কোপা আমেরিকা

কোপা আমেরিকায় যেভাবে শেষ চারে তারা

কোপা আমেরিকায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ছুটছে দারুণ গতিতে। গ্রুপ পর্ব, কোয়ার্টার-ফাইনাল পেরিয়ে সেমি-ফাইনালের মঞ্চে উঠে এসেছে লাতিন আমেরিকার ফুটবলের দুই পরাশক্তি। সেরা চারে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানাবে প্যারাগুয়েকে বিদায় করা পেরু ও রেকর্ড চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে ছিটকে দেওয়া কলম্বিয়া।

গত তিন আসরের দুটিতে বাজিমাত করা চিলি এবার ফিরেছে খালি হাতে। কষ্টেসৃষ্টে গ্রুপ পর্বের বৈতরণী পার হওয়ার পর কোয়ার্টার-ফাইনালে স্বাগতিক ব্রাজিলের বিপক্ষে হেরে ছিটকে গেছে তারা। রেকর্ড ১৫ বারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে থামিয়ে সেরা চারে জায়গা করে নিয়েছে কলম্বিয়া। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক সেমি-ফাইনালের চার দলের পথচলা।

‘এ’ গ্রুপের সেরা হয়ে নকআউট পর্বে ওঠা আর্জেন্টিনার শুরুটা ছিল সাদামাটা। রিও দে জেনেইরোর নিল্তন সান্তোস স্টেডিয়ামে চিলির বিপক্ষে ১-১ ড্র দিয়ে যাত্রা শুরু। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে চিলির বিপক্ষেই টাইব্রেকারে হেরে পরপর দুইবার রানার্সআপের বিষাদ সঙ্গী হয়েছিল তাদের। যদিও এই ম্যাচে আক্রমণে আধিপত্য ছিল আর্জেন্টিনার; দারুণ ফ্রি কিকে দলকে এগিয়ে নিয়েছিলেন অধিনায়ক লিওনেল মেসি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এদুয়ার্দো ভারগাসের গোলে ড্র হয় ম্যাচটি।

পয়েন্ট খুইয়ে পথচলা শুরুর পরের ম্যাচে উরুগুয়ের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। আধিপত্যে এ ম্যাচেও এগিয়ে ছিল লিওনেল স্কালোনির দল। কিন্তু সুযোগ তৈরির তুলনায় গোল মেলেনি। গুইদো রদ্রিগেসের একমাত্র গোলে স্বস্তির জয় পায় দলটি। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সেটি ছিল টানা তিন ড্রয়ের পর তাদের প্রথম জয়।

পরের ম্যাচেও কষ্টে জয়ের ধারা ধরে রাখে আর্জেন্টিনা। ব্রাসিলিয়ার মানে গারিঞ্চায় আলেহান্দ্রো গোমেসের একমাত্র গোলে প্যারাগুয়েকে হারায় তারা। এ ম্যাচেই মেসি স্পর্শ করেন জাতীয় দলের হয়ে হাভিয়ের মাসচেরানোর সর্বোচ্চ (১৪৭টি) ম্যাচের রেকর্ড। গ্রুপের সবচেয়ে মলিন দল বলিভিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচে চাওয়ার সঙ্গে গোল পাওয়ার হিসাব অনেকটা মিলে আর্জেন্টিনার। দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ড হয় মেসিরও। ৪-১ গোলের জয়ে শুরুটা করেন গোমেস, জোড়া গোলে ব্যবধান বাড়ান মেসি। পরে জালের দেখা পান লাউতারো মার্তিনেসও।

‘বি’ গ্রুপের চতুর্থ দল হিসেবে কোয়ার্টার-ফাইনালে আসা একুয়েডর যথেষ্ট ভুগিয়েছে আর্জেন্টিনাকে। শুরুতে গোলের সুবর্ণ সুযোগ মিস করেছেন মেসি। পরে অবশ্য দারুণভাবে জেগে ওঠা স্কালোনির দল জিতে ৩-০ ব্যবধানে। প্রথমার্ধের শেষ দিকে রদ্রিগো দে পল এগিয়ে নেওয়ার পর মার্তিনেস ও মেসি পান জালের দেখা। টানা চতুর্থবারের মতো লাতিন আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে সেমি-ফাইনালে মঞ্চে ওঠে আর্জেন্টিনা। ৪ গোল নিয়ে বর্তমানে প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসি।

গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার মতো ব্রাজিলের জয় ও ড্র সমান। তিন জয়ের সঙ্গে একটি ড্র। পয়েন্টও সমান ১০। দুই দলই গ্রুপ সেরা। তবে দুই গ্রুপ মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি গোল (১০টি) দিয়েছে ব্রাজিল। মুকুট ধরে রাখার মিশনের শুরুটাও তাদের হয় দুর্দান্ত; ভেনেজুয়েলাকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে। মার্কিনিয়োস, নেইমার ও গাব্রিয়েল বারবোসা পান জালের দেখা। তিতের দল দেখিয়ে দেয় সঠিক পথে আছে তারা।

পরের ম্যাচে ব্রাজিল আরও দাপুটে। কোপা আমেরিকার মাঠের মান নিয়ে আর্জেন্টিনার কোচ ও খেলোয়াড়দের মতো অভিযোগ ছিল তিতেরও। এজন্য তাকে জরিমানাও গুণতে হয়েছে। কিন্তু তার জন্য সন্তুষ্টির ছিল গোলে টান না পড়া। পেরুর বিপক্ষে ম্যাচে আলেক্স সান্দ্রো, নেইমার, রিবেইরো ও রিশার্লিসন ডানা মেলেন লক্ষ্যভেদের আনন্দে। ব্রাজিল হেসেখেলে জিতে ৪-০ ব্যবধানে।

নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতে বসেছিল প্রতিযোগিতার ৯ বারের চ্যাম্পিয়নরা। কলম্বিয়ার বিপক্ষে দশম মিনিটে গোল হজম করে বসে তারা। ফাউলের ছড়াছড়ি, রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি, এমন ম্যাচে শেষ দিকে ব্রাজিলের ত্রাতা রবের্ত ফিরমিনো ও কাসেমিরো। ৭৮তম মিনিটে ফিরমিনো সমতার স্বস্তি ফেরানোর পর যোগ করা সময়ে জয়ের তৃপ্তি নিশ্চিত করেন কাসেমিরো।

কোয়ার্টার-ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় গ্রুপের শেষ ম্যাচে নেইমার-কাসেমিরোকে বিশ্রাম দিয়েছিলেন তিতে। ছিটকে যাওয়ার শঙ্কায় থাকা একুয়েডর সুযোগটা কাজে লাগায় দারুণভাবে। ব্রাজিলকে ১-১ সমতায় রুখে দিয়ে জায়গা করে নেয় শেষ আটে।

কোয়ার্টার-ফাইনালে ব্রাজিলের মিলেছে কষ্টের জয়। লুকাস পাকুয়েতার একমাত্র গোলে ২০১৫ ও ২০১৬ সালের চ্যাম্পিয়ন চিলিকে হারায় তিতের দল। বলের নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়ে ইউজেনি মেনার মুখে বুট লাগিয়ে লাল কার্ড দেখেন ফরোয়ার্ড গাব্রিয়েল জেসুস। ১০ জনের ব্রাজিলকে চেপে ধরা চিলি ভাগ্যকে পাশে পায়নি একটুও। বেন ব্রেরেটনের হেড ফিরিয়ে দেয় ক্রসবার, শেষ দিকে ভারসাগাসের শট ফিরিয়ে ব্রাজিলের ত্রাতা এদেরসন। হারের পর ম্যাচের আর্জেন্টাইন রেফারিকে ‘ভাঁড়’ বলে ব্যঙ্গ করেন চিলির মিডফিল্ডার আর্তুরো ভিদাল।

একুয়েডরের বিপক্ষে কষ্টের জয়ের পর ভেনেজুয়েলার সঙ্গে ড্র করা কলম্বিয়া গ্রুপে পরে পথ হারিয়েছিল। টানা দুই ম্যাচ হারে পেরু ও ব্রাজিলের বিপক্ষে। ‘বি’ গ্রুপের তৃতীয় দল হয়ে ওঠে নকআউট পর্বে।

উরুগুয়ের বিপক্ষে তাদের নির্ধারিত সময়ের ম্যাড়ম্যাড়ে লড়াই শেষ হয় গোলশূন্য সমতায়। পরে টাইব্রেকারে গোলরক্ষক দাভিদ অসপিনার নৈপুণ্যে উঠে আসে সেমি-ফাইনালে। টাইব্রেকারে কলম্বিয়ার চার শটের সবকটিই পায় জালের দেখা। কিন্তু উরুগুয়ের চার শটের মাত্র দুটিতে হয় গোল; হোসে হিমেনেস ও মাতিয়াস ভিনার শট ঠেকিয়ে জয়ের নায়ক অসপিনা। এক আসর বিরতি দিয়ে সেমি-ফাইনালের মঞ্চে ফিরল কলম্বিয়া।

গত আসরের রানার্সআপদের পথচলার শুরু গোলবন্যায় ভেসে। গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ব্রাজিলের কাছে ৪-০ গোলের হার। দ্বিতীয় ম্যাচে কলম্বিয়াকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো। কিন্তু পরের ম্যাচে ২-২ গোলে ড্র করে একুয়েডরের বিপক্ষে। উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলা পেরু গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে জিতে ১-০ ব্যবধানে। ‘বি’ গ্রুপের রানার্সআপ হয়ে আসে নকআউট পর্বে।

কোয়ার্টার-ফাইনালে অন্তত গোলের হিসাবে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ম্যাচ উপহার দেয় পেরু-প্যারাগুয়ে। ম্যাচটি প্যারাগুয়ের গুস্তাভো গোমেসের জন্য ছিল অম্ল-বিষাদে ভরা। একাদশ মিনিটে এই ডিফেন্ডার দলকে এগিয়ে নেন। প্রথমার্ধের শেষ দিকে তিনিই লাল কার্ড দেখে হন দলের মহাবিপদের কারণ! ৩-২ স্কোরলাইন নিয়ে শেষের বাঁশির অপেক্ষায় থাকা ম্যাচে রোমাঞ্চ ফেরান প্যারাগুয়ের গাব্রিয়েল আভালোস। তার ৯০তম মিনিটের গোলেই ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে ৪-৩ ব্যবধানের হার সঙ্গী হয় তাদের।

সেমি-ফাইনালঃ ব্রাজিল-পেরু। আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়া।

শেয়ার করুন: