বন্ধু দিবস

এক জীবনে কতজন বন্ধুর প্রয়োজন?

সবার জীবনেই বন্ধু থাকে। বন্ধু ছাড়া জীবন কল্পনা করা কঠিন। তবে জীবনে একজন ভালো বন্ধু পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ একজন ভালো বন্ধুর সঙ্গেই জীবনের সব আবেগ, ভালোবাসা, গোপনীয়তা শেয়ার করা যায়। বন্ধু হচ্ছে ভরসার জায়গা। বন্ধু সবার জীবনে খুবই অপরিহার্য একটা অংশ।
বন্ধু যে কেবল মানুষের জীবনেই থাকে তা কিন্তু নয়। সমগ্র প্রাণীকূলের ক্ষেত্রেই বন্ধু জরুরি। বন্ধু ছাড়া প্রাণীকূল টিকে থাকতে পারত না। তাই পুরো প্রাণীকূলই যখন বন্ধুত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ, তখন মানুষের বন্ধু ছাড়া বেঁচে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। বন্ধুত্ব জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এক জীবনে আমাদের কতজন বন্ধু প্রয়োজন। উত্তরে বলা যেতে পারে, বিশ্বস্ত বন্ধু একজনই যথেষ্ট। এছাড়াও একাধিক বন্ধু থাকতে পারে। তবে মাত্রাতিরিক্ত নয়।

বন্ধু আমাদের জীবনের অপরিহার্য একটা অংশ। এরা আমাদের মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। বন্ধুর কারণে আমরা বেঁচে থাকার আশা পাই। এরা আমাদের স্নায়বিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করে; অবশ্যই ইতিবাচক অর্থে! এই স্নায়বিক উত্তেজনার ঘাটতি হলেই বরং আমাদের বেশ ক্ষতি হয়ে যাবে। এছাড়াও বন্ধু আমাদের জীবনে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। চলুন জেনে নেয়া যাক সেগুলো-

বন্ধু আমাদের প্রাণ খুলে হাসতে শেখায়: অকারণ আড্ডা আর অর্থহীন হাসাহাসির কথা বলছি। প্রতিদিন খানিকটা সময় কোনো যুক্তি বা কাজের মাঝে না থেকে মন খুলে হেসে ওঠাটাও যেন পরেরদিনের প্রতিযোগিতাময় জীবনের ইন্ধন। বন্ধু আমাদের জীবনের সেই প্রদীপ, যে দুর্দিনেও টিমটিম করে আলো ছড়ায়। আপনার মন যতই খারাপ থাকুক না কেন; বন্ধুর সঙ্গে ১০ মিনিট আড্ডা অচিরেই আপনার সব সমস্যা, চিন্তা, অশান্তি, বিরক্তি অনেকটা হালকা করে দেবে। ১০ মিনিটেই ফিরে পাবেন
পুরনো আপনাকে।

নিজেকে লুকোতে হয় না, নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা যায়: বন্ধু আমাদেরকে আমাদের মতো করে গ্রহণ করে। বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক, যেখানে আমাদের নিজেকে লুকোনোর প্রয়োজন হয় না। আমরা নির্দ্বিধায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারি। আমাদের ভালো দিক, খারাপ দিক, দোষ-গুণ, আবেগ-আহ্লাদ সবটা জেনেই বন্ধু আমাদের গ্রহণ করেন এবং কখনো অভিযোগ করে না। ছোট-বড় ভুল ভ্রান্তির জন্য তাদের সামনে লজ্জিত হতে হয় না।

বন্ধু শেখায় বিশ্বাস করতে: বন্ধুর কাছ থেকে আমরা সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটা পাই তা হচ্ছে, বিশ্বাস করার শিক্ষা। বন্ধু আমাদের শেখায় বিশ্বাস করতে। বন্ধুর কাছে মন খুলে গল্প করা যায়। মনের সব গোপন কথা নিঃসঙ্কোচে আমরা তাদেরকে বলে দিতে পারি। গোপন কথাগুলো গোপন রাখার প্রতিশ্রুতি নিতে হয় না হাজারবার। এক অজানা বিশ্বাস ও ভরসা কাজ করে বন্ধুর উপর সকলেরই। আমরা জানি, বন্ধু আমাদের অসম্মান করবে না; অন্যদের মতো প্রতারণাও করবে না।

বন্ধু আছে বলেই আমরা একা নই: জীবন মানেই সুখ-দুঃখের মিল মিশ। তাই প্রতিদিন ভালো কাটবে অথবা প্রতিটা সময় খারাপ যাবে, এমনটা আশা করা বড্ড ভুল। কিন্তু ভালো সময় আনন্দ না বাড়ালে আর খারাপ সময়ে দুঃখের বোঝা না কমালে কি এই ‘বন্ধুর’ পথ চলা সহজ হতো? মোটেই না। তাই আনন্দ ও কষ্ট দুটো মুহূর্তেই আমাদের খুব করে প্রয়োজন হয় বন্ধুদের। বন্ধু কাছে না থাকলেও ফোনের এপাশ থেকে নিজের কণ্ঠটা শুনিয়ে শান্ত করা যায় মন। বন্ধু না থাকলে আমরা হারিয়ে যেতাম কোনো এক হতাশার জগতে। জীবনে থাকত না কোনো আনন্দ-উদ্বেগ।

বন্ধু আমাদের আবেগ প্রকাশ করতে সাহায্য করে: বর্তমানে আমরা অনেকটা যান্ত্রিক জীবনযাপন করে থাকি। সবসময় আবেগগুলো চেপে রাখতে রাখতে আমাদের মধ্যে আবেগ প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে। কিন্তু বন্ধুর কল্যাণে আমাদের মধ্যে এখনো মানুষসত্ত্বা বেঁচে আছে। বন্ধুই একমাত্র মানুষ, যার সামনে মন খারাপ হলেই আমরা নির্দ্বিধায় ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলতে পারি। কারণ আমরা জানি, বন্ধু আমাদের কষ্ট দেখে আনন্দ পাবে না বা বিরক্ত হবে না। তারা অদমিত আবেগ দেখে ভ্রূ কুঁচকাবে না। বরং আমার কষ্ট বুঝবে; সেটা কমানোর চেষ্টা করবে। সবচেয়ে বড় কথা, মন খুলে আবেগ প্রকাশ করতে দেবে।

বন্ধুত্ব আমাদের কৃতজ্ঞ হতে শেখায়: আমরা সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, সঠিক মানুষকে বেছে নিতে পারি না। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সঠিকভাবে করতে আমাদেরকে সাহায্য করে আমাদের বন্ধু। জীবনের বহু চড়াই-উতরাইয়ে বিভিন্ন পরামর্শ, সঙ্গ দিয়ে তারা আমাদের জীবনীশক্তিটা বাঁচিয়ে রাখে। তাই আমাদের উচিত বন্ধুর প্রতি সব সময় কৃতজ্ঞ থাকা। এবং বন্ধু যখন আমাদেরকে বোঝায় আমরা তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তখনও আমাদের উচিত তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

বন্ধুত্ব বিচার-বিবেচনার ঊর্ধ্বে: আমরা কেউই দোষের ঊর্ধ্বে নই। গুণ যেমন প্রতিটা মানুষের আছে, তেমনই দোষও রয়েছে। বন্ধুরা সে সকল দোষ উপেক্ষা করে চলে। আমাদের দোষগুলোর কারণে তারা কখনও আমাদেরকে ছেড়ে যায় না, ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো দোষ শোধরানোর চেষ্টা করে। বরং একই রকম উদারতা ও ভালোবাসার সঙ্গে আমাদের দোষ এবং গুণ দুটোই তারা গ্রহণ করে। তারা কখনো অনুভব করায় না, আমাদের দোষ কত বেশি বা আমরা কতটা গুণহীন! তারা শুধুই ভালোবাসা বিনিময় করতে জানে।

নির্ভয়ে আমরা দোষ স্বীকার করতে পারি: একটু আগেই বলা হয়েছে, আমরা কেউ দোষের ঊর্ধ্বে নই। কিন্তু দোষ স্বীকার করতে অনেক সাহসের প্রয়োজন হয়। অনেক সাহসী মানুষও এই কাজটি করতে মাঝে মাঝে হিমশিম খেয়ে যায়। কিন্তু খুব দুর্বল চিত্তের একজন মানুষ অবলীলায় বন্ধুর সামনে নিজের দোষটা স্বীকার করে নিতে পারে। এই মানুষটার ক্ষেত্রেই আমাদের শুধু ভাবতে হয় না, “আমাকে ভুল বুঝবে না তো! আমাকে ছেড়ে যাবে না তো!” এটাই বন্ধুত্বের মহত্ব।

বন্ধুত্ব সততার শিক্ষা দেয়: বন্ধু আমাদের সবচেয়ে মহৎ গুণের শিক্ষা দেয়, সততার শিক্ষা দেয়। বন্ধুর কাছ থেকে আমরা শিখতে পারি, ছোটখাট মিথ্যা কতটা গুরুতর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় একটা সম্পর্কে। এবং দুটো মানুষ যখন একসঙ্গে থাকছে, একইভাবে ভাবছে, তখন এই মিথ্যাগুলো কতটা অর্থহীন। যেহেতু, বন্ধুত্ব সব প্রকার বিচার-বিবেচনার ঊর্ধ্বে, তাই আমাদের অযথা নিজের সত্ত্বাকে লুকিয়ে রাখা প্রয়োজন নেই, নেই অকারণে মিথ্যে বলার প্রয়োজন। কারণ এই মিথ্যেগুলো খুব সহজেই ধরা পড়ে যায় এবং শুধু শুধু সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে। কোনো উপকার হয় না।

বন্ধুত্ব আমাদের ক্ষমাশীল করে: ক্ষমাশীলতার মতো সুন্দর গুণটাও আমরা পাই বন্ধুর কাছ থেকে। আমরা জানি যে, মানুষ মাত্রই ভুল। কোনো মানুষই নিখুঁত বা নির্ভুল নয়। আমরা সবাই করি, কিন্তু বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার কাছে সেই ভুলগুলো নিছকই ফিকে পড়ে থাকে। অকারণে খারাপ ব্যবহার করলে, বন্ধু আমাদের উপর রাগ করে না। তারা বোঝে যে আমরা কোনো সমস্যায় আছি। তারা জানে, এই মুহূর্তে আমাদের তাদেরকে ভীষণভাবে দরকার। আমাদের খারাপ সময়ে আমাদের শত রাগ-ঝাল সহ্য করেও বাঁশের খুঁটির মতো আমাদের অবলম্বন হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে যে, সে-ই তো বন্ধু।

তাই কখনোই প্রিয় বন্ধুকে জানাতে কার্পণ্য করবেন না, তাকে আপনি কতটা ভালোবাসেন। বন্ধুত্ব উদযাপন করুন, প্রতিদিন, প্রতিটা সময়। সবার বন্ধুত্বই অটুট থাকুক।

শেয়ার করুন: