বাংলাদেশে মাছ চাষে রীতিমত বিপ্লব হয়েছে৷ বিশ্বে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে এখন বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়৷ জনপ্রতি মাছ খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে৷ তবে প্রশ্ন উঠেছে যে, এই চাষের মাছ কতটা স্বাস্থ্যসম্মত৷
ফাতেমা আবেদীন এখনো বাজারে গিয়ে দেশি মাছ খোঁজেন৷ দেশি মাছ বলতে বোঝায় বাংলাদেশের খাল, বিল, পুকুর বা নদীতে প্রাকৃতিকভাবে যেসব মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো৷
তাঁর কথা, ‘‘দেশি মাছ আর চাষের মাছের মধ্যে পার্থক্য অনেক৷ দেশি মাছের স্বাদই আলাদা৷ তবে এখন রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস – যা বাজারে পাওয়া যায় সবই চাষের৷ এই ধরনের দেশি মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে৷''
বাংলাদেশে এখন বলতে গেলে সব ধরনের মাছই চাষ হয়৷ রুই, কাতলা থেকে শুরু করে টেংরা, পাবদা, কৈ, শিং, মাগুর – সবই চাষ হচ্ছে৷ রাক্ষুসে প্রকৃতির কারণে
আফ্রিকান মাগুরের চাষ নিষিদ্ধ হলেও গোপনে চাষের অভিযোগ পাওয়া যায় প্রায়ই৷ আকারে ছোট থাকা অবস্থায় তা বাজারে দেশি মাগুর বলে চালানোর অভিযোগ আছে৷
ফাতেমা আবেদীন বলেন, ‘‘এটাই এখন একটা বড় সমস্যা৷ কোনটা চাষের আর কোনটা দেশি মাছ, তা এখন চেনা কষ্টকর৷ আবার অনেক সময় বাজার থেকে কেনা মাছে রান্নার পর উৎকট গন্ধ পাওয়া যায়৷''
বাংলাদেশে চাষের মাছের দাম কম৷ আর এটা অল্প সময়ে বড় হয়৷ ফলে ক্রেতারা যেমন কম দামে এই মাছ পেয়ে কিনছেন, আবার খামারিরাও চাষের মাছে লাভ করেন অনেক বেশি৷
এই লাভ করতে গিয়ে খামারিরা মাছের জন্য নানা ধরনের দেশে ও বিদেশে তৈরি ফিস ফিড, কেমিক্যাল, অ্যান্টিবায়োটিক, ইনজেকশন ব্যবহার করেন৷ এ সব ব্যবহার করতে গিয়ে এসব অপ্রশিক্ষিত খামারিদের অনেকেই নিয়মিত মৎস্য কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পরামর্শও পান না৷
খামারিরা সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো অ্যান্টিবাবায়োটিক আর নানা প্রকার ওষুধ ব্যবহার করেন কোনো পরামর্শ ছাড়াই৷ কখনো কখনো ওষুধ বিক্রেতাদের কথাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন৷
খুলনার পাইকগাছার রাশিদুজ্জামান এই চাষের মাছ নিয়ে সামাজিক সচেতনতার কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ তিনি উপকূলীয় এলাকায় লবণ পানি আটকে চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এলাকার মানুষ চাষের মাছ সহজে খেতে চান না৷ কারণ এমন সব খাদ্য দিয়ে এইসব মাছ দ্রুত বড় করা হয়, যা ক্ষতিকর৷ ক্ষতিকর উপাদান অ্যাবজর্ব হওয়ার আগেই মাছ বিক্রি করা হয়৷''
খামারিরা সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো অ্যান্টিবাবায়োটিক আর নানা প্রকার ওষুধ ব্যবহার করেন কোনো পরামর্শ ছাড়াই৷ কখনো কখনো ওষুধ বিক্রেতাদের কথাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন৷
খুলনার পাইকগাছার রাশিদুজ্জামান এই চাষের মাছ নিয়ে সামাজিক সচেতনতার কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ তিনি উপকূলীয় এলাকায় লবণ পানি আটকে চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এলাকার মানুষ চাষের মাছ সহজে খেতে চান না৷ কারণ এমন সব খাদ্য দিয়ে এইসব মাছ দ্রুত বড় করা হয়, যা ক্ষতিকর৷ ক্ষতিকর উপাদান অ্যাবজর্ব হওয়ার আগেই মাছ বিক্রি করা হয়৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘তেলাপিয়াসহ আরো কিছু মাছ মনোসেক্স করা হয় ব্যবসার জন্য৷ বিশেষ ধরনের খাবার ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় এই কাজে৷ ফলে তেলাপিয়া মাছ এক পর্যায়ে সব পুরষ হয়ে যায়৷
বাজারে পুরুষ তেলাপিয়া মাছের চাহিদা বেশি৷ কিন্তু এটা করতে গিয়ে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ বিভিন্ন কোম্পানির পরামর্শেই বিভিন্ন রাসায়নিক এমনকি অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ও মাত্রা নির্ধারণ করেন তারা৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওয়াহিদা হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যেমন ধরুন মনোসেক্স কালচারের মাধ্যমে কৈ মাছ সব নারীতে রূপান্তর করা হয়৷ আর সব তেলাপিয়া মাছকে পুরুষে রূপান্তর করা হয়৷ এটা চাহিদা এবং ব্যবসার জন্যই করেন খামারিরা৷
আর এ জন্য তারা হরমোন প্রয়োগ করেন৷ তা হতে পারে খাবারের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে৷ কিন্তু এর মাত্রা সঠিক না হলে বা ওই হরমোন দ্রবিভূত হওয়ার আগেই যদি খাবার জন্য মাছ বিক্রি করা হয় তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হবে৷
আবার মুরগির বিষ্ঠায় নানা ধরনের ক্ষতিকর মাইক্রোসেল থাকে৷ তা যদি মাছের খাবার হয় তাহলে মাছের মধ্যদিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে৷ ট্যানারির বর্জ্য দিয়ে মুরগির খাবার তৈরির অভিযোগ আছে৷ আর সেই মুরগির বিষ্ঠা বা বর্জ্য যদি মাছের খাবার হয় তাহলে ক্ষতিকর রাসায়নিক মাছের ভেতরেও যাবে৷''
বরিশালের হিজলা উপজেলার মৎস্য চাষি শাহাবুদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা মাছের প্যাকেটজাত খাবার ব্যবহার করি৷ আবার ভুট্টা, খৈল, হাড়ের গুড়া, ধানের কুড়া, শুটকিসহ বিভিন্ন উপাদানের মিশেলে তৈরি খাবারও ব্যবহার করি৷
আমাদের টার্গেট থাকে ছ'মাসের মধ্যে বাজারে মাছ বিক্রি করা৷ তবে এ সব খাবার কতটা নিরাপদ তা আমরা জানি না৷ এছাড়া আমরা নানা ধরনের ওষুধ, কেমিক্যাল, ইনজেকশন, হরমোন ব্যবহার করি৷ পরামর্শ করার জন্য মৎস্য কর্মকর্তাদের তেমন পাওয়া যায় না৷ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এগুলো ব্যবহার করি৷''
ওয়াহিদা হক বলেন, ‘‘এখন খামারিরা ব্যবসার বিষয়টি বেশি দেখছেন৷ তাই মাছের খাবারে নানা ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে৷ আবার ফিস ফিড যেসব উপাদানে তৈরি হয়,
দেখা যায় সেসব খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে৷ ফলে পুরো বিষয়টিই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়৷ আর সবশেষে এগুলো মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে৷''
মাছের রোগ বালাই সারাতে বা প্রতিরোধ করতে এখন খামারিরা নানা ধরনের ওষুধ ব্যবহার করেন৷ আর জলাশয়ের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখতে ব্যবহার করেন চুন ও পটাশ৷ কিন্তু এসব কি মাত্রায় এবং কখন ব্যবহার করতে হবে তার জন্য নেই কোনো বিষেষজ্ঞ পরামর্শ৷
খামারিরা চান কম খরচে মাছ উৎপাদন করে ভালো ব্যবসা করতে৷ তাই তারা হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানা ওষুধ ব্যবহার করেন৷ এইসব ওষুধ আসে বিদেশ থেকে৷ এর মান নির্ধারণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই৷
ওয়াহিদা হক বলেন, ‘‘যেসব কেমিক্যাল জলাশয়ে ব্যবহার করা হবে তা দ্রবীভূত হতে হবে৷ সেটা যদি না হয় তাহলে বিপজ্জনক হবে৷ তাই এর মাত্রা নির্ধারণ খুব জরুরি৷ নয়তো তা মাছে থেকে যাবে৷ সেখান থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল বা ওষুধ ব্যবহারের কারণে অথবা পুকুরে বর্জ্যের কারণে কখনো কখনো মাছে গন্ধ হয়৷ আর স্বাদে তো পার্থক্য হয়ই৷ দেশি মাছের সঙ্গে চাষের মাছের পার্থক্যের কারণ দেশি মাছ স্বাভাবিক নিয়মে প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়৷ আর চাষের মাছ কৃত্রিমভাবে দ্রুত বড় করা হয়৷''
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, তারা মাছ চাষের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত আছেন৷ অনেকে মুনাফার জন্য হরমোন, ওষুধ এবং কেমিক্যাল বেশি ব্যবহার করেন৷ এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তর চাষিদের সতর্ক করছে৷ তবে লোকবলের অভাবে তা কার্যকরভাবে করা যাচ্ছে না৷
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণ পনিতে চিংড়ি চাষ নিয়ে বিতর্ক আছে শুরু থেকেই৷ পাইকগাছার রাশিদুজ্জামান জানান, ‘‘এ কারণে ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ গাছপালা মরে যাচ্ছে৷ গবাদি পশু ও হাস মুরগির খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে৷
আর ফাতেমা আবেদীন বলেন, ‘‘বাজার থেকে আমরা যে চাষের মাছ কিনি তার বিক্রেতারাই জানান, এইসব মাছ নানা ধরনের বর্জ্য খাবার খেয়ে বড় হয়েছে৷ কখনো বর্জ্য ফেলার জায়গায় মাছ চাষ হয়৷ ফলে মাছে গন্ধ হয়৷ তারপরও এই মাছই খেতে হচ্ছে৷''
প্রসঙ্গত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নায়ারণ চন্দ্র চন্দ গত ১৭ জুলাই মৎস সপ্তাহের এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন যে, দেশে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মাছ৷ দেশের জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির এক-চতুর্থাংশের বেশি
(২৫.৩০ শতাংশ) মৎস্য খাতের অবদান৷ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ ৫০ হাজার টনের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন, যা লক্ষ্যমাত্রার ৮৪ হাজার টন বেশি৷''
দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশই মৎস্য চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ ২০২০-২১ সাল নাগাদ ৪৫ দশমিক ৫২ লাখ টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্য আছে বাংলাদেশের৷
ডয়েচে ভেলে
এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ১৩ আগস্ট ২০১৮, ১১:১৯ অপরাহ্ণ ১১:১৯ অপরাহ্ণ
মা হারানোর স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী? স্বপ্নে একজন মাকে হারিয়ে যাওয়া এমন একটি দর্শনের মধ্যে রয়েছে…
ঘন ঘন প্রস্রাব হল স্বাভাবিকের চেয়ে অতি মাত্রায় প্রস্রাবের চাপ বা প্রস্রাব করা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক…
বাজারে এখন তরমুজের ছড়াছড়ি। গ্রীষ্মকালীন এই ফল সবারই প্রিয়। বিশেষ করে রমজানে এই ফলের কদর…