অপহৃত প্যানেল মেয়র নজরুলসহ ৬ জনের লাশ শীতলক্ষ্যা থেকে উদ্ধার

কামাল উদ্দিন সুমন: অপহরণের ৪ দিন পর নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুলসহ ৬ জনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে । গতকাল বুধবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার কলাগাছিয়া এলাকার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬টি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর মধ্যে ৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। উদ্ধার করা লাশের মধ্যে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম তার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন ও তাজুল ইসলাম এবং অপহৃত আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমের লাশ সনাক্ত করেছেন তার স্বজনরা।

এদিকে প্যানেল মেয়রের লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় লোকজন ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এসময় তারা টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। সন্ধ্যায় মৌচাক এলাকায় একটি পেট্রোলপাম্পে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুদ্ধ জনতা। এখন ক্ষোভের আগুনে উত্তাল নারায়ণগঞ্জ।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, গতকাল বুধবার দুপুরে বন্দর উপজেলার গলাগাছিয়া ইউনিয়ন এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে ৬টি লাশ ভেসে ওঠে। স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঘটনা স্থলে এসে লাশ উদ্ধার করে। পরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের লাশ তাঁর ভাই আবদুস সালাম এবং মনিরুজ্জামান স্বপনের লাশ তার ভাই বিপন ও তাজুল ইসলামের লাশ তার বোন শিরিনা আক্তার এবং অপহৃত আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমের লাশ সনাক্ত করেছে তার ভাগিনা আবু বকর।

বন্দর থানার ওসি আক্তার মোরশেদ জানান, বুধবার দুপুর ৩টার দিকে স্থানীয় লোকজন গলাগাছিয়া ইউনিয়ন এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে তিনটি লাশ ভেসে ওঠার খবর পুলিশকে জানান। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মোট ৬টি লাশ উদ্ধার করে। লাশগুলো পচে গন্ধ বের হচ্ছিল। তিনি জানান, প্রতিটি লাশের হাত-পা বাঁধা ছিল। লাশের সঙ্গে দুটি করে বস্তাও বাঁধা পাওয়া যায়। প্রতিটি বস্তার মধ্যে ১০-১২টি ইট ছিল। লাশ যেন ভেসে উঠতে না পারে সেজন্য দুর্বৃত্তরা এ অবস্থা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নজরুল ইসলামের লাশ উদ্ধারের পর দেখা গেছে তার পেট কাটা।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের অপহৃত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের মৃতদেহসহ ৬টি লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে গতকাল বুধবার বিকেল থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে স্থানীয় মানুষ। বিক্ষুব্ধ লোকজন নেমে আসেন রাস্তায়। তাঁদের অবরোধে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সড়কে আগুন জ্বালিয়ে চলছে বিক্ষোভ। নজরুলের সমর্থকরা ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাস্তায় আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ করছেন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকাও অবরোধ করেছেন তাঁরা। এর আগে গতকাল সকাল ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত স্থানীয় লোকজন মহাসড়ক এবং ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ করে রাখে। এসময় তারা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে। বিকেলে লাশ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাস্তায় নেমে আসে মানুষ।

গত ২৭এপ্রিল বেলা আড়াইটার দিকে আদালতে একটি মামলায় হাজিরা শেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম সাদা রঙের এক্স করলা (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৯১৩৬) প্রাইভেট কারযোগে সিদ্ধিরগঞ্জ ফিরছিলেন। ওই গাড়িতে নজরুল ছাড়াও গাড়ির চালক এবং তাজুল, স্বপন ও লিটন নামের নজরুলের তিন সহকারী ছিলেন। শিবু মার্কেট এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে তাদেরকে অপহরণ করা হয়।

একই দিনে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট চন্দন সরকার ও তার গাড়ির ড্রাইভার ইব্রাহিম। গতকাল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ইব্রাহিমের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অপহরণের ৩০ ঘন্টা পর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা আক্তার বাদী হয়ে কাউন্সিলর নুর হোসেনসহ ১১ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন।

এদিকে অপহৃত সিটি প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধারের পর তাদের দেখতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আর কত লাশ নিলে ওইসব গডফাদারদের মন ভরবে? অপহরণ ও গুমের ঘটনায় প্রশাসনের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সেলিনা হায়াত আইভি। এ সময় তিনি বলেন, ওইসব গডফাদাররা আর কত লাশ নিলে শান্ত হবে। আর কত লাশ নিলে তাদের মন ভরবে তা আমরা জানতে চাই। তারা কি নারায়ণগঞ্জের সব মানুষের লাশ চায়। কয়েকদিন পরপর শীতলক্ষ্যায় লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে আর কতদিন চলবে। প্রশাসন কেন নীরব ভূমিকা পালন করছে।

এদিকে, জেলা থেকে কাউন্সিলর, আইনজীবীসহ সম্প্রতি ৭ জন অপহরণের ঘটনায় জেলা প্রশাসক মনোজ কান্তি বড়ালকে গতকাল বুধবার প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তাকে নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পদে বদলি করা হয়। নারায়ণগঞ্জের নতুন ডিসি হচ্ছেন- টাঙ্গাইলের ডিসি আনিসুর রহমান মিয়া। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার, ফতুল্লা , সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি এবং র‌্যাব-১১ সিইওকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান জানান, ‘সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির জরুরি বৈঠকে পুলিশ সুপারসহ (এসপি) জেলার র‌্যাব ও পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বদলির সিদ্ধান্ত হয়। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের কোথাও বুধবার থেকে সাদা পোশাকে পুলিশ কোনো কার্যক্রম চালাবে না। নারায়ণগঞ্জের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা কর্মকৌশল প্রণয়ন করছেন।

উল্লেখ্য নারায়ণগঞ্জে প্রতিদিনই ঘটছে খুন, গুম, অপহরণের ঘটনা। প্রায়ই উদ্ধার হচ্ছে বস্তাবন্দী লাশ, গলাকাটা লাশ, মাথা বিচ্ছিন্ন লাশ। মেধাবী শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী খুন থেকে শুরু করে মাত্র ১১ মাসে সেখানে ১৫ জন শিক্ষার্থীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। একই সময়ে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে আরো ১২ শিশু। অপহরণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এছাড়া সম্প্রতি বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৫টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪টি, মার্চ ২০টি খুনের ঘটনা ঘটে। আর চলতি মাসে খুনের শিকার হয়েছেন ১৯ জন। এর মধ্যে ডাবল মার্ডার, ট্রিপল মার্ডার, ফোর মার্ডারের ঘটনাও ঘটেছে কয়েকটি। নৃশংসভাবে খুনের শিকার মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকা-ের মতোই নারায়নগঞ্জ সদরে অপহরণের পর নৃশংসভাবে খুন করা হয় ৯ বছরের শিশু মোস্তফাকে।

একই দিনে সোনারগাঁয়ের ওমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী সাকিন ও জাহিদুলকে হত্যা করা হয়। এর আগে ফতুল্লা মাসদাইর স্কুলে শিক্ষার্থী সিয়াম ও ফতুল্লায় বক্তাবলীতে শিশু ইমনকে হত্যার পর নয় টুকরা করা হয়। সোনারগাঁয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয় সাংবাদিক দেলোয়ারকে। ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে স্থানীয় সামছুল আলম (৬০) নামে এক মাতব্বরকে হত্যা করে। ৫ এপ্রিল শহরের নিতাইগঞ্জ নাইনা ফ্লাওয়ার-২ নামের একটি ময়দা কারখানার ভেতর থেকে নৈশপ্রহরী আবদুল আজিজ (৫৫) ও মিলের শ্রমিক হোসেন মিয়াসহ নৃশংস খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ অপহরণের শিকার প্যানেল মেয়রসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়।

শেয়ার করুন: