হেফাজতে ইসলাম

বাবুনগরী আমির, মহাসচিব জিহাদী

কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির পদে জুনাইদ বাবুনগরীকে বহাল রেখে ৩৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন কমিটিতে মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন নূরুল ইসলাম জিহাদী।

আলোচিত মামুনুল হকসহ গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজতের বাকি নেতাদের কমিটিতে রাখা হয়নি। হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে ইউসুফ মাদানীকে কমিটিতে সহকারী মহাসচিব করা হয়েছে। তবে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন শফীপন্থীরা।

গতকাল সোমবার সকালে খিলগাঁও চৌরাস্তায় মাখজানুল উলুম মাদরাসায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব নূরুল ইসলাম জিহাদী এই নতুন কমিটি ঘোষণা করেন।

কমিটি ঘোষণা করে আপনারা খুশি কি না সাংবাদিকদের এমন এক প্রশ্নের জবাবে নূরুল ইসলাম জিহাদী বলেন, ‘আমরা সবাই খুশি। তবে আমাদের মনে একটা শঙ্কা রয়েছে, আমরা ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করতে পারব কি না।’

এদিকে গতকাল কমিটি ঘোষণার পর চিঠি লিখে তা প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি জানান দিয়েছেন মাওলানা ইউসুফ মাদানী। গতকাল ঘোষিত কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হেফাজতের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা আগামী ১৭ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে সভা ডেকেছেন।

ওই সভায় হেফাজতের পাল্টা কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। ওই সভায় প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফীর দুই ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানী ও মাওলানা আনাছ মাদানীসহ আলেম-উলামাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘আজকে (গতকাল) নতুন যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে, তা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। এই কমিটি প্রতিষ্ঠাতা আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নীতি-আদর্শবিরোধী। এটি ফটিকছড়ি কমিটির নতুন সংস্করণ।’

৩৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নায়েবে আমির হয়েছেন ৯ জন। তাঁরা হলেন আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা আবদুল হক মোমেনশাহী, মাওলানা সালাহউদ্দীন নানুপুরী, অধ্যক্ষ মীযানুর রহমান চৌধুরী (পীর দেওয়ান), মাওলানা মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ী, সিলেট), মাওলানা ইয়াহইয়া (হাটহাজারী মাদরাসা), মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস (ফরিদাবাদ মাদরাসা), মাওলানা তাজুল ইসলাম (পীর সাহেব ফিরোজ শাহ্) ও মাওলানা মুফতি জসিমুদ্দীন (হাটহাজারী মাদরাসা)।

যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন মাওলানা সাজেদুর রহমান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মাওলানা আব্দুল আউয়াল (নারায়ণগঞ্জ), মাওলানা লোকমান হাকীম (চট্টগ্রাম), মাওলানা আনোয়ারুল করীম (যশোর) ও মাওলানা আইয়ূব বাবুনগরী। সহকারী মহাসচিব করা হয়েছে মাওলানা জহুরুল ইসলাম (মাখজান) ও মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে (আল্লামা শফীর ছেলে)।

সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদ্রিস (চট্টগ্রাম), অর্থ সম্পাদক মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ আলী (মেখল), সহ-অর্থ সম্পাদক মুফতি হাবিবুর রহমান কাসেমী (নাজিরহাট), প্রচার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন রব্বানী (সাভার), সহপ্রচার সম্পাদক মাওলানা জামাল উদ্দীন (কুড়িগ্রাম), দাওয়াবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা আবদুল কাইয়ূম সোবহানী (ঢাকা) ও সহকারী দাওয়া সম্পাদক মাওলানা ওমর ফারুক (নোয়াখালী)।

কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন মাওলানা মোবারাকুল্লাহ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মাওলানা ফয়জুল্লাহ্ (পীর, মাদানীনগর), মাওলানা ফোরকানুল্লাহ খলিল (দারুল মা’আরেফ, চট্টগ্রাম), মাওলানা মোশতাক আহমদ (খুলনা দারম্নল উলুম), মাওলানা রশিদ আহমদ (কিশোরগঞ্জ), মাওলানা আনাস (ভোলা), মাওলানা মাহমুদুল হাসান (ফতেহপুরী) ও মাওলানা মাহমুদুল আলম (পঞ্চগড়)।

নূরুল ইসলাম জিহাদী জানান, খাসকমিটি মজলিসে শুরা হিসেবে বিবেচিত হবে। তারা হেফাজতের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে খাসকমিটি।

খাসকমিটিতে রয়েছেন মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, জুনাইদ বাবুনগরী, আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, নূরুল ইসলাম, মীযানুর রহমান চৌধুরী (পীর দেওয়ান), সাজেদুর রহমান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), আল্লামা মুহিব্বুল হক (গাছবাড়ী, সিলেট), আব্দুল আউয়াল (নারায়ণগঞ্জ) ও মুহিউদ্দীন রব্বানী (সাভার, ঢাকা)।

জিহাদী আরো বলেন, ভবিষ্যতে প্রতিটি জেলা কমিটির সভাপতি পদাধিকারবলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া জেলা কমিটির সভাপতি ও সম্পাদককে অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতে হবে।

এ ছাড়া হেফাজতের ১৬ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও ঘোষণা করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা হলেন মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী (প্রধান উপদেষ্টা), মুফতি আব্দুস সালাম (চাটগামী), সুলতান যওক নদভী, আব্দুল হালীম বোখারী (পটিয়া), নূরুল ইসলাম আদীব (ফেনী), আব্দুল মালেক হালীম, আব্দুর রহমান হাফেজ্জী (মোমেনশাহী), রশিদুর রহমান ফারুক বর্ণভী, নূরুল হক বটগ্রাম (কুমিল্লা), আবুল কালাম (মোহাম্মদপুর), শিব্বির আহমাদ (নোয়াখালী), জালাল আহমাদ (ভূজপুর), আল্লামা আশেক এলাহী (উজানী), হাবিবুল্লাহ বাবুনগরী, আব্দুর বাছীর (সুনামগঞ্জ) ও আফজালুর রহমান (ফেনী)।

কেন গত কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে নূরুল ইসলাম বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি তৎকালীন আমির উলামায়ে কিরামদের সঙ্গে আলোচনা করে বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। যাঁরা কারাগারে আছেন, তাঁদের অপরাধী মনে করে কমিটিতে রাখা হয়নি কি না জানতে চাইলে নবনির্বাচিত কমিটির মহাসচিব বলেন, ‘কাউকে অপরাধী মনে করার ক্ষমতা আমাদের নেই। অপরাধী মনে করতে পারেন আদালত। আমরা হেফাজতের গ্রেপ্তার নেতাদের মুক্তি চাই।’

হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর বড় ছেলে ইউসুফ মাদানী আপনাদের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে জানিয়েছেন, এই কমিটি মানেন না। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে তাঁর যে কথা হয়েছে, তিনি কমিটিতে থাকার কথা জানিয়েছেন। তিনি কমিটি মানেন না বলে যদি কোনো কথা বলে থাকেন, সেটা সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন। আমাদের এ রকম কিছু বলেননি।’

হেফাজতের শফীপন্থীদের সঙ্গে বিভাজন দূর হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম একটি। অন্য কোনো হেফাজত নেই। আর বিদ্রোহের কোনো খবর আমাদের কাছে নেই।’

আমির, মহাসচিবসহ বেশির ভাগ নেতা চট্টগ্রামের: হেফাজতের ৩৩ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির আমির, মহাসচিবসহ ১৫ নেতাই চট্টগ্রামের। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টাসহ ১৬ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির ছয়জন এবং ৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় খাস (মজলিসে শুরা) কমিটির প্রধানসহ তিনজনের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে। সব মিলিয়ে সংগঠনের এই তিন কমিটির মোট ৫৮ জনের মধ্যে চট্টগ্রামেরই ২৪ জন। এর মধ্যে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানী কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহকারী মহাসচিবের পদ পেলেও ছোট ছেলে সাবেক প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাছ মাদানীসহ শফী অনুসারী আর কারোর ঠাঁই হয়নি।

এর আগে গত ২৫ এপ্রিল রাতে সংগঠনের ২০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা মহানগর কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন ওই কমিটির আমির আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী। ওই রাতেই বাবুনগরীকে আহ্বায়ক করে হেফাজতের পাঁচ সদস্যের আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির পাঁচজনের মধ্যে আহ্বায়ক, সদস্যসচিবসহ চারজনের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। তাঁরা সবাই বাবুনগরীর আত্মীয়-স্বজন হওয়ায় শুরুতেই নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন আল্লামা শফীর অনুসারীরা।

গতকাল ঘোষিত তিন কমিটির মধ্যে গত আহ্বায়ক কমিটির পাঁচজনই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী আমির, হাফেজ নূরুল ইসলাম জিহাদী মহাসচিব, সালাহউদ্দীন নানুপুরী নায়েবে আমির ও অধ্যক্ষ মীযানুর রহমান চৌধুরী নায়েবে আমিরের পদ পান। মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে ১৬ সদস্যের উপদেষ্টা এবং ৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় খাসকমিটির প্রধান হিসেবে রাখা হয়েছে।

শেয়ার করুন: