টিকটক, লাইকি, ফেসবুুক

অনলাইনে নারীপাচারের জাল

সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে একটি বাড়িতে বন্দিদশায় পিউলি (ছদ্মনাম)। ঘটনা মে মাসের শেষ সপ্তাহের। এক রাতে পিউলি তার বড় বোনকে মোবাইলে জানায়, যেকোনো উপায়ে তাকে যেন মুক্ত করা হয়। তা না হলে তার ঠিকানা হতে পারে ভারত বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক যৌনপল্লী।

ষোড়শী পিউলি গোপালগঞ্জের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও কিছুটা উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সাজগোজ খুবই পছন্দ। হাতে আছে স্মার্টফোন। টিকটক, লাইকি, ফেসবুুকসহ সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যমে সক্রিয় সে। একদিন ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেয় সাগর (২২) নামের এক সুদর্শন তরুণ। বাংলাদেশি সাগর বেশির ভাগ সময় ভারতেই থাকে। নতুন বন্ধুর সঙ্গে অনলাইনে চলতে থাকে অনুভূতির আদান-প্রদান। এভাবে একসময় দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক।

সম্পর্ক এতটাই গভীরে চলে গিয়েছিল যে সাগরের জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি পিউলি। বাকি জীবন একসঙ্গে সুখে-শান্তিতে কাটানোর প্রলোভন দেয় সাগর। দেওয়া হয় দুবাইয়ে উন্নত জীবনযাপনের টোপ। সরলমনা পিউলি আরো উতলা হয়ে ওঠে। সাগরের কথামতো একদিন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। পা বাড়ায় ‘দুবাইয়ের পথে’। কিন্তু তার যে পাসপোর্ট-ভিসা কিছুই নেই।

গত মে মাসের শেষ দিকে গোপালগঞ্জ থেকে সোজা সাতক্ষীরা পৌঁছে পিউলি। সাগরের পাঠানো এক ব্যক্তি সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ডে রিসিভ করে তাকে। এরপর তারা রওনা দেয় ভোমরা সীমান্তে। প্রতিমুহূর্তে অনলাইনে সাগরের সঙ্গে তার কথা চলে। সীমান্তের এক বাড়িতে নিয়ে রাখা হয় পিউলিকে। তখন সে দেখতে পায়, আগে থেকেই ওই বাড়িতে অবস্থান করছিল আরো সাতজন তরুণী।

এ পর্যায়ে এসে ঘোর ভাঙে পিউলির। সে বুঝতে পারে, দুবাইয়ে উন্নত জীবনযাপনের টোপ দিয়ে তাকে নেওয়া হচ্ছে যৌনদাসী বানাতে। এবার সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে সে বড় বোনের সঙ্গে কথা বলে। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে আকুতি জানায়, যেকোনো উপায়ে তাকে যেন সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়। বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের মাধ্যমে খবর পেয়ে তৎপর হয় যশোরের পুলিশ। নাটকীয় অভিযানে উদ্ধার হয় পিউলি।

কিন্তু পিউলির মতো এমন সৌভাগ্য হয়নি হাজার হাজার তরুণী, কিশোরী, নারী-শিশুর। এরই মধ্যে তারা নিজেদের সরলতার বিনিময়ে পেয়েছে দাসত্বের জীবন। সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে এক তরুণীকে বীভৎস কায়দায় নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসতেই বেরিয়ে আসে সহস্রাধিক নারী ও শিশু পাচারের লোমহর্ষক তথ্য। পাচারের শিকার এই হতভাগী মেয়েগুলোর প্রায় প্রত্যেকেই অনলাইন আসক্তির মূল্য দিচ্ছে।

পোস্ট, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই চারটি অনুষঙ্গই এখন অনেকের প্রাত্যহিক জীবন। ‘শুভ সকাল’ থেকে ‘শুভ রাত্রি’ পর্যন্ত দিনের প্রতিটি সময়ের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে ছবি আর লেখায়। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে অনেকের কাছে এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এই সব অনুভূতির অভিধানই কারো কারো জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার মূল সূত্র। কারণ অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে জাল পেতে রেখেছে নারী ও শিশু পাচারকারী চক্র। তাদের জালে আটকে নিভে যাচ্ছে অনেক আলো। হারিয়ে যাচ্ছে বহু সম্ভাবনা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভিনদেশি অ্যাপ টিকটক, লাইকি, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ প্রচার ও যোগাযোগের প্রায় সব মাধ্যমে ওত পেতেছে পাচারকারীচক্র। গত কয়েক মাসে একটি চক্রের শুধু টিকটকে পাতা ফাঁদেই পড়েছে সহস্রাধিক নারী ও শিশু। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, টিকটক, লাইকি যে মাধ্যমেই পরিচয় হোক, একটা সময় তারা মিলিত হয় ফেসবুকের একটি গ্রুপে। তারপর বড় পরিসরে মিটআপ হয়। এরপর প্রেমের সম্পর্ক গড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের পার্লার, সুপারশপ, শপিং মল এবং বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রলোভন দিয়ে পাচার করে দেওয়া হয় মেয়েদের। পাচারকারীদের এই চক্রটি মূলত ভারত, বাংলাদেশ ও দুবাইজুড়ে বিস্তৃত। তাদের নেটওয়ার্কও খুব শক্তিশালী।

এ অবস্থায় অত্যন্ত চিন্তিত অভিভাবকরা। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও ক্ষতিকর অ্যাপগুলো বন্ধের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এই অ্যাপগুলো আসার পর ছেলে-মেয়েরা অশ্লীল ও উদ্ভট ভিডিও বানাচ্ছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, এগুলোর কারণে নতুন প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। এসব অ্যাপ বন্ধের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনও অ্যাপগুলো নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে বলেছেন, টিকটক, লাইকিসহ এ ধরনের অ্যাপসের মাধ্যমে নারীপাচারসহ অপরাধের মাত্রা বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কমিশনার সুব্রত রায় মৈত্র টিকটক-লাইকিসহ অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপের অপব্যবহার সম্পর্কে বলেন, ‘এসব অ্যাপের ভয়ংকর অপব্যবহারের বিষয়টি আমরা জেনেছি। কিন্তু এগুলো বন্ধ করতে হলে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিটিআরসি নিজে থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সরকার নির্দেশ দিলে বিটিআরসি সেটা বাস্তবায়ন করতে পারে।’

জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের গবেষণায় দেখা গেছে, পাচারের শিকার মেয়েদের ৩০ শতাংশেরই পাচারকারীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে। যশোরে কর্মরত সংস্থাটির সিনিয়র প্রগ্রাম অফিসার শাওলী সুলতানা বলেছেন, এই প্রজন্মের মেয়েগুলোর অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে হাতে একটা স্মার্টফোন থাকতেই হবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, এই ফোনের মাধ্যমে ব্যবহার করা যোগাযোগের অ্যাপগুলো তার জীবনকে বিষিয়ে তুলতে পারে। শাওলী বলেন, ‘উদ্ধার হওয়া মেয়েদের বেশির ভাগই বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে ফাঁদে পড়ে। প্রথমে কুশল বিনিময়, মিষ্টি কথায় সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা, এরপর নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে চূড়ান্তভাবে পাচারের রাস্তায় আনা হয় তরুণীদের।’

বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে মানুষের জীবনযাত্রার ধরন অনেকটাই বদলে গেছে। বিশেষ করে তরুণ শ্রেণি দিন দিন ফেসবুক থেকে অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে সরে যাচ্ছে। টিকটক-লাইকিসহ এ ধরনের অ্যাপগুলো আসার পর এক শ্রেণির মেয়েকে অশ্লীল ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। মডেল হওয়ার নেশায় প্রকাশ্যে তারা অশ্লীলভাবে দৃশ্য ধারণ করে। আবার অনেকে অর্থ উপার্জনের জন্যও এসব অ্যাপকে হাতিয়ার বানিয়েছে। তবে নিজেদের ছবি, ভিডিও ফুটেজ এসব অ্যাপে প্রকাশ করার ফলে তারা পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের কলকাতা, হায়দরাবাদ ও মুম্বাইভিত্তিক একটি চক্র দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে একটি শক্তিশালী পাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, টিকটকে ভিডিও দেখার পর একটি মেয়েকে টার্গেট করে পাচারকারীরা। প্রথমেই মেয়েটিকে মডেল বানানোর লোভে ফেলা হয়। তারপর ওই মেয়েকে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় চক্রটি। ভিডিও বানানোর নাম করে কৌশলে অশ্লীল ফুটেজ ধারণ করে তাকে জিম্মি করা হয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির কাছে হার মেনে ওই মেয়ে পাচার হয়ে যায়।

গবেষণা বলছে, ১৪ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরাই এসব অ্যাপে বেশি আসক্ত। ঠিক এই বয়সসীমার মেয়েরাই পাচারের শিকার হয় বেশি। কম বয়সী মেয়েদের আবেগ, নিজেকে উপস্থাপনের প্রবণতা এবং দারিদ্র্যই পাচারকারীদের বড় সম্বল। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে অনলাইনে পাচারকারী চক্রের উৎপাত বেশি। তারা জাল ফেলে রেখেছে সাইবার জগতে। নতুন নতুন ট্রেন্ডিংয়ে আসক্ত তরুণীরা এর শিকার হচ্ছে বেশি।

অপরাধবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাধুলার জায়গা সংকুচিত হয়ে আসা, আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ, তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষ, বিশ্বায়ন—সব কিছু মিলিয়েই একটি প্রজন্মের মানসিকতায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসে গেছে। যেমন—অনলাইনে ভিডিও কনটেন্টের ভিউয়ার বাড়লে আয়ের সুযোগ থাকছে। ফলে একটা শ্রেণি নতুন নতুন কনটেন্ট বানানোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভিউয়ার (দর্শক-শ্রোতা) বাড়াতে তারা নানাভাবে নিজেদের উপস্থাপনের দিকে পা বাড়ায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাইবার ও ফরেনসিকে দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ তাঁদের।

পর্যটকবেশে গিয়ে যৌনদাসীর জীবন : বাংলাদেশ বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অভিবাসী প্রেরণকারী দেশ। জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ মে পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে এক কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার ১৯২ জন। যেসংখ্যক কর্মী বিদেশে যায় তার ১৫ শতাংশ নারী। মোট জনশক্তির ৩২.৭২ শতাংশ সৌদি আরব এবং ১৭.৮৬ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারী ও শিশু পাচারের জন্য দুটি দেশ হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও সৌদি আরব। জনশক্তি রপ্তানির সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীচক্র। বিশেষ করে ভ্রমণ ভিসায় ইউএইতে নেওয়া হচ্ছে মেয়েদের। সেখানকার বিভিন্ন সূত্র বলছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এমন সুন্দরী তরুণীদের দিকে নজর রাখে পাচারকারীচক্র। পরিবারের অর্থনৈতিক অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে প্রথমেই তাদের কিছু টাকা দেওয়া হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন। পাসপোর্ট, ভিসা থেকে বিমানের টিকিট—সব কিছুর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে অভিভাবকদের মন জিতে নেয় চক্রের সদস্যরা। দুবাইয়ে নেওয়ার পর এই মেয়েদের ঠিকানা হয় ডান্সবার।

মামলার বিচার হয় না : বছরে ঠিক কত নারী-শিশু পাচার হচ্ছে, এই সংখ্যা কেউই জানে না। তবে ধারণানির্ভর অনেক তথ্য রয়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে দুই লাখ নারী-শিশু পাচারের শিকার হয়েছে। আরেকটি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে পাচারের উদ্দেশ্যে বছরে ৫০ হাজার মেয়েকে ভারতে পাচার করা হয়। এদের মধ্যে অনেককে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পাঠানো হয়।

এদিকে ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন হওয়ার পর মামলার সংখ্যা বাড়লেও বিচারে দেখা গেছে কচ্ছপগতি। পুলিশ সদর দপ্তর ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ আইনে ছয় হাজার ৭৩৫টি মামলা হয়েছে। ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবপাচার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই আইনের অধীনে অভিযুক্ত পাচারকারীদের বিচারের হার মাত্র ১.৭ শতাংশ। এ আইনের মামলার মধ্যে গত বছর ৩১২টি তদন্ত করে সরকার। এর মধ্যে ২৫৬টি মামলায় ভুক্তভোগীরা যৌনদাসী হিসেবে পাচারের শিকার হয়েছিল।

গত বছরের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের অবস্থান ‘দ্বিতীয় স্তরের নজরদারি তালিকা’ থেকে ‘দ্বিতীয় স্তর’-এ উন্নীত হয়েছে। দ্বিতীয় স্তরে অবস্থানের অর্থ হলো, পাচার নির্মূলের লক্ষ্যে ন্যূনতম মান অর্জনে সরকার উল্লেখযোগ্য ও ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা নিচ্ছে। ২০১৯ সালে মানবপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে সাতটি মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু বাংলাদেশিদের শোষণকারী নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ।

অন্যদিকে পাচার হওয়ার সময় গত এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মাত্র ১২ জন নারী এবং সাতটি শিশুকে উদ্ধারের তথ্য দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে নারী ও শিশু পাচার বাড়ছে বলে মনে করছেন মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী। তিনি বলেন, অনলাইনের সহজলভ্যতার ফায়দা লুটছে পাচারকারীচক্র। সেদিক থেকে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে। বিচার ঝুলে থাকছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা পাচারকারীর তথ্য দিতে পারে না। নানা জটিলতায় এই মামলাগুলো ধুঁকছে।

সালমা আলী বলেন, ‘অনলাইনের কারণে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা আরো বেশি সক্রিয় হয়ে গেছে। বিশেষ করে করোনাকালে এই প্রবণতা বেড়েছে। অথচ দেশ যখন ডিজিটাইজেশনের পথে এগোচ্ছিল, আমরা তখন নীতিমালা ঠিক করতে বলেছিলাম। কিছু গাইডলাইনও দিয়েছি। দেশের সংশোধনাগারগুলো ঘুরে ঘুরে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলাম। এগুলো বাস্তবায়িত হয় না। আইনের ফাঁকে বেরিয়ে অপরাধীরা আরো বড় অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে।’

উপায় কী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘আমরা এখন আধুনিক সমাজব্যবস্থার প্রাথমিক স্তরে আছি, যেখানে নানা রকম অস্থিরতা বাড়তে দেখা যায়। যেমন—যুক্তরাষ্ট্রেও একসময় বিশাল গ্যাং সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যেটি এখন বাংলাদেশে হচ্ছে। সামাজিক পটপরিবর্তনের কারণে পুরনো অনুশাসনগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ছে। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চরিত্র গঠনের যে ভিত্তি তৈরি হতো, সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা দেখছেন এই অপরাধবিজ্ঞানী। তাঁর মতে, আধুনিকায়নের সঙ্গে পুরনো সমাজব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে। পুরনো অনুশাসনগুলো নতুন রূপে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে এতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দেশে বর্তমানে যে কয়েকটি সংশোধনাগার রয়েছে, তা মোটেও উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত নয়। সেখানে মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একটি সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দিলেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আসবে, তা ভাবার সুযোগ নেই। কারণ একটি বন্ধ হলে আরেকটি আসবে। তাই নজর দিতে হবে গোড়ায়।

প্রশাসনে আরো দক্ষতা ও সক্রিয়তা আনার ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, এক হাজার মেয়ে পাচার হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ জানতে পারে। অথচ তাদের বিষয়টি টের পাওয়া উচিত ছিল পাঁচটি মেয়ে পাচারের পর।

জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর তরিকুল ইসলাম বলেন, জীবনযাত্রার ধরন বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তরুণ শ্রেণির আচরণেও বিরাট পার্থক্য এসেছে। তারা নিত্যনতুন মাধ্যমে সংযুক্ত হচ্ছে। কিভাবে যে নিজেদের গোপনীয়তা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে, সেটি তারা টেরই পাচ্ছে না। এটি পাচারকারীদের জন্য সুবিধা করে দিয়েছে। তারা এখন অনলাইনে বসেই শিকার খুঁজতে পারছে।

তিনি আরো বলেন, গত কয়েক বছরে পাচারের শিকার হওয়ার পর সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশে ফেরা মেয়েদের ওপর গবেষণা করেছে জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার। এতে দেখা গেছে, ৩০ শতাংশের বেশি মেয়ের তার পাচারকারীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। এখনই এর লাগাম টেনে ধরা না গেলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো নাজুক হতে পারে।

একটি মেয়ে পাচারের শিকার, নাকি সে আগে থেকেই স্বেচ্ছায় সংশ্লিষ্ট দেশটিতে যাতায়াত করছে—এই দুটি বিষয় নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে তরিকুল ইসলাম বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এটি খুবই জরুরি। কাকে পাচারের শিকার বলব, সেটিই যদি না জানি, তাহলে সামনে এগোনো কঠিন। এ ছাড়া পাচার প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। পাশাপাশি সাইবার ও ফরেনসিক দিক থেকে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।

শেয়ার করুন: