ফার্সি সাহিত্যে একটি প্রবাদ আছে— ‘সাতজন কবির সাহিত্যকর্ম রেখে যদি বাকি সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফার্সি সাহিত্য টিকে থাকবে। এই সাতজন কবির অন্যতম শেখ সাদি।’ ফার্সি গদ্যের জনক মহাকবি শেখ সাদি দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাভাষী পাঠকের কাছে অতি প্রিয় কবি। শুধু বাঙালিই নয় বিশ্বজুড়ে তিনি অত্যন্ত সমাদৃত। শেখ সাদিকে নিয়ে আজকের বিশেষ আয়োজন। ফার্সি গদ্যের জনক মহাকবি শেখ সাদি। প্রথম দিকে তিনি কিশোরদের জন্য উপদেশমূলক গল্প ও কবিতা লিখতেন। গল্পে গল্পে তিনি শুনিয়েছেন সততার পুরস্কার কীভাবে পাওয়া যায়। কীভাবে বিনীতশীলিত হতে হয়। কীভাবে ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করতে হয়।
এক কথায়, মানুষের সামগ্রিক বিকাশকে লক্ষ্য রেখেই তিনি গল্প, কবিতা রচনা করতেন। তা ছাড়া মানুষ হওয়ার বয়স কিন্তু কিশোর বয়স থেকেই। এই বয়সে নিজের নৈতিক চরিত্র ঠিক রাখা দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় শেখ সাদির রচনায়। তার লেখায় জ্ঞানী, গুণী মনীষীদের পবিত্র জীবনাচরণ উদাহরণ হয়েছে। আরবি কবিতা ও প্রবাদ বাক্য ছাড়াও তার লেখায় যথেষ্ট পরিমাণে পবিত্র কোরআন, হাদিসের উদ্ধৃতি লক্ষ করার মতো। শেখ সাদির লেখা জনপ্রিয় ‘কশিদা’ তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। (বালাগাল উলা বিকামালেহি/কাশাফাদ দুজা বিজামালিহী/হাসুনাত জমিউ খিসালিহী/ছাল্লু আলাইহে ওয়া আলিহী)— অতিশয় মহান গুণগান যার/রূপে যার দূরীভূত হলো অন্ধকার/মনোহর যার সমুদয় আচার/পড় সবে দরুদ উপরে তাহার।
শেখ সাদির পুরো নাম আবু মুহাম্মদ মোশাররফ উদ্দিন বিন মোসলেহ উদ্দিন আবদুল্লাহ সাদি সিরাজি। তিনি ইরানের সুপ্রসিদ্ধ ‘সিরাজ’ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে দেশের রাজদরবারে সাদির বাবা চাকরি করতেন। সাদির বাবার নাম সৈয়দ আবদুল্লাহ। মায়ের নাম মাইমুরা খাতুন। কৈশরের আগেই কবির বাবা মারা যান। এ কারণে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল অনেক কষ্টে। তার মা তাকে নিয়ে বড় কঠিন বিপদে পড়ে যান। শেষমেশ রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পিত হয় তার নানার ওপর। কিন্তু নানার অবস্থাও সচ্ছল ছিল না।
এদিকে স্বভাবকবি বলেই সাদির জ্ঞান, তৃষ্ণাও ছিল প্রবল। মা ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন ছেলেকে কীভাবে মানুষ করবেন। এতিম সাদিকে নিয়ে তার মা কতটা কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন তা কবি নিজেই বর্ণনা করেছেন। উঠতি যৌবনে বেপরোয়া সময়টাতে একদিন মূর্খতাবশত মায়ের সামনে চিৎকার করে উঠলে মা ব্যথিত হৃদয় নিয়ে ঘরের কোণেবসে থাকেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মনে হচ্ছে, তুমি তোমার শৈশব ভুলে গেছ, তাই তেজ দেখাচ্ছ। তাকে নিয়ে মায়ের ভাবনার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল সাদির অসম্ভব মেধাশক্তি।
ছোট্ট শেখ সাদি আর্থিক অনটনে স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এক ধনী ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী এবং পরিশ্রমী। ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ কথাটিতে ছিল তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস। বাগদাদ নগরীতেই তিনি বেড়ে ওঠেন। ২১ বছর বয়সে শেখ সাদি একটি কবিতা লিখে বাগদাদের প্রধান বিদ্যালয়ের নিজামিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক আবুল ফাতাহ বিন জুজিকে দেন। সেই শিক্ষক তা পড়ে মুগ্ধ হয়ে শেখ সাদির মাসোয়ারার ব্যবস্থা করে দেন।
৩০ বছর বয়সে তিনি মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই সঙ্গে ধর্ম, দর্শন আর নীতিশাস্ত্রে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করে ‘মাওলানা’ উপাধি লাভ করেন। এরপর তিনি মক্কায় হজ করতে যান। তার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য— তিনি ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। সে সময়ের পারস্য ছাড়াও তুরস্ক, সিরিয়া, জেরুজালেম, আর্মেনিয়া, আরব, মিসর, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্তান এবং ভারতের পশ্চিমাংশ ভ্রমণ করেন।
তার বয়স যখন আশি বছর তখন বাগদাদ নগরী হালাকু খান দ্বারা আক্রান্ত হলে হালাকু খানের নৃশংসতায় তিনি মর্মান্তিক কষ্ট পান। ভিতরে ভিতরে এতই কষ্ট পান যে তাকে পীড়িত করতে থাকে। বাগদাদের সঙ্গে ছিল তার হৃদয়ের সম্পর্ক। প্রায় ৪ বছরের মাথায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শেখ সাদি আজও বিশ্বের সাহিত্যাঙ্গনে স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
শেখ সাদি নিজের সাদি ডাকনামটি গ্রহণ করেছিলেন সেলজুকি বংশের পঞ্চম সম্রাট বাদশা মুজাফফর উদ্দিন কুতলুগ খান আবুবকর বিন সাদ বিন জঙ্গির (১২৩১-১২৬০) নাম থেকে। এ বাদশার যুগেই ১২৫৮ সালে কবি ছয় দশক পরে তার জীবনের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে শিরাজে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি তখন ইরানি জনগণসহ সাদিকে বিপুল সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করেছেন।
ইরানে ফেরার পরেই সাদি তার বিখ্যাত গ্রন্থ গুলিস্তাঁ রচনা করেছেন। যতদূর জানা যায়, সাদির বেশিরভাগ রচনা শিরাজে প্রত্যাবর্তনের পরেই রচিত যুক্তিও সে-কথাই বলে। সুতরাং ‘সাদি’ ডাকনাম গ্রহণও সে কারণেই যথার্থতা পেয়েছে। সাদি কবি জীবনে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রশংসা করেছেন।
তার মধ্যে রয়েছেন সাদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ও আলাউদ্দিন আতা মুলক জুয়াইনি। দুজনেই ছিলেন সে আমলের বিজ্ঞ মন্ত্রী। তবে তার কাছে সবচেয়ে প্রশংসনীয় ব্যক্তি ছিলেন এই বাদশাহ যার নামকে তিনি নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। যদিও সে প্রশংসায় কোনো তোষামুদি কিংবা অতিরঞ্জন নেই। তার রচিত ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থটিও বাদশার নামে উৎসর্গ করেছেন। বাদশার মৃত্যু হলে গুলিস্তাঁ থেকে দুটি মর্সিয়াও তার উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়।
অমর রচনা গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁঃ শেখ সাদি রচিত একাধিক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁ’ নামক গ্রন্থ দুটি অন্যতম। গ্রন্থ দুটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত এই গ্রন্থ এখনো অমর হয়ে আছে বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডারে। গ্রন্থ দুটি অনবদ্য পংক্তি সৃষ্টিতে যেমন সফল তেমনিভাবে সফল অভিভাকত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে। বর্তমানে আমাদের যুব সমাজে নানা ধরনের সন্ত্রাস, নীতিজ্ঞানের সংকট, মাদকাশক্তি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। চরিত্রহীনতার কার্যকলাপ বেড়েছে অবর্ণনীয়ভাবে। তথাকথিত উচ্চ শিক্ষা-দীক্ষায় জাতি আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেলেও তাদের মাঝে অভাব রয়েছে নীতিগত বিদ্যাশিক্ষার।
সুশিক্ষার অভাবে মানুষ অহরহ অন্যায় ও অপকর্মে জড়িয়ে যাচ্ছে। জাতি স্বভাবত তার সাহিত্য শিক্ষার মাধ্যমে কৃষ্টি ও সভ্যতার জ্ঞান লাভ করে। আগেকার দিনে ব্রিটিশ দাসত্বের যুগেও মুসলমানদের মধ্যে সাহিত্য চর্চা ছিল। ছেলেমেয়েরা নবী, আওলিয়াদের কেচ্ছা কাহিনী পড়ত এবং সে অনুযায়ী নিজেদের মন-মানসিকতা গড়ে তুলতে চেষ্টা করত। শেখ সাদির ‘গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁ’ মূলত সেই নৈতিকতার শিক্ষা দিতে সক্ষম। এর উপদেশাবলি আমাদের জাতির জন্য এখনো পথ প্রদর্শক হয়ে আছে। শেখ সাদি ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন নিষ্কলুষ চরিত্রের একজন কবি। তার বিনম্রতার পেছনে নিজামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকদের অবদান অসীম। ‘বুস্তাঁ’ গ্রন্থে অকপটে তিনি তা স্বীকার করেছেন।
তার মতে, ফুলের সংস্পর্শে মাটির ঢেলা যেমনিভাবে সুগন্ধি প্রাপ্ত হয়, অনুরূপ জ্ঞানী-গুণীর সংস্পর্শে থাকলে মানুষের চরিত্রেও এ প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থে তিনি বলেন, ‘একদা গোসলখানায় এক মাটির ঢেলা হাতে নিয়ে শুঁকে দেখলাম অফুরন্ত খুশবু, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি আতরদানি, না সুবাসে ভরা গুলিস্থান? মাটির ঢেলা বলল, এসব আমি কিছু নই, আমি অতি নিচু মাটি, ফুলের সঙ্গে থেকে আমার সুবাস খাঁটি হয়েছে।
পিতার কাছে হাতেখড়িঃ শেখ সাদির বাবা সৈয়দ আবদুল্লাহ সুলতান আতাবক সাদ বিন জঙ্গির দরবারে চাকরি করতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষানুরাগী ও সচেতন মানুষ ছিলেন। কবির লেখা থেকে জানা যায় বাবার কাছেই শেখ সাদির লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। শেখ সাদি যখন অনেক ছোট তখনই তার বাবা লেখার জন্য তাকে একটি ‘স্লেট’ এবং হাতের আঙুলে পরার জন্য একটি সোনার আংটি কিনে দেন। তবে মজার ঘটনা হলো, মিষ্টিভক্ত শিশু সাদি মিষ্টির বদলে ময়রাকে আংটি দিয়ে দিয়েছিলেন। পরহেজগার বাবার সহচর্যে তিনি নামাজ, রোজা ও রাত্রিকালীন ইবাদতে অভ্যস্ত হন।
বাবার উৎসাহে কোরআন শিখতেও যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন। বাবার স্মৃতি বর্ণনায় উঠে এসেছে, একবার ঈদের দিন লোকজনের ভিড়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে শেখ সাদি বাবার জামার প্রান্ত ধরে হাঁটছিলেন। কিন্তু পথে খেলাধুলায় মত্ত ছেলেদের দেখে জামার প্রান্ত ছেড়ে হারিয়ে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। পরে বাবা তাকে ফিরে পেয়ে রেগে বলেন, গাধা, তোমাকে না বলেছিলাম কাপড় ছাড়বে না। এ ঘটনা কবির হৃদয়ে রেখাপাত করে এবং তিনি সারা জীবনের জন্য বুঝতে পারেন বড়দের ‘প্রান্ত’ কখনো ছাড়তে নেই। তা হলেই পথহারা হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
জাতিসংঘের সদর দফতরে শেখ সাদিঃ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে রয়েছে একটি বিশাল কার্পেট। জাতিসংঘের প্রবেশপথের দেয়ালে সেঁটে থাকা সেই কার্পেটটি ইরানি জনগণের পক্ষ থেকে দেওয়া উপহার। যার মাঝখানে লেখা আছে মহাকবি শেখ সাদির একটি কবিতা। বলা হচ্ছে ‘সব মানুষ এক দেহের অঙ্গসম; যেহেতু সবার প্রথম উপাদান একই।
জাতিসংঘের সদর দফতরে শেখ সাদি: যখন একটি অঙ্গ ব্যথায় আক্রান্ত হয়, বাকি অঙ্গও তখন স্থির থাকতে পারে না। অন্যের দুর্যোগে যদি উদ্বিগ্ন না হও, তবে তোমার নাম মানুষ হতে পারে না।’ ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মার্চ মাসে ইরানের নববর্ষ (নওরোজ) উপলক্ষে সে দেশের জনগণকে ভিডিওর বার্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছা পাঠান। সেখানে বারাক ওবামা কোট করেন শেখ সাদির একই কাব্যাংশ। তিনি বলেন, এটি ঠিক যে, আমরা নিজেদের মধ্যে কতগুলো বিভাজনের কারণে বিভক্ত হয়ে আছি।
তবে আমরা সেই শব্দগুলো মনে রাখতে পারি, যা কবি সাদি লিখে রেখেছেন বহু বছর আগে। আদম সন্তান সবাই এক দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মতো, যেহেতু সবাই একই উপাদান থেকে তৈরি।
বিখ্যাত উপদেশঃ >> অজ্ঞের পক্ষে নীরবতাই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম পন্থা। এটা সবাই জানলে কেউ অজ্ঞ হতো না। >> অকৃতজ্ঞ মানুষের চেয়ে কৃতজ্ঞ কুকুর শ্রেয়। >> আমি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই। তার পরেই ভয় পাই যে আল্লাহকে মোটেই ভয় পায় না। >> মানুষ এমনভাবে জীবনযাপন করে যেন কখনো মরতে হবে না, আবার এমনভাবে মরে যায় যেন কখনো বেঁচেই ছিল না।
>> হিংস্র বাঘের ওপর দয়া করা নিরীহ হরিণের ওপর জুলুম করার নামান্তর। >> যে সৎ, নিন্দা তার কোনো অনিষ্ট করতে পারে না। >> প্রতাপশালী লোককে সবাই ভয় পায় কিন্তু শ্রদ্ধা করে না। >> দেয়ালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় সতর্ক হয়ে কথা বল, কারণ তুমি জান না দেয়ালের পেছনে কে কান পেতে দাঁড়িয়ে আছে।
>> মুখের কথা হচ্ছে থুথুর মতো, যা একবার মুখ থেকে ফেলে দিলে আর ভিতরে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই কথা বলার সময় খুব চিন্তা করে বলা উচিত। >> মন্দ লোকের সঙ্গে যার ওঠাবসা, সে কখনো কল্যাণের মুখ দেখবে না। >> দুই শত্রুর মধ্যে এমনভাবে কথাবার্তা বল, যেন তারা মিলে গেলেও তোমাকে লজ্জিত হতে না হয়। >> বাঘ না খেয়ে মরলেও কুকুরের মতো উচ্ছিষ্ট মুখে তুলে না। >> পরকালে যাহা আবশ্যক তাহা যৌবনে সংগ্রহ করিও।
জীবনকে ভাগ করেছিলেন চার ভাগেঃ নিজের দীর্ঘ জীবনকে শেখ সাদি চার ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। ৩০ বছর লেখাপড়ায়, ৩০ বছর দেশ ভ্রমণে, ৩০ বছর গ্রন্থ রচনায়, ৩০ বছর আধ্যাত্মিক চিন্তায়।
নিজের ওপর বিশ্বাসের দৃঢ়তা থাকলেই কারও পক্ষে এমনটি করা সম্ভব। আর তাইতো বাগদাদ থেকে লেখাপড়া শেষ করেই শেখ সাদি দেশ ভ্রমণে বের হন। তিনি এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোয় দীর্ঘ সময় ব্যয় করে ভ্রমণ করেন। শোনা যায় তাঁর জীবনের উক্ত চারটি পর্যায় যেদিন পূর্ণ হয় সেদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শেখ সাদি দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে এমন পাণ্ডিত্য অর্জন করেন যে তিনি আঠারটি ভাষা রপ্ত করতে সক্ষম হন। এর ভিতর অনেক ভাষা তার মাতৃভাষার মতোই ছিল। আর তিনি এত বেশি দেশ ভ্রমণ করেন যে ইবনে বতুতা ছাড়া প্রাচ্য দেশীয় পর্যটকদের মধ্যে কেউই এত বেশি দেশ ভ্রমণ করেননি।
আশ্চর্যের বিষয় যে, তিনি পায়ে হেঁটে চৌদ্দবার হজ পালন করেছিলেন। তিনি তার সফরকালে অসংখ্য নদী এমনকি পারস্য উপসাগর, ভারত মহাসাগর, ওমান সাগর, আরব সাগর প্রভৃতি পাড়ি জমিয়েছেন। আর সঞ্চয় করেছেন অপরিসীম জ্ঞান। দেশ ভ্রমণকালে শেখ সাদি একবার ফিলিস্তিনের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। সেখানকার আদিবাসীদের হাতে বন্দী হয়ে অন্যান্য বন্দীর সঙ্গে কবিকে খন্দক খননের কাজও করতে হয়। সেখান থেকে মুক্তি পেতে কবিকে দশ দিরহাম মুক্তিপণ দিতে হয়েছিল।
খালি পায়ে বিশ্বভ্রমণঃ শেখ সাদি দৈহিকভাবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ছিলেন। পায়ে হেঁটেও বহু অঞ্চল তিনি ভ্রমণ করেছেন। অনেক সময় ফকির-দরবেশের মতো খালি পায়েই তাকে চলতে হয়েছে। গুলিস্তাঁয় তিনি লিখেছেন, আমি কখনো কালের কঠরতা ও আকাশের নির্মমতার ব্যাপারে অভিযোগ করিনি। তবে একবার নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কারণ পায়ে তখন জুতা তো ছিলই না এমনকি জুতা কেনার মতো অর্থও ছিল না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ইরাকের মসজিদ আল কুফায় গিয়ে উঠলাম। তখন দেখি একটি লোক শুয়ে আছে যার একটি পা-ই নেই। তখন খোদাকে শোকর জানিয়ে নিজের খালি পা থাকাও সন্তুষ্ট হলাম। হাঁটতে হাঁটতেই তিনি দেখেছেন মুসলিম সাম্রাজ্যের শৌর্য-বীর্য, সঙ্গে সঙ্গে পতনের দৃশ্য। পায়ে হেঁটে তিনি চৌদ্দবার হজ পালন করেছেন।
ভ্রমণের মধ্যে ছিল পারস্য সাগর, ভারত মহাসাগর, ওমান সাগর, আরব মহাসাগর পাড়ি। কথিত আছে, ভারত সাগর ভ্রমণ বাদে সাদি আরও তিনবার ভারতবর্ষে পদার্পণ করেছিলেন। পাঠানরাজ আলতামাশের সময় তিনি কিছুকাল দিল্লিতে অবস্থান করেছিলেন। চতুর্থবার তিনি বিখ্যাত কবি ও গায়ক আমির খসরুকে দেখতেই ভারতে আসেন। সাদি পুবে ভারতের সিন্ধু প্রদেশ অবধি এসেছিলেন। এরপরে খ্রিষ্টীয় ১৩ শতাব্দির শেষভাগে মুলতানের শাসক যুবরাজ মুহাম্মদ খান শহিদ তার পিতা গিয়াসুদ্দিন বলবনের পক্ষ থেকে শেখ সাদিকে ভারতে আসতে দুবার আমন্ত্রণ জানান।
শিক্ষণীয় গল্পঃ একবার শেখ সাদি সম্রাটের কাছে দাওয়াতে যাচ্ছিলেন। পথের মাঝে রাত হলে এক বাড়ির ছোট্ট একটি ঘরে আশ্রয় পেলেন। বাড়ির পক্ষ থেকে সামান্য কিছু খাবারও জুটল। পরের দিন শেখ সাদি বিদায় নিলেন। শেখ সাদিকে পেয়ে সম্রাট অনেক খুশি। সেজন্য বিদায় বেলায় কবিকে সম্রাট বেশ দামি উপহার ও একটি জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক দিলেন। শেখ সাদি সেই পোশাক পরে উপহার নিয়ে বিদায় নিলেন। ফেরার পথে সেই একই বাড়িতে আবার রাত্রিকালীন আশ্রয় নিলেন। বাড়ির লোকেরা এবার তাকে দেখে সম্মানের সঙ্গে নিজেদের সোয়ার ঘরে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। একই সঙ্গে অনেক ধরনের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করলেন।
সবার সঙ্গে খেতে বসে শেখ সাদি না খেয়ে সব খাবার পোশাকের পকেটে রাখতে লাগলেন। তা দেখে বাড়ির একজন কৌতূহল ধরে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনি না খেয়ে খাবারগুলোকে পোশাকের পকেটে কেন রাখছেন। শেখ সাদি বললেন, আমি যখন কয়দিন আগে এ বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলাম তখন আমার অবস্থা খুব সাধারণ ছিল।
তাই আমার সমাদরও ছিল খুব সাধারণ। আজ আবার যখন এ বাড়িতে আসলাম তখন আমার অবস্থা খুব উচ্চ অবস্থায়। এর সবই পোশাকের গুণেই হয়েছে। তাই খাবারগুলো তারই প্রাপ্য। তাই আমি না খেয়ে পোশাককে তা খাওয়াচ্ছি। একথা শুনে তাদের খুব লজ্জা হলো এবং এ রকম ব্যবহারের জন্য তারা শেখ সাদির কাছে ক্ষমা চাইলেন। সাত বছরের দাস জীবনঃ শেখ সাদির জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতা ভরপুর। আর এসব অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে তার লেখনীর মাধ্যমে। একবার দেশ ভ্রমণের সময় তিনি দামেস্কবাসীর প্রতি বিরাগভাজন হয়ে ফিলিস্তিনের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। কিন্তু এই সময় দুর্ভাগ্যক্রমে খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের হাতে তিনি বন্দী হন।
শেখ সাদির সাত বছরের দাস জীবন: খ্রিস্টানরা বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি থেকে আনা ইহুদি বন্দীদের সঙ্গে কবিকে রাখে। শুধু তাই নয় কবিকে দিয়ে তারা খন্দক খননের কাজও করায়। কবিকে এই কাজ করতে হয়েছে দীর্ঘ সাত বছর। এক দিন সৌভাগ্যক্রমে বাবার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাবার বন্ধু তাকে দশ দিরহাম মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে আনেন। এত কষ্ট সহ্য করার পরও শেখ সাদি নিজের লেখায় বারবার বলেছেন ‘মানবজাতি অভিন্ন মূল থেকে উদ্ভূত’।