চাকরি

কামাল হোসেন সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। আর কয়েকদিন পরেই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে। এরই মধ্যে হঠাৎ আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে চলে এসেছেন এক সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা আইনজীবী ড. কামাল হোসেন।

নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি বিগত এক দশকে রাজপথের আন্দোলনে ব্যর্থ রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করেছেন। তার জোটে আছেন আরেক সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না ও বাম রাজনীতিক আ.স.ম আব্দুর রব। এই জোটের সমর্থনে আছেন কিছু পেশাজীবী নেতা ও বিশিষ্ট নাগরিক।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা এবং মন্ত্রী-এমপিরা প্রতিপক্ষ বিএনপিকে বাদ দিয়ে এখন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে আক্রমন করছেন। কেউ তার বিরুদ্ধে বোমা ফাঁটানো তথ্য দিচ্ছেন, কেউ বিষোদগার করছেন, কেউ কথার তীর ছুঁড়ে মারছেন।

সংসদ থেকে শুরু করে সভা-সমাবেশে যেখানে বিএনপিকে তুলোধুনো করা ক্ষমতাশীন দলের যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিনত হয়েছিল সেখানে বিএনপির যায়গা হঠাৎ করে যেন দখল করে নিলেন ড. কামাল হোসেন। গত দশ দিনে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিকে আক্রমণ করে যত না বক্তব্য দিয়েছেন; তার চেয়ে বেশি কথা বলছেন তাকে নিয়ে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ড. কামাল হোসেনের সমালোচনা করেছেন।

মাদারীপুরের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যারা খুন, দুর্নীতি ও অগ্নি-সন্ত্রাস করে তাদের সাথে হাত মিলিয়েছেন ড: কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না ও আ.স.ম আব্দুর রব।’ নতুন জোটকে ‘জগাখিচুড়ি ঐক্য’ আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নৌকা থেকে নেমে ধানের শীষের মুঠো ধরেছেন ড: কামাল হোসেন। কামাল হোসেনের সঙ্গে জুটেছে আরও কিছু খুচরা আধুলি। এরা সব ঐক্য করেছে।’

ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দেশে যখন শান্তিময় রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছিল, ঠিক সে সময় ১/১১-এর কুশীলবেরা আবার রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অসম্ভব খেলায় মেতে উঠেছে। ’

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘উনি (কামাল হোসেন) তো ১/১১ সময়েও তৃতীয় শক্তি আনার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এখন আবারও সেই প্রক্রিয়াই আছেন তিনি। একবার তিনি সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়েছেন। কামাল হোসেনদের সকল ষড়যন্ত্র আমরা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করব।’

যাকে নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা আসুন সেই ড. কামাল হোসেন সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি। আসুন তার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।

ড. কামাল হোসেন সম্পর্কে বলা হয়, তিনি এদেশের এমন একজন নক্ষত্র, যিনি আলোকিত হতে চান অপরের আলোয়। নিজস্ব কোনো আলো তার কাছ থেকে বিচ্ছুরিত হয় না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর উদারতায় তাঁরই ছেড়ে দেয়া আসনে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে। মন্ত্রীও হন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার। আইনমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজে নেতৃত্ব দেন। ১৯৮১ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও করেছিলেন।

একজন দক্ষ আন্তর্জাতিক আইনজীবী হিসেবে দেশে-বিদেশে তিনি প্রচুর রোজগার করেন। কিন্তু বিপুল এই অর্থ সম্পদ ব্যক্তিগত ভোগবিলাস ছাড়া আর অন্য কোনো খাতে ব্যয় হতে দেখা বা শোনা যায়নি।

সামাজিক কোনো খাতে কখনও সামান্য অর্থ দান করার নজিরও রাখেননি। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এমন অনেক সাংবাদিকের কাছ থেকে শোনা গল্প থেকে জানা যায়, তারঁ বাসায় সাংবাদিক হোক আর অন্য কেউ হোক যারা গিয়েছেন তাদেরকে খেতে বলেছেন এমন কোন নজির নেই।

আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন ভারতের কলকাতায়, বেড়ে উঠেন ঢাকায় এবং বিয়ে করেন পাকিস্তানে। ১৯৫৭ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৮ সালে ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি লাভ করেন। লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল অর্জনের পর আন্তরজাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি করেন ১৯৬৪ সালে। দেশে ফিরে তিনি আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা থেকে তাকে আটক করে পাকিস্তানের একটি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেকে বলেন, তিনি ওই সময় পাকিস্তানে তাঁর শশুর বাড়িতে ছিলেন। যাহোক, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওইদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে ড. কামাল হোসেনকেও বিমানে তুলে দেয় পাকিস্তান সরকার।

পাকিস্তানে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান এবং তারপর দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। সঙ্গে আসেন ড. কামাল হোসেনও।

১৫ আগস্টের পর ড. কামালের ভূমিকা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে যারা রহস্যময় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড. কামাল হোসেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড নিয়ে দেওয়া বক্তৃতায় অভিযোগ করেন, ‘জাতির জনক নিহত হওয়ার সময় তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন জার্মানিতে ছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর তিনি আমাকে বা আমার বোন শেখ রেহানাকে কোনো সহায়তা করেননি। এমনকি বারবার একটি সংবাদ সম্মেলন করার অনুরোধ জানালেও তিনি তাতে সাড়া দেননি।’

আওয়ামী লীগ ছেড়ে গণফোরাম: ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে করা একটি মন্তব্যের কারণে তার সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয় আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের সাথে। তিনি বলেছিলেন, ১৯৯১ সালের ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে‘। মুল নেতৃত্ব ওই নির্বাচনে ‘সুক্ষ্ন কারচুপির’ অভিযোগ তোলেন। এ সময় কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ছেড়ে গঠন করে গণতান্ত্রিক ফোরাম। ১৯৯৩ সালে দলের নাম থেকে ‘তান্ত্রিক’ শব্দ ফেলে দিয়ে গণফোরাম করেন।

ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গুণী ব্যক্তিদের একজন। যুবক বয়সেই একজন কৃতি আইনজীবী হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। মেধা ও যোগ্যতার কারণেই তিনি তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধুর নজর কাড়েন।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তিনি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে আইনমন্ত্রী হন। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সবশেষে পেট্রোলিয়াম ও খনিজ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ড. কামালের নেতৃত্বেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রথম সংবিধান রচিত হয়। ১৯৭২ সালে প্রণীত সেই সংবিধান এই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত দলিল।

এত যোগ্যতা ও মেধা থাকা সত্ত্বেও তিনি গণমানুষের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। বঙ্গন্ধুকে হত্যার পর দেশের রাজনীতিতে যে অন্ধকার নেমে আসে সেই অন্ধকারে আলোর পথ দেখাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

বিপন্ন আওয়ামী লীগকেও তিনি পুনর্গঠন করতে পারেননি। একসময় আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিভিন্ন দলছুট ‘হাঁটুভাঙ্গা‘ রাজনীতিকদের নিয়ে গঠন করেন গণফোরাম।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বিপরীতে গণফোরামের মাধ্যমে ড. কামাল হোসেন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তৃতীয় ধারা বা মূলধারা। কিন্তু না, কোনো ধারা সৃষ্টিতে তিনি শোচনীয় রকম ব্যর্থ হয়েছেন। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে নিয়ে তিনি নতুন রাজনৈতিক জোট করেছেন। এখানে কতটুকু সফল হবেন এটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে পুরো জাতি।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ২৪ অক্টোবর ২০১৮, ৫:০৮ অপরাহ্ণ ৫:০৮ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • ইসলাম

ইবনে সীরীনের মতে স্বপ্নে মা হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?

মা হারানোর স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী? স্বপ্নে একজন মাকে হারিয়ে যাওয়া এমন একটি দর্শনের মধ্যে রয়েছে…

২০ এপ্রিল ২০২৪, ২:৪১ অপরাহ্ণ
  • স্বাস্থ্য

ঘন ঘন প্রস্রাব প্রতিকারে হোমিও চিকিৎসা

ঘন ঘন প্রস্রাব হল স্বাভাবিকের চেয়ে অতি মাত্রায় প্রস্রাবের চাপ বা প্রস্রাব করা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক…

৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৮ অপরাহ্ণ
  • লাইফস্টাইল

তরমুজ খাওয়ার পর কোন ভুলে পেট ফুলে ওঠে?

বাজারে এখন তরমুজের ছড়াছড়ি। গ্রীষ্মকালীন এই ফল সবারই প্রিয়। বিশেষ করে রমজানে এই ফলের কদর…

৬ এপ্রিল ২০২৪, ২:১৮ অপরাহ্ণ