আমল করে অপরের নিকট পৌঁছে দেয়াকে তাবলিগ বলে। তিনি বলেন, তাবলিগের কাজ তিন প্রকারে শিক্ষা করা যায়। যেমন- তানফির অর্থ সফরে যাওয়া; তাজকির অর্থ একে অন্যের সঙ্গে দ্বীন ইসলামের বিষয় আলোচনা করা; তালিম অর্থ একে অন্যকে শিক্ষা দেয়া অথবা শিক্ষা লওয়া। তিনি আরও বলেন, অতীতকালে তিন প্রকারে ইসলামী কাজ চালু হয়েছিল। যেমন- তরকে অতন অর্থাৎ ইসলামের কাজের জন্য নিজে ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশ-বিদেশে সফর করা। নসরত অর্থাৎ একে অন্যকে শক্তি অনুযায়ী জান-মাল ও নিজের মূল্যবান সময় দিয়ে দ্বীনের মদদ এবং খেদমত করা। সোহবত অর্থাৎ কোনো হক্কানী আলেমের সঙ্গে কিছুদিন থেকে আমলি নকশা তৈরি করা।

শুধু কিতাব পড়ে ওয়াজ আমল পয়দা হয় না। আমল পয়দা করার জন্য সময় নিয়ে শারীরিক পরিশ্রম ও টাকা-পয়সা ব্যয় করতে হবে। কারণ পরিশ্রম ব্যতীত দুনিয়ার কোনো কাজ হাসিল করা যায় না। তাই তাবলিগ জামাতের পূর্ণ সবক শিখিতে হলে অন্তত চার মাস সময় নিয়ে এই জামাতের খেদমত করতে হবে।

শেয়ার করুন: