আবহাওয়া

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে জানতে পারলাম আমার ছোট বোন রিক্তা………

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে জানতে পারলাম আমার ছোট বোন রিক্তা কলেজ থেকে এখনো বাসায় ফিরেনি। বাবা-মা সব জায়গা থেকে ইতিমধ্যে খোঁজ নিয়ে নিয়েছেন। সে কোথাও যায়নি। আমি রিক্তার ঘনিষ্ঠ বান্ধুবীদের একে একে সবার কাছে ফোন দিলাম।

সবাই একই কথা বললো- “রিক্তাকে ছুটি শেষে কলেজ থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতে দেখেছি।”অথচ রিক্তা বাসায়ই আসেনি।আমি বাসা থেকে বের হয়ে রিক্তার কলেজ যাবার পথ ধরে হাটতে লাগলাম। পথে পরিচিত যাকে দেখি,যার কাছে খোঁজ নেওয়ার মতো তাকেই জিজ্ঞেস করি।

খোঁজ নেওয়ার মতো বলতে- একটা মেয়ে মানুষ যে কিনা আমার বোন তাকে খোঁজে পাচ্ছিনা,এটা নিয়ে কথা বলতেও চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে হয়। কখন যে কলংকের দাগ পড়ে যায়! কুৎসা রটে যায় তার ইয়াত্তা নেই!নাহ, কেউ বলেনি “রিক্তাকে দেখেছি”।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে,আকাশে চাদটা জোছনা ছড়াচ্ছে ছড়াচ্ছে ভাব। কলেজের গেইটে দাঁড়ানো নাইটগার্ডকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর অনুমতি নিয়ে পুরো কলেজের ফাঁকাফাঁকা কক্ষগুলো খোঁজ করলাম।

না, কোথাও নেই।কলেজ থেকে এসে বাজারের পাশাপাশি একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যার পর এই দোকানে চায়ের ফাকে “রাজনৈতিক আড্ডা জমে ক্ষীর হয়”। দাঁড়িয়ে আছি, কোন রকম খোঁজখবর পাওয়া যায় কিনা তাই।

কারন হচ্ছে, এই চায়ের টঙ দোকানে কার ঘরে কতগুলা বাচ্চা আছে, কোন ঘরে কার স্ত্রী পোয়াতি,কে বউ পিটায়, কার ঘরে কতগুলো মেয়ে আছে, কে কে সুন্দর, কে কে বিয়ের উপযোগী হয়েছে,কার বউটা পরকীয়া করে বা করা যাবে-এমন সব ধরনের আলাপ আলোচনা হয়।

খানিকবাদেই হোসেন কাকা চিল্লাতে চিল্লাতে দৌড়ে এ দোকানের সামনে এসে বললেন- “ব্রীজের নীচে মেয়েলী কন্ঠের গুংগানোর শব্দ শুনেছে।” শুনে আমি এক দৌড়ে ব্রীজের নিচে গেলাম। নদীটার এপাড় থেকে ওপাড়ে যাওয়ার জন্য ক’মাস আগে ব্রীজটা করা হয়েছে। ফাল্গুন চৈত্র মাসের সময় তখন,অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুম-তাই পানি শুকিয়ে নদীর তলানি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।

আমি পাড় থেকে নামতে লাগলাম। নামতেই দেখলাম আমার বোন রিক্তার কলেজ ব্যাগ পড়ে আছে। আমি দ্রুত ব্রীজের নীচের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি পৌঁছতেই ব্যাথায় কাতরানোর শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দ শুনেই নিশ্চিত হলাম এটা আমার বোন, রিক্তা।

ব্রীজ বরাবর নীচটায় অন্ধকার, রিক্তাকে টেনে ব্রীজ থেকে একটু এদিকে আনতেই আমার দু’চোখ বেয়ে নিঃশব্দে পানি ঝরতে লাগলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না।রিক্তাকে মাটিয়ে শুইয়ে দিয়ে ব্রীজের নীচ থেকে রিক্তার গায়ের কাপড় খোঁজে এনে দ্রুত গা ঢাকলাম। হাত-পা বাধা রিক্তার হাত-পা ছাড়ালাম। পুরো গায়ে সিগেরেটের ছ্যাকার দাগ।

হাত-পা সহ মুখমন্ডলে মনে হচ্ছে হায়েনারা কামড়েছে। আর রিক্তার ভাই হয়ে আমাকে তা দেখতে হচ্ছে। আহা জীবন, ধর্ষকদের মাধ্যমে একটা ভাইয়ের দুহাতে তার ধর্ষিতা বোনের মুমূর্ষু দেহ তুলে দিয়েছে।

কি করবো বুঝতেছিনা। আগে বোনকে বাচাতে হবে,পরে মামলা মোকদ্দমা। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার জানালো “রেপড পেশেন্ট, আগে থানা থেকে মামলার কাগজ আনতে হবে। পরে চিকিৎসা হবে।” আমি ডাক্তারের হাতেপায়ে ধরে বুঝাতে চেষ্টা করলাম-“জীবনের চেয়ে দামী কিছু নেই।” ডাক্তার আমার কথায় কোন কর্ণপাত করলেন না।
রিক্তার মুমূর্ষু দেহ নিয়েই ছুটে গেলাম থানাতে।

পুলিশ সুপারের এক কথা – “রেপড কেইস, আগে মেডিকেল রিপোর্ট লাগবে।পরে মামলা নেয়া হবে। এর আগে না।”আমার মনে হচ্ছিলো, মাটিটা কিছুক্ষনের জন্য দু’ভাগ হয়ে সরে যাক। দু’ভাই বোন এই বাংলার জমিনের উপর থাকতে চাই না। এমন দুটানায় পড়েছি, কি করা উচিত,কি করবো বুঝতে পারছিনা।

লাল সবুজের দেশ, স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে একটা ধর্ষিতা রিক্তার ভাই থানা আর হাসপাতালের মাঝখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাসপাতাল আর থানা বাদ দিয়ে রিক্তাকে বাসায় এনে ঘরোয়া চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ফার্মেসি থেকে বিভিন্নভাবে বলেকয়ে ঔষধ আনা হচ্ছে। রিক্তা কিছুটা সুস্থ হয়েছে।

তবে ভয়ংকর সেই ঘটনাটা তার চোখে দৃশ্যপট হয়ে ভাসছে। যার জন্য তার মুখে কোন শব্দ নেই। কখনো কখনো দেখা যায় বিছানার এক কোনে বালি কোলে চেপে বসে আছে। আবার কখনো দেখা যায় ফ্লোরের একদম এক কোনা ঘেঁষে হাটুভেংগে দু’হাতে পেঁচিয়ে বসে থাকে।

ভয়ার্ততার ছাপ চোখেমুখে। কারো সাথে কথা বলে না। না করে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না আছে চোখে ঘুম।রিক্তার এমন জীবনযাপন ধেকে মনে হচ্ছে সে পুরোপুরিভাবে একটা জিন্দালাশ হয়ে হয়ে। এর চেয়ে মরন ভালো। পাড়াপড়শি বাসায় এসে “একটা রেপড গার্ল”কে দেখে যায়। আমার কানে অদ্ভুত একটা ধ্বনি ভেসে আসে “রিক্তার আর বিয়ে হবে না”।

আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না, সপ্তাহখানেক বাদে একদিন গভীর রাতে রিক্তার রুমে গেলাম। রিক্তার কপাল ছুতেই লাফিয়ে উঠলো।

রিক্তাকে বললাম, “স্বর্গে যাবি?” বোনটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার দু’চোখ থেকে পানি বের হতে হতে রিক্তার হাত আমার চোখের জলকে মুঠোপুর্তি করে নিলো। আমি আর সময় নেইনি, শিয়রের কাছ থেকে শিমুল চুলার বালিশটা জোরে চেপে ধরলাম রিক্তার নাকেমুখে। জিন্দালাশ বোনটাকে লাশ করতে করতে বেশিক্ষণ সময় লাগেনি।

আমার চোখদুটো বন্ধ করে রিক্তার মুখে বালিশচাপা দিয়েছিলাম। যখন বুঝলাম রিক্তার হাত-পা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে তখন বালিশ সরালাম। নিজের চোখ খুলে রিক্তার মুখের দিকে তাকালাম। চোখদুটো খোলা, আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষায় এটা হয়তো বুঝাচ্ছে- “ভাইয়া, মরে গিয়ে বেচে গেলাম।”

পরের দিন থানাতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করলাম। মামলা হলো- “ভাইয়ের হাতে বোন খুন।” রাষ্ট্রপক্ষের উকিল মহামান্য আদালত থেকে “ভাইয়ের হাতে বোন হত্যায় কেউ জড়িত আছে কিনা সন্দেহে” তিন দিনের রিমান্ড নিলেন।রিমান্ডে যতোবার জিজ্ঞাসা করলো- “বল,আর কে কে এই হত্যাকান্ডে জড়িত?”

পুরো তিনদিনের রিমান্ডে আমার উত্তর একটাই ছিলো- “এই হত্যা কান্ডে বাংলাদেশ জড়িত।”রিমান্ড শেষে আদালতে উঠানো হলো। জজসাহেব হত্যা মামলায় পাষন্ড একটা ভাইকে “৩০২” ও “৩০৪” ধারায় “মৃত্যু নিশ্চিয় না হওয়া পর্যন্ত ফাসির কাষ্ঠে ঝুলোনো হোক” বলে নির্দেশ দিলো।আমার কাছ থেকে জানতে চাইলো- মৃত্যু পূর্বে আপনার শেষ ইচ্ছা কি?

আমি বললাম, একজন ভাই তার বোনকে হত্যা করেছে, নিঃসন্দেহে এর চেয়ে ঘৃণিত কাজ আর নেই। তাই আমি চাই আমাকে খোলা ময়দানে সবার সামনে ফাসিতে ঝুলানো হোক।

যেন এমন ঘৃণিত, নৃশংস কাজ কোন ভাই তার বোনের সাথে করতে না পারে। খোলা ময়দানে ফাসির মঞ্চ তৈরি করা হলো। হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছে, যেন তারা পায়ে পিষ্ট করে মারতে চায়! আমাকে বিশেষ নিরাপত্তায় মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে গেলো। ফাসির অপেক্ষায় আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি।

একজন উকিল একহাতে ঘড়ি আর অন্য হাতে কালো রোমাল নিয়ে আছে। সময় হলে রোমাল হাত থেকে ছেড়ে দিবে একই সাথে আমাকে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য একজন ডাক্তারও আছে।

হাজারো বোনের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার ভাই।কালো মুখোশ হাতে নিয়ে জল্লাদ দাঁড়িয়ে আছে,একটু পরেই আমার মাথায় পড়িয়ে দিবে।

আমি জল্লাদকে বললাম, আমার হাতের বাঁধন কি খুলে দেয়া যায়? উকিল “হ্যা” ইশারা দিলো।আমি তর্জনী আংগুল উঁচিয়ে বললাম”হে প্রিয়ের অপ্রিয় বাংলাদেশ, আমার বোনকে গ্যাংরেপ করা হয়েছিলো। হাত-পা বেধে ৩/৪ জন বেজন্মা শকুনের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বোনের ভয়ার্ত মুখ কেমন দেখায় বলতে পারেন?”

বোনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ভাইয়েরা, এন্সার প্লিজ?পুলিশ রিপোর্ট ছাড়া চিকিৎসা হবে না, আবার মেডিকেল রিপোর্ট ছাড়া মামলা নেয়া যাবে না। এই বাংলাদেশ, ধিক্কার জানাই!

এই বোনেরা,ভাইয়েরা, উকিল, জজ, জল্লাদেরা-রেপড একটা বোনের ঘরকুনো হওয়ার ব্যাথা উপলব্ধি কেমন হয় জানেন?স্বাধীন বাংলার মাটিতে বেচে থেকে যে বোন বারবার মরে যায়, সে বোনের বেচে থেকে কি লাভ? এ কেমন স্বাধীনতা!

আমি তাকিয়ে দেখি পুরো বাংলাদেশ নির্বাক! ডানে ঘুরে দেখি পাষণ্ড জল্লাদ ভেজা চোখে নিজেই নিজের গলা টিপে আত্মাহুতি দিচ্ছে। উকিল কালো রোমাল ফেলে মাটিতে পড়ে আছে। সামনে তাকিয়ে দেখি সকল ভাই তাদের বোনদের গলা টিপে মেরে ফেলেছে।

আমি চোখ দুটো বড় করে দেখি “একটি বেওয়ারিশ বাংলাদেশের লাশ” আমার সামনে পড়ে আছে।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, তখনো আমি ঘুমে বিভোর। মায়ের হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘুম ভাঙলো। আমি কি তাহলে স্বপ্ন দেখলাম!

পাশে তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে ভয় আর দুশ্চিন্তার ছাপ। চোখ কচলাতে কচলাতে আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? মা কাঁদতে কাঁদতে বললো, “তোর বোন রিক্তা এখনো কলেজ থেকে বাসায় ফিরেনি…”

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ৭ জুলাই ২০১৮, ১১:৩৪ অপরাহ্ণ ১১:৩৪ অপরাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • ইসলাম

ইবনে সীরীনের মতে স্বপ্নে মা হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?

মা হারানোর স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী? স্বপ্নে একজন মাকে হারিয়ে যাওয়া এমন একটি দর্শনের মধ্যে রয়েছে…

২০ এপ্রিল ২০২৪, ২:৪১ অপরাহ্ণ
  • স্বাস্থ্য

ঘন ঘন প্রস্রাব প্রতিকারে হোমিও চিকিৎসা

ঘন ঘন প্রস্রাব হল স্বাভাবিকের চেয়ে অতি মাত্রায় প্রস্রাবের চাপ বা প্রস্রাব করা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক…

৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৮ অপরাহ্ণ
  • লাইফস্টাইল

তরমুজ খাওয়ার পর কোন ভুলে পেট ফুলে ওঠে?

বাজারে এখন তরমুজের ছড়াছড়ি। গ্রীষ্মকালীন এই ফল সবারই প্রিয়। বিশেষ করে রমজানে এই ফলের কদর…

৬ এপ্রিল ২০২৪, ২:১৮ অপরাহ্ণ