আবহাওয়া

হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে খুন, একটার রেশ না কাটতেই ঘটছে আরেকটি!

হঠাৎ করেই রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়ে গেছে খুনখারাবির ঘটনা। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধ দেখা দিলেই বেছে নেয়া হচ্ছে খুনের মতো নৃশংস সিদ্ধান্ত। পারিবারিক কলহে স্বামীর হাতে স্ত্রী, বাবার হাতে ছেলে, ছেলের হাতে মা খুন হচ্ছে। বাড়ছে জমিজমার বিরোধ ও রাজনৈতিক কারণে খুনের ঘটনাও। সময়ের সঙ্গে বদলেছে খুনের ধরনও।

কেবল ঢাকাতেই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৭০টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে।এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১৩টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৬টি, মার্চে ২৩টি, এপ্রিলে ১৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর দেশজুড়ে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খুন হয়েছে ৮৭৪ জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ২৯১ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫৬ জন এবং মার্চ মাসে খুনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২৭ জনে।

আর ২০১৭ সালে মোট হত্যাকান্ডের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৫৪৯। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাবেই প্রতিদিন অন্তত ১০ জন করে মানুষ খুন হচ্ছে। খুন হওয়াদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। গত কয়েক বছরে খুনের ঘটনা কমে এলেও হঠাৎ করেই খুনের ঘটনা বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও।

গত একসপ্তাহে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যার ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে বেড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠ। পার্বত্য অঞ্চলে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ছয় ব্যক্তিকে।

বগুড়ায় ধানক্ষেত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে চারজনের লাশ। রাজধানীর দারুসসালামে শাহানা আলম খান বিউটি নামে এক নারীর হাত-পা বাঁধা ও মুখে স্কচটেপ পেঁচানো মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। বাড্ডায় প্রকাশ্যে ডিশব্যবসায়ী গুলি করে হত্যা করা হয়।

হঠাৎ খুনখারাবির ঘটনার বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যখ্যা করে, অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন সামাজিক অবক্ষয়, ইন্টারনেটের ভয়াবহতা, মাদকের ভয়াল বিস্তার, পারিবারিক সম্পর্কে ঘাটতির কারণে এসব ঘটনা বাড়ছে।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে বন্ধ হচ্ছে না অপরাধ। এ ছাড়া বরাবরই নির্বাচনকালীন বছরে দেশে অন্যরকম এক অস্থিরতা বিরাজ করে। তাই নির্বাচনের বছর এলে অপরাধীরা বেশি তৎপর হয়ে ওঠে।

গত ৪ মে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন জেএসএসের (এমএন লারমা) সহসভাপতি ও নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা।

প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। দুর্বৃত্তদের গুলিতে মোটরসাইকেল চালক সংগঠনের নানিয়ারচর উপজেলা সাংগঠনিক সম্পাদক রূপম চাকমাও গুরুতর আহত হন।

এই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মাথায় ৫ মে গুলিতে পাঁচজন নিহত ও ৯ জন আহত হন। শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে খাগড়াছড়ির বেতছড়ি এলাকায় গাড়িবহরে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।

সেখানে নিহত হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা, দলের নেতা সুজন চাকমা, প্রণব চাকমা, সেতু চাকমা ও তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালক মো: সজীব। পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়ই এভাবে খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে লাশ উদ্ধারের ঘটনাও ঘটছে।

গত ৪ মে নরসিংদীর রায়পুরার বাঁশগাড়ীতে প্রকাশ্যে ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল হককে (৭৫) কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। উপজেলার আলীনগর আড়াকান্দায় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

সিরাজুল হক বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টানা সাতবার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, এই এলাকায় প্রতিপক্ষ দু’টি গ্রুপ রয়েছে। যারা বছরের পর বছর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত। তাদের এই কোন্দলে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন।

গত ৫ মে রাজধানীর দারুস সালাম থানার লালকুঠির এক বাসা থেকে শাহানা আলম খান বিউটি (৪৫) নামের এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় লাশটি পাওয়া যায়। বিউটির স্বামী কামাল হোসেন পুলিশের একজন এএসআই।

বগুড়ার শিবগঞ্জের বাদলাদিঘি গ্রামের একটি ধানক্ষেত থেকে গত ৭ মে চার যুবকের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। সকালে লাশগুলো পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ লাশগুলো উদ্ধার করে।

কে বা কারা তাদেরকে গলা কেটে হত্যার পর লাশগুলো ওই ক্ষেতের মধ্যে ফেলে রেখে যায়। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, এই ঘটনার পর ওই এলাকার মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকার মানুষ অতীতে কোনো দিন এমন ভয়ানক খুনের ঘটনা দেখেনি।

এ দিকে ৬ মে রাতে ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলি এলাকায় একই ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ফারুক হাসান ও সাজিয়া বেগম নামের এক কলেজশিক্ষিকার লাশ।

পুলিশ সূত্র বলেছে, ফারুকের লাশ পাওয়া যায় ঝুলন্ত অবস্থায়। আর সাজিয়ার ক্ষতবিক্ষত লাশটি পড়েছিল ঘরের মেঝেতে। ফারুকের লাশটি ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেলেও তার শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়।

গত সোমবার রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন জাকির হোসেন (২৫) নামের এক যুবক। কয়েক মাস আগেও এই যুবককে স্থানীয় কিছু বখাটে কুপিয়েছিল।

সে যাত্রা বেঁচে গেলেও এবার দুবর্ৃৃত্তদের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি জাকির। সম্প্রতি রাজধানীর বাড্ডার বেরাইদ এলাকায় খুন হন সেখানকার ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের ভাই দুখু। এই ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও গত দুই সপ্তাহে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

গত ৯ মে বা্ড্ডায় জাগরণী ক্লাবের ভেতর ঢুকে সস্ত্রাসীরা ডিশ ব্যবসায়ী বাবুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে গত ২২ এপ্রিল বাড্ডার বেরাইদ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের জাহাঙ্গীর আলমের ছোটভাই কামরুজ্জামান দুখুকে প্রতিপক্ষ গুলি করে হত্যা করে।

একের পর এক সংগঠিত এসব খুনের ব্যাপারে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের কারণেই বেশির ভাগ খুনের ঘটনা ঘটছে। সেসব ঘটনায় মামলা দায়ের হচ্ছে এবং অপরাধীরা ধরাও পড়ছে।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের বছর হওয়াতে চলতি বছর অপরাধপ্রবণতা অনেক বেড়েছে। সময় যত যাবে অপরাধ আরো বাড়বে। কারণ এ সময় ঝিমিয়ে পড়া সন্ত্রাসী ও অপরাধীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সজাগ হয়।

কারণ নেতারা তাদের প্রয়োজনে পেশিশক্তি প্রদর্শণে অপরাধীদের ব্যবহার করান। নির্বাচনকালীন সময়ে আধিপত্য বিস্তারের একটা বিষয় থাকে। এ সময় জেলে থাকা অপরাধীদের জামিনে বের করা হয়।

সূত্র জানিয়েছে, দেশে এখন মাদকের ভয়াবহতা খুব বেড়েছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। আর এখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষই মাদকের সঙ্গে জড়িত।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, বর্তমান সময়ের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণেই এসব ঘটনা গঠছে।

রাজনৈতিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় গণতান্ত্রিক চর্চাটা খুব কম হচ্ছে। এর কারণে সব দলের মধ্যে একটা পাওয়া না পাওয়ার প্রবণতা রয়ে যায়। কে কার চেয়ে বেশি পেতে হবে। আমি কেন কম পেলাম।

এ ধরনের কিছু বিষয় থেকে একটা রাজনৈতিক ক্ষোভ তৈরি হয়। আর এই ক্ষোভ থেকেই অপ্রীতিকর ঘটনা। এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, রাজনৈতিক ক্ষোভটা এতটা পৈশাচিক হচ্ছে খুনের পর মরদেহের উপরও সেই ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বিকৃত করার পাশাপাশি অনেক সময় খণ্ডিত করা হয় মরদেহ। এর বাইরে সামাজিক কারণে ঘটে যাওয়া ঘটনারও কমতি নেই।

সম্পত্তির জের, পরকীয়া, কলহ থেকে সামাজিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর কারণ হলো আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার দায়দায়িত্ব থেকে অনেক দূরে আছে। একটা সামাজিক বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে যা দরকার সেটা তারা করছে না।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ১২ মে ২০১৮, ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • ইসলাম

ইবনে সীরীনের মতে স্বপ্নে মা হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?

মা হারানোর স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী? স্বপ্নে একজন মাকে হারিয়ে যাওয়া এমন একটি দর্শনের মধ্যে রয়েছে…

২০ এপ্রিল ২০২৪, ২:৪১ অপরাহ্ণ
  • স্বাস্থ্য

ঘন ঘন প্রস্রাব প্রতিকারে হোমিও চিকিৎসা

ঘন ঘন প্রস্রাব হল স্বাভাবিকের চেয়ে অতি মাত্রায় প্রস্রাবের চাপ বা প্রস্রাব করা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক…

৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৮ অপরাহ্ণ
  • লাইফস্টাইল

তরমুজ খাওয়ার পর কোন ভুলে পেট ফুলে ওঠে?

বাজারে এখন তরমুজের ছড়াছড়ি। গ্রীষ্মকালীন এই ফল সবারই প্রিয়। বিশেষ করে রমজানে এই ফলের কদর…

৬ এপ্রিল ২০২৪, ২:১৮ অপরাহ্ণ