ভারত

একজন সফল রাস্ট্রনায়ক মালেশিয়ার মাহাথির মুহম্মদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের চট্রগ্রামের!

মাহাথির মুহম্মদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের এক বক্তব্যে বলেছিলেনঃ “চট্টগ্রামের কাপ্তাই রাঙ্গুনিয়ার কোন একটি গ্রামে আমার দাদার বাড়ি ছিলো এবং দাদা পরবর্তীতে মালয়েশিয়াতে বসতি স্থাপন করেন” তার এই কথার সূত্রধরেই খোঁজ নিয়ে যানা যায় চট্টগ্রাম জেলার উত্তরাংশে রাঙ্গুনিয়া উপজেলাধীন চন্দ্রঘোনা ও কাপ্তাইগামী সড়কের সামান্য পূর্বে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম মরিয়মনগর।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এ গ্রামের এক যুবক ব্রিটিশ শাসিত মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। তিনি ছিলেন জাহাজের নাবিক। মালয়েশিয়ায় এ্যালোর সেটর গিয়ে এক মালয় রমণীর সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরেই জন্ম নেন মুহম্মদ ইস্কান্দার। আর এই মুহম্মদ ইস্কান্দারের ছেলে সন্তান হিসেবে জন্ম নেন মাহাথির মুহম্মদ। সে হিসেবে চট্টগ্রাম হচ্ছে মাহাথির মুহম্মদ এর পূর্বপুরুষের দেশ এবং সে অনুযায়ী বাংলাদেশী রক্ত তার শরিরে বহমান।

১৯২৫ সালের ১০ জুলাই ব্রিটিশ অধ্যুষিত মালয়ের কেদাহ অঞ্চলের অ্যালোর সেতার নামক স্থানে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে মাহাথির মুহম্মদ জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার দশ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন মাহাথির। তার পিতা মুহম্মদ বিন ইস্কান্দার ছিলেন মালয়ের একটি ইংলিশ স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক।

মাহাথির শৈশবে প্রথমে মালয় ও পরে শহরের একমাত্র ইংরেজি স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। বাসায় তাদের একজন ধর্ম শিক্ষক ছিলেন যিনি প্রতিদিন বাড়িতে এসে পবিত্র কুরআন শরীফ, ইসলাম ধর্মের উপর বিশ্বাস এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান শেখাতেন। ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশ্বাস মাহাথিরের ভিতর আসে পরিবার থেকে। তার পরিবার তাকে ইসলামের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে শিক্ষা দেয়, কিন্তু তাদের কোন রূপ গোঁড়ামি ছিল না।

ইসলাম সম্পর্কে “এ নিউ ডিল ফর এশিয়া” গ্রন্থে মাহাথির বলেন, ” ইসলাম ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ। একে পরিত্যাগ করার কোন কারণ নেই। সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ধর্ম কখনই অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বাধা হতে পারে না। ইসলামের শিক্ষা সমসাময়িক সময়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিতে হবে। ইসলাম শুধু মাত্র সপ্তম শতাব্দীর ধর্ম নয়। ইসলাম অবশ্যই সর্বকালের ধর্ম।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১সালে জাপান মালয়েশিয়া দখল করে। তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বন্ধ করে দেয় এবং একটি জাপানি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। মাহাথিরের বয়স তখন ষোল। প্রথমে তিনি জাপানি স্কুলে যেতে চান নি। ঐ সময় মাহাথির একটি স্থানীয় ছোট বাজারে কলা বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু পিতার চাপে তিনি পরবর্তীতে ঐ জাপানি স্কুলে ভর্তি হন।

২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তিনি ডাক্তার হবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৪৭ সালে সিঙ্গাপুরের কিং এডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এসময় মাহাথির মালয় জাতির বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন।

সিঙ্গাপুরে সিথি হাসমার সাথে সাক্ষাত হয়। সিথি হাসমা তখন দ্বিতীয় মালয় মহিলা হিসেবে সিঙ্গাপুরে বৃত্তি নিয়ে একই কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ছিলেন। পরবর্তীতে মাহাথির ও সিথি হাসমা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের মোট সাত জন সন্তান আছে, যার মধ্যে তিন জনকে তারা দত্তক নিয়েছিলেন। পরিবার সম্পর্কে মাহাথির বলেন, ” প্রত্যেকের নিজ পরিবার একটি নিরাপদ জায়গা – যা আমাদের এই জটিল সমাজে স্থিরতা আনে।”

১৯৫৩ সালে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া ফিরে আসেন। কিছুদিন সরকারী হাসপাতালে চাকরী করে পরে তা ছেড়ে দিয়ে একটি প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপন করেন। এটি ছিলো এ এলাকায় কোনো মালয়ী পরিচালিত প্রথম ক্লিনিক। মাহাথিরের মতে চিকিৎসক হিসেবে তার প্রশিক্ষণ ও প্রাকটিস তার মধ্যে স্থিরতা এনেছিল ও তাকে যে কোন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে সক্ষম করেছিল।

তিনি একবার ‘দ্যা ইকোনমিষ্ট, পত্রিকাতে বলেছিলেন, “চিকিৎসা বিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের জন্য রাজনীতি একটি ভাল পেশা। একজন ডাক্তার রোগীকে পর্যবেক্ষণ করেন, স্বাস্থ্যগত ইতিহাস রেকর্ড করেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন, ল্যাব পরীক্ষা করেন এবং চূড়ান্তভাবে রোগ নির্ণয় করেন। এ প্রক্রিয়াটি রাজনীতির মতই।”

সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠা মাহাথির একসময় রাজনীতিতে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেন। ১৯৬৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে এমপি পদে নির্বাচিত হন তিনি। এমপি হওয়ার পরে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন মালয়ীদের সমস্যার কথা বলতে, কিন্তু বারবার বাধাগ্রস্ত হন।

নিজ দলীয় নীতিও তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। ১৯৬৯ সালে মাহাথির প্রকাশ করেন তার বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বই ‘The Malay Dilemma’। বইটিতে তিনি মালয়ীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা সোজাসাপ্টা ভাষায় তুলে ধরেন।

দলের ভুল পরিকল্পনা ও অদক্ষতা মাহাথিরকে বিচলিত করে তোলে। এক পর্যায়ে দলের প্রেসিডেন্ট টেংকু আব্দুর রহমানের কাছে তিনি কড়া ভাষায় একটি চিঠি লিখেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিন বছর নিষিদ্ধ থাকার পর তিনি রাজনীতিতে পুনরায় ফিরে আসেন।

১৯৭৪ সালে দল নির্বাচনে জয়ী হবার পর তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। মাত্র দুই বছর পর মাহাথির ১৯৭৬ এ উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতে তিনি সফল হন। উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা থাকলেও মাহাথির স্বাধীনভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম ছিলেন না।

১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই ৫৫ বছর বয়সে মালয়েশিয়ার ৪র্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন মাহাথির মুহম্মদ। এসময় দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ছিলো। প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি তার সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সম্পূর্ণ মুক্ত হন।

সেই থেকে টানা ২২ বছর মাহাথির মুহম্মদ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর মধ্যে প্রতিবার তিনি ও তার দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। মাহাথির মোহাম্মদ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় যাবৎ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মালয়েশিয়াকে বদলে দেবার ক্ষেত্রে শিক্ষা হচ্ছে তার প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় শিক্ষার হার ৯০%। শিক্ষা ব্যায়ের ৯৫% সরকার বহন করছে।

ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্বময় আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রধান রূপকার হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি সকল বিষয় পুনঃপরীক্ষা করেন। সকল নীতি, পদ্ধতি, সরকার চালাতে প্রাত্যহিক সকল কাজ, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করা হয়। তার সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ওয়ার্ক-ফ্লো চার্ট আর অফিস ম্যানুয়েল প্রবর্তন করেন।

মাহাথির ও তার সরকার দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি তৈরি করেন যার মাধ্যমে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়। ব্যবসা এবং রাজনীতিতে ফুটপাতের লোক থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত দেশের জন্য নিজের জন্য কাজ করবে।

১৯৯০ সালে মালয়েশিয়া বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৮% ছাড়িয়ে যায়। মাহাথির ১৯৭১ সালে প্রনিত নিউ ইকোনমিক পলিসি (এনইপি) সফল ভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। এনইপির উদ্দেশ্য ছিল জাতি নির্বিশেষে দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জাতি পরিচয় মুছে ফেলা।

নতুন সম্পদ সৃষ্টি করা এবং এর বৃহত্তর অংশ দরিদ্রদের জন্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে সম্পদের পুনঃবন্টনের চেষ্টা করা হয়। ১৯৯১ সালে বিশ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হয়। দারিদ্র্য বিমোচন বহুলাংশে অর্জিত হয়। সমৃদ্ধির একটি পর্যায়ে পৌছে মালয়েশিয়া বিভিন্ন জাতির সুসম্পর্কসহ একটি জাতিতে পরিনত হয় যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঈর্ষনীয়।

বিশ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হবার পর দশ বছর মেয়াদি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি (এনডিপি) প্রনয়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশে শিল্পায়নের জন্য তিনি পরিকল্পিতভাবে ছোট ও মাঝারি শিল্প কারখানা স্থাপন করেন। আশির দশকে গৃহীত National Development Policy-এর ফলে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে দেশ এতোই উন্নত হয় যে, ১৯৯২ সালে মালয়েশিয়া নিজের শ্রমিকদের কর্মসংস্থান করেও প্রায় ৮ লক্ষ বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ করে।

সে বছরই শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেই ৬৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের মালয়েশিয়ান পণ্যসামগ্রী রপ্তানী হয়। ২০২০ সাল নাগাদ মালয়েশিয়াকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে মাহাথিরের ভিশন ২০২০ এর কাজ পুরোদমে চলছে। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা মাহাথির নিজ দেশে গাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেন।

পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণ, সমুদ্র থেকে ৬,৩০০ হেক্টর জমি উদ্ধার, অত্যাধুনিক এয়ারপোর্ট তৈরি, একাধিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, হাইওয়ে নির্মাণসহ তার অসংখ্য উদ্যোগ সফল হয়েছে। ১৯৮২ সালে মালয়েশিয়ার জিডিপির পরিমাণ ছিলো ২৭.৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৫.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। উৎপাদন ও রফতানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ মালয়েশিয়া এখন পৃথিবীর অন্যতম সফল রাষ্ট্র।

ব্যক্তিগত জীবনে মাহাথির অত্যন্ত পরিশ্রমী ও শৃঙ্খলাপরায়ণ। দেশব্যাপী সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিতির সময় রেকর্ড করার জন্যে তিনি পাঞ্চকার্ডের প্রচলন করেন। ৯০ এর দশকে যখন বিশ্ব পাঞ্চকার্ডের ব্যবহার নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে ঠিক তখন মালয়েশিয়া তার সফল প্রয়োগকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যায়।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ৩ মে ২০১৮, ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • ইসলাম

ইবনে সীরীনের মতে স্বপ্নে মা হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?

মা হারানোর স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী? স্বপ্নে একজন মাকে হারিয়ে যাওয়া এমন একটি দর্শনের মধ্যে রয়েছে…

২০ এপ্রিল ২০২৪, ২:৪১ অপরাহ্ণ
  • স্বাস্থ্য

ঘন ঘন প্রস্রাব প্রতিকারে হোমিও চিকিৎসা

ঘন ঘন প্রস্রাব হল স্বাভাবিকের চেয়ে অতি মাত্রায় প্রস্রাবের চাপ বা প্রস্রাব করা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক…

৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:২৮ অপরাহ্ণ
  • লাইফস্টাইল

তরমুজ খাওয়ার পর কোন ভুলে পেট ফুলে ওঠে?

বাজারে এখন তরমুজের ছড়াছড়ি। গ্রীষ্মকালীন এই ফল সবারই প্রিয়। বিশেষ করে রমজানে এই ফলের কদর…

৬ এপ্রিল ২০২৪, ২:১৮ অপরাহ্ণ