বিনোদন

বদর যুদ্ধ: ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ

ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা বদর যুদ্ধ। এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অসামান্য। যুদ্ধটি ছিল মুসলিমদের মক্কা বিজয়ের প্রথম পদক্ষেপ। এ ঘটনা থেকে ইসলামের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তিত হয়েছিল। মহান আল্লাহ সূরা আনফালে বদর যুদ্ধের বিজয়ের দিনকে ‘মুক্তির দিন’ নামে অভিহিত করেছেন। ইসলামের শত্রুরা ইসলামের আলো নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল।

সূরা সফে আল্লাহ বলেন- ‘ওরা আল্লাহর নূর ফুঁৎকার দিয়ে নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তার নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন। যদিও কাফেররা সেটা অপছন্দ করে।’ ইরাকের শাসনকর্তা কুফা নগরীর স্থপতি পারস্য বিজয়ী বীর সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) আশি বছর বয়সে মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, ‘বদরযুদ্ধে পরিহিত বর্ম আমাকে পরিয়ে দাও। এই বর্ম পরিহিত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবো বলে এতোদিন এ বর্ম সযত্নে তুলে রেখেছি।’

মদিনা থেকে মুসলিদের যাত্রা

যুদ্ধ সম্ভার ও রসদ পত্রের দৈন্য সত্ত্বেও দ্বিতীয় হিজরীর ১২ রমজান নবী করীম (সা:) আল্লাহর ওপর ভরসা করে মাত্র তিনশর মতো মুসলমান নিয়ে মদিনা থেকে যাত্রা করেন। তারা সোজা দক্ষিণ কোণে পা বাড়ালেন; কারণ কুরাইশদের বাহিনীটি ঐ দিক থেকে আসছিল। ১৬ রমজান তারা বদরের নিকটে পৌঁছলেন। এটি মদিনা থেকে কিঞ্চিত দিক ৮০মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম অবস্থিত একটি প্রান্তর ।

এখানে পৌঁছার পর জানা গেল যে, কুরাইশ বাহিনী প্রান্তরের অপর সীমান্তে এসে পৌঁছেছে। তাই হযরত(সা:) এর নির্দেশে এখানে ছাউনি ফেলা হলো।

কুরাইশদের বাহিনীটি অত্যন্ত জাঁকালো সাজ-সজ্জা সহকারে বের হয়েছিল। এদের দলে এক সহস্রাধিক সৈন্য ছিলো, সর্দার ছিলো প্রায় একশোর মতো। সৈন্যদের জন্যে রসদ-পত্রেরও খুব উত্তম আয়োজন ছিল। উতবা বিন রাবিয়া ছিল সিপাহসালার ।

বদরের কাছে কাছে পৌঁছে কুরাইশ সৈন্যরা জানতে পারলো যে, তাদের বাণিজ্য কাফেলা মুসলমানদের আয়ত্ত্বের বাইরে রয়েছে। এতে জাররাহ ও আদী গোত্রের প্রধানগণ বললো যে, এখন আর আমাদের যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আবু জাহেল তাতে সায় দিলেন না। ফলে জাররাহ ও আদী গোত্রের লোকেরা মক্কায় ফিরে গেল এবং বাকী সৈন্যরা সামনে অগ্রসর হলো।

যুদ্ধক্ষেত্রের যে অংশটি কুরাইশদের দখলে ছিল, উপযোগিতার দিক দিয়ে তা ছিল খুবই উত্তম তাদের জমিন ছিল অত্যন্তু মজবুত। পক্ষান্তরে মুসলমানরা যেখানে ছাউনি ফেলেছিল, তা ছিল লবণাক্ত ভূমি। সৈন্যদের পা তাতে দেবে যাচ্ছিল। অন্যান্য দিক দিয়েও তাদের অসুবিধা ছিল প্রচুর। এই পরিস্থিতিতে রাতভর সমস্ত সৈন্য বিশ্রাম গ্রহণ করলো; কিন্তু নবী করীম (সা:) সারারাত ইবাদাত-বন্দেগীতে মশগুল রইলেন।

১৭ রমজান ফজরের পর তিনি মুসলিম সৈন্যদের সামনে জিহাদ সম্পর্কে এক উদ্দীপনাময় ভাষণ দিলেন। অতঃপর যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে সৈন্যদের শ্রেণী বিন্যাস করা হলো। এ বছরই মুসলমানদের প্রতি রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, এই পয়লা রোজার মধ্যেই মুসলমানদের তিনগুন বেশি সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্তুত হতে হলো। কি কঠোর পরীক্ষা!

সে রাতে আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত স্বরুপ দুটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো। প্রথমত, মুসলিম সৈন্যগণ অত্যন্ত প্রশান্তি ও সুনিদ্রার ভেতর দিয়ে রাত যাপন করলো। প্রত্যুষে তারা সতেজ বল-বীর্য নিয়ে ঘুম থেকে জাগলো দ্বিতীয়ত, রাতে খুব বৃষ্টিপাত হলো। তার ফলে লবণাক্ত জমি শক্ত হয়ে গেলো। এবং মুসলমানদের পক্ষে ময়দান খুব উপযোগী হলো।

পক্ষান্তরে এই বৃষ্টির ফলে কুরাইশদের অধিকৃত অংশ কর্দমাক্ত হয়ে গেল এবং তাতে সৈন্যদের পা দেবে যেতে লাগলো। পরন্ত মুসলমানদের অধিকৃত অংশের নীচু ভূমিতে পানি জমে গেল এবং তাতে তাদের ওযু-গোসল ইত্যাদির প্রচুর সুযোগ হলো। এসব কারণে মুসলমানদের অন্তর থেকে ভয়-ভীতি ও শংকাবোধ দূর হয়ে গেল সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত মনে তারা শত্রু সৈন্যদের মুকাবেলার জন্যে প্রস্তত হলো।

ময়দানে যখন উভয় পক্ষের সৈন্যদল মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো, তখন এক অদ্ভূত দৃশ্যের অবতারণা হলো। একদিকে ছিল আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণকারী তার বন্দেগী ও আনুগত্য স্বীকারকারী মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান, যাদের কাছে সাধারণ যুদ্ধ সরঞ্জাম পর্যন্ত ছিল না।

অন্যদিকে ছিল অস্ত্র-শস্ত্র ও রসদ-পত্রে সুসজ্জিত এক সহস্রাধিক কাফির সৈন্য, যারা এসেছে তওহীদের আওয়াজকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে নবী কারীম (সা:) খোদার দরবারে হাত তুললেন এবং অতীব বিনয় নম্রতার সাথে বললেন, ‘হে খোদা, এই কুরাইশরা চরম ঔদ্ধত্য ও অহমিকা নিয়ে এসেছে তোমার রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে।

অতএব আমায় যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি তুমি দিয়েছিলে, এখন সে সাহায্য প্রেরণ করো। হে খোদা! আজ এই মুষ্টিমেয় দলটি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে দুনিয়ায় তোমার বন্দেগী করার আর কেউ থাকবে না।’

এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল মুহাজিরদেরকে। এদের প্রতিপক্ষ ছিল আপন ভাই, পুত্র এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজন। কারো বাপ, কারো চাচা, কারো মামা আর কারো ভাই ছিল তার তলোয়ারের লক্ষ্যবস্তু এবং নিজ হাতে তাদের হত্যা করতে হয়েছিল এইসব কলিজার টুকরাকে।

এই কঠিন পরীক্ষায় কেবল তারাই টিকে থাকতে পেরেছিল, যারা সাচ্চা দিলে আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা করেছিল- যে সব সম্পর্ক তিনি বজায় রাখতে বলেছেন, তারা শুধু তাই বজায় রাখবে আর যেগুলোকে তিনি ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন- তা যতোই প্রিয় হোক না কেন- তারা ছিন্ন করে ফেলবে।

কিন্তু সেই সঙ্গে আনসারদের পরীক্ষাও কোনো দিক দিয়ে সহজ ছিল না। এ যাবত আরবের কাফির এবং মক্কার মুশরিকদের চোখে তাদের ‘অপরাধ’ ছিল এটুকু যে, তারা তাদের দুশমন অর্থাৎ মুসলমানদের কে আশ্রয় দান করেছে। কিন্তু এবার তারা প্রকাশ্যভাবেই ইসলামের সমর্থনে কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে,

তারা তাদের জনপদটির (মদিনা) বিরুদ্ধে গোটা আরবদেরকেই দুশমন বানিয়ে নিয়েছে। অথচ মদিনার জনসংখ্যা তখন সাকুল্যে এক হাজারের বেশি ছিল না।

এতো বড় দুঃসাহস তারা এজন্যেই করতে পেরেছিল যে, তাদের হৃদয় আল্লাহর ও রাসূলের মুহাব্বত এবং আখিরাতের প্রতি অবিচল ঈমানে পরিপূর্ণ হয়েছিল। নতুবা আপন ধন-দৌলত স্ত্রী-পুত্র-পরিবারকে এভাবে সমগ্র আরব ভূমির শত্রুতার ন্যায় কঠিন বিপদের মুখে কে নিক্ষেপ করতে পারে?

কুরাইশদের পরাজয়

বস্তত ঈমানের এই স্তরে উন্নীত হবার পরই বান্দার জন্যে আল্লাহর সাহায্য অবতীর্ণ হয়ে থাকে। বদর যুদ্ধেও তাই আল্লাহ তাআলা এই সহায়-সম্বলহীন ৩১৩ জন মুসলমানকে সাহায্য দান করেন। এর ফলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এক সহস্রাধিক সুসজ্জিত সৈন্য অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো এবং তাদের সমস্ত শক্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেল।

এই যুদ্ধে কুরাইশ পক্ষের প্রায় ৭০ ব্যক্তি নিহত হলো এবং সমসংখ্যক লোক বন্দী হলো। নিহতদের মধ্যে তাদের বড় বড় নামজাদা সর্দারগণ প্রায় সবাই ছিল। এদের মধ্যে শায়বা, উতবা, আবু জাহেল, জামআহ, আস, উমাইয়া প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব নামজাদা সর্দারের মৃত্যুর ফলে কুরাইশদের মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙ্গে পড়লো। মুসলমানদের পক্ষে প্রায় ৬ জন মুহাজির এবং ৮ জন আনসার শহীদ হলেন।

যুদ্ধে যারা বন্দী হলো, তাদেরকে দু’-দু’ চার জন করে সাহাবীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হলো এবং নবী করীম (সা:) তাদেরকে সদাচরণ করার নির্দেশ দান করলেন। ফলে সাহাবীগণ তাদেরকে এমনি আরামে রাখলেন যে,

বহু ক্ষেত্রে তারা নিজেরা কষ্ট স্বীকার করলেও বন্দীদের কষ্ট দেন নি। এই সদাচরণের ফলে তাদের হৃদয়ে ইসলামের জন্যে অনেক নম্রতার সৃষ্টি হলো। আর এটাই ছিল আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। পরে এসব বন্দীর অনেকেই ফিদির (মুক্তিপণ) বিনিময়ে মুক্তি লাভ করে। যারা গরীব অথচ শিক্ষিত ছিল, তাদের দশ-দশটি শিশুকে লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়।

বদর যুদ্ধের ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া

ফলাফল ও প্রতিক্রিয়ার দিক দিয়ে বদর যুদ্ধ ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের দাওয়াত অগ্রাহ্য করার দরুন মক্কার কাফেরদের জন্যে যে খোদায়ী আজাব নির্ধারিত হয়েছিল, এ যুদ্ধ ছিল তারই প্রথম নিদর্শন। তাছাড়া ইসলাম ও কুফরের মধ্যে মূলত কার টিকে থাকবার অধিকার রয়েছে এবং ভবিষ্যতের হাওয়ার গতিই বা কোন দিকে মোড় নেবে, এ যুদ্ধ তা স্পষ্ট জানিয়ে দিল।

এ কারণেই একে ইসলামী ইতিহাসের পয়লা যুদ্ধ বলা হয়। কুরআন পাকের সূরা আনফালে এই যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক বিস্তৃত পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ বা জেনারেলগণ কোন যুদ্ধ জয়ের পর যে ধরনের পর্যালোচনা করে থাকে, এ পর্যালোচনা তা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

এ পর্যালোচনার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এর ওপর একটু বিস্তৃতভাবে দৃষ্টিপাত করলে ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃতি এবং মুসলমানদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অত্যন্ত সুস্পষ্ট উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।

বদর যুদ্ধের পর্যালোচনা এবং মুসলমানদের প্রশিক্ষণ

১. পূর্বেই বলা হয়েছে, ইসলামের আগে যুদ্ধ ছিল আরবদের একটি প্রিয় ‘শখ’। যুদ্ধে যে মাল-পত্র (গনিমত) হস্তগত হতো, তার প্রতি ছিল তাদের দুর্নিবার মোহ। এমনকি কখনো কখনো ঐ মাল-পত্রের আকর্ষণই তাদের যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতো। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল ধন-সম্পদের চেয়ে অনেক উন্নত সে উদ্দেশ্যকে মুসলমানদের হৃদয়-মূলে বদ্ধমূল করে নেয়া অতীব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

এ দিক দিয়ে বদর যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্যে একটি পরীক্ষামূলক যুদ্ধ। মুসলমানদের হৃদয়-মূলে ইসলামী যুদ্ধের নিয়ম-নীতি ও নৈতিক আদর্শ পুরোপুরি বদ্ধমূল হয়েছে, না অনৈসলামী যুদ্ধের ধ্যান-ধারণা তাদের হৃদয়ে এখনো প্রভাব বিস্তার করে আছে, এই যুদ্ধ ছিল তারই পরীক্ষামাত্র।

বদর যুদ্ধে কাফিরদের মালমাত্তা যাদের হস্তগত হয়েছিল, তারা পুরনো রীতি অনুযায়ী তাকে তাদের আপন সম্পত্তি বলেই মনে করে বসলো। ফলে যারা কাফিরদের পেছনে ধাওয়া করা কিংবা হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর নিরাপত্তার কাজে ব্যস্ত ছিল, তারা কিছুই পেল না।

এভাবে তাদের পরস্পরের মধ্যে কিছুটা তিক্ততার সৃষ্টি হলো। ইসলামী আন্দোলনের ধারক ও বাহকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার এটাই ছিল উপযুক্ত সময়। তাই সর্বপ্রথম তাদেরকে স্পষ্টভাবে বলা হলো যে, গনীমতের মাল প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের কোন পারিশ্রমিক নয়। এ হচ্ছে আপন পারিশ্রমিকের বাইরে মালিকের তরফ থেকে দেয়া একটি বাড়তি অবদান বা পুরস্কার বিশেষ (আনফাল)।

আল্লাহর পথে যুদ্ধ করার যথার্থ প্রতিদান তো তিনি আখেরাতেই দান করবেন। এখানে যা কিছু পাওয়া যায়, তা কারো ব্যক্তিগত স্বত্ত্ব (হক) নয়, তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার একটি বাড়তি অবদান মাত্র।

কাজেই এই অবদান সম্পর্কে কারোর স্বত্ত্বাধিকার দাবির প্রশ্নই উঠে না। এর স্বত্ত্বাধিকার হচ্ছে আল্লাহ এবং তার রাসূলের। তারা যেভাবে চান, সেভাবেই এর বিলি-বণ্টন করা হবে। এরপর সামনে অগ্রসর হয়ে এই বিলি-বণ্টনের নীতিমালাও বাতলে দেয়া হলো। এভাবে যুদ্ধ সংক্রান্ত এক বিরাট প্রশ্নের নিষ্পত্তি করা হলো।

মুসলমানদের চূড়ান্তভাবে বলে দেয়া হলো যে, তারা দুনিয়ার ফায়দা হাসিলের জন্যে কখনো অস্ত্র ধারণ করতে পারে না, বরং দুনিয়ার নৈতিক বিকৃতিকে সংশোধন করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে গায়রুল্লাহর গোলামী থেকে মুক্ত করার অপরিহার্য প্রয়োজনেই তাদের শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।

তারা যখন দেখবে যে, বিরুদ্ধ শক্তি তাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে শক্তি প্রয়োগ করতে উদ্যত হয়েছে এবং দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে সংশোধন প্রচেষ্টাকে অসম্ভব করে তুলেছে, ঠিক তখনি এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে কাজেই তারা যে সংস্কার সংকল্প নিয়েছে, তাদের দৃষ্টি শুধু সেদিকেই নিবদ্ধ থাকা উচিত এবং এই লক্ষ্য অর্জনের পথে কোনরূপ অন্তরায় হতে পারে, এমন কোন পার্থিব স্বার্থের দিকেই তাদের ফিরে তাকানো উচিত নয়।

২. ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় আমীর বা নেতার আনুগত্য হচ্ছে দেহের ভেতর রুহের সমতুল্য। তাই নেতৃত আদর্শের পরিপূর্ণ ও নির্ভেজাল আনুগত্যের জন্যে মনকে প্রস্তুত করার নিমিত্ত বারবার মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো।

আলোচ্য যুদ্ধের গনীমতের মাল সম্পর্কেও তাই সর্বপ্রথম লোকদের কাছে পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের দাবি জানানো হলো এবং তাদেরকে বলে দেয়া হলো যে,এসব কিছুই আল্লাহ এবং তার রাসূলের স্বত্ত্বা। এ ব্যাপারে তারা যা ফয়সালা করেন, তাতেই সবার রাজি থাকতে হবে।

৩. সাধারণ আন্দোলনগুলোর প্রকৃতি এই যে, সেগুলো আপন কর্মী ও অনুবর্তীদের মনে উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্যে তাদের কৃতিত্বের কথা নানাভাবে উল্লেখ করে থাকে। এভাবে খ্যাতি-যশ লাভের আকাঙ্ক্ষাকে উস্কিয়ে দিয়ে লোকদের ত্যাগ তিতিক্ষার জন্যে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

বস্তত এ কারণেই বড় বড় যুদ্ধ বা বিজয় অভিযানের পর এইসব আন্দোলন তার আত্মোৎসর্গী কর্মীদের মধ্যে বড়ো বড়ো খেতাব পদক ইত্যাদি বিতরণ এবং নানাভাবে তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করে থাকে।

ফলে একদিকে তারা আপন কৃতিত্বের বদলা পেয়ে সন্তোষ লাভ করে এবং ভবিষ্যতে আরো অধিক ত্যাগ স্বীকারের জন্যে উদ্বুদ্ধ হয়, অন্যদিকে অপর লোকদের মনেও তাদেরই মতো উন্নত মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়।

কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মাত্র ৩১৩ জন মুসলিম সৈন্য কর্তৃক এক সহস্রাধিক কাফের সৈন্যকে পরাজিত করা এবং এক প্রকার বিনা সাজ-সরঞ্জামে কয়েকগুণ বেশি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে নির্মূল করা সত্ত্বেও তাদের কে বলে দেয়া হলোঃ তারা যেন এ ঘটনাকে নিজেদের বাহাদুরি বা কৃতিত্ব বলে মনে না করে। কারণ তাদের এ বিজয় শুধু আল্লাহর করুণা ও অনুগ্রহ মাত্র।

কেবল তারই দয়া এবং করুণার ফলে এতো বড়ো শত্রু বাহিনীকে তারা পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই তাদের কখনো আপন শক্তি-সামর্থের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়; বরং সর্বদা আল্লাহর ওপর ভরসা করা এবং তারই করুণা ও অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে ময়দানে অবতরণ করার ভেতরে নিহিত রয়েছে তাদের আসল শক্তি।

যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে হযরত (সা:) এক মুঠো বালু হাতে নিয়ে ‘শাহাদাতুল ওজুহ’ (চেহারা আচ্ছন্ন হয়ে যাক) বলে কাফিরদের দিকে ছুঁড়ে মারেন।

এরপরই মুসলমান সেনারা একযোগে কাফিরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের কে ধরাশয়ী করে। অন্য লোক হলে এই ঘটনাকে নিজের ‘কেরামত’ বা অলৌকিক কীর্তি বলে ইচ্ছামত গর্ব করতে পারতো এবং একে ভিত্তি করে তার অনুগামীরা ও নানারুপ কিস্‌সা-কাহিনীর সৃষ্টি করতো।

কিন্তু কুরআন পাকে খোদ আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে বলে দিলেনঃ ‘তাদেরকে (কাফিরদেরকে ) তোমরা হত্যা করো নি, বরং তাদের হত্যা করেছেন আল্লাহ। ’ এমনকি তিনি হজরত (সা:)-কে পর্যন্ত বলে দিলেন যে, ‘(বালু) তুমি ছোড়োনি, বরং ছুঁড়েছেন আল্লাহ এবং মুমিনদের একটি উত্তম পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ করা হয়েছে।’

(সূরা আনফাল- আয়াতঃ ১৮)। এভাবে মুসলমানদের বলে দেয়া হলো, প্রকৃত পক্ষে সমস্ত কাজের চাবিকাঠি রয়েছে আল্লাহর হাতে এবং যা কিছু ঘটে তার নির্দেশ ও ইচ্ছানুক্রমেই ঘটে থাকে।

মুমিনদের কাজ হচ্ছে আল্লাহর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য করা এর ভেতরই নিহিত রয়েছে তাদের জন্যে সাফল্য।

৪. ইসলামী আন্দোলনে জিহাদ হচ্ছে চূড়ান্ত পরীক্ষা, যার মাধ্যমে আন্দোলনের অনুবর্তীদের পূর্ণ যাচাই হয়ে যায়। যখন কুফর ও ইসলামের দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয় এবং মুমিনদের পক্ষে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ অব্যাহত রাখার জন্যে ময়দানে অবতরণ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না, তখন সেখান থেকে তাদের পশ্চাদপসরণ করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ৩ জুন ২০১৮, ৫:২৩ অপরাহ্ণ ৫:২৩ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • ইসলাম

ইবনে সীরীনের মতে স্বপ্নে মা হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?

মা হারানোর স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী? স্বপ্নে একজন মাকে হারিয়ে যাওয়া এমন একটি দর্শনের মধ্যে রয়েছে…

২০ এপ্রিল ২০২৪, ২:৪১ অপরাহ্ণ
  • স্বাস্থ্য

ঘন ঘন প্রস্রাব প্রতিকারে হোমিও চিকিৎসা

ঘন ঘন প্রস্রাব হল স্বাভাবিকের চেয়ে অতি মাত্রায় প্রস্রাবের চাপ বা প্রস্রাব করা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক…

৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৮ অপরাহ্ণ
  • লাইফস্টাইল

তরমুজ খাওয়ার পর কোন ভুলে পেট ফুলে ওঠে?

বাজারে এখন তরমুজের ছড়াছড়ি। গ্রীষ্মকালীন এই ফল সবারই প্রিয়। বিশেষ করে রমজানে এই ফলের কদর…

৬ এপ্রিল ২০২৪, ২:১৮ অপরাহ্ণ