গণফোরামের দুই অংশ

আবারও মুখোমুখি গণফোরামের দুই অংশ

আবারও মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন গণফোরামের দুই অংশের শীর্ষ নেতারা। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি অংশ, বিপরীতে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে আরেকটি অংশ গণফোরামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় একে অপরের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আবু সাইয়িদকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্যের নির্বাহী কমিটি গঠন করে গণফোরামের একটি অংশ। এতে দলটির সাবেক নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুকে সদস্য করা হয়। এর ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় এসে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে দলের নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের অবস্থান জানান দেন।

শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। প্রায় এক বছর পর তিনি প্রকাশ্যে এসে দাবি করেন, রোজার আগেই দলীয় কার্যক্রম জোরদার করা হবে। ড. কামাল হোসেন জানান, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে দেশব্যাপী গণসংযোগ শুরু করবে তার দল।

তিনি বলেন, দেশের আজ কী অবস্থা সে সম্পর্কে আপনার অবগত আছেন। সব রকমের সমস্যা আজ সংকট আকার ধারণ করেছে। এই সংকটগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের ঐক্যের প্রয়োজন আছে। সংকট উত্তরণে জনগণকে ঐকমত্যে আসতে হবে যাতে সরকার বাধ্য হয় এসব জিনিস থেকে সরে দাঁড়াতে। এই অবস্থা বিরাজ করলে এখানে আমাদের সুশাসন পাওয়ার কোনো উপায় থাকবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যদি মাঠে না নামি তাহলে এর থেকে উত্তরণ ঘটবে না।

ড. কামাল হোসেনের সংবাদ সম্মেলন যখন চলছিল, ঠিক তখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনেই গণফোরামের আরেক অংশের কর্মসূচি চলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দল থেকে বের হয়ে হয়তো আরেকপক্ষ আরেক বক্তব্য রাখতে পারে। আমার দল, আমি মনে করি সঠিকভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে, কাজ করে যাবে।

ড. কামাল হোসেন এ সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, ডিজিটাল আইনের কথা বলে আমাদের যেভাবে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে তা থেকে মুক্তি দিতে হবে।

ড. কামাল হোসেনের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দলের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান। উপস্থিত ছিলেন আওম শফিকউল্লাহ, মোশতাক আহমেদ, জানে আলম, সুরাইয়া বেগম ও সেলিম আকবার।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর তাণ্ডবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে গণফোরামের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণফোরামের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এখন থেকে গণফোরাম সারা বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।

এতে আরও বলা হয়, একটি চক্রের মাধ্যমে ব্যাংক লুটপাঠ, শেয়ারবাজার ধ্বংস এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করে এবং জনগণকে বঞ্চিত করে লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। যখন আইন প্রণয়নে ও আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ অনুপস্থিত থাকে তখনই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ অসহায় হয়ে পড়ে। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পছন্দের সৎ প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারলেই আইন প্রণয়নে ও আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগে জনগণের ভূমিকা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ সময় গণফোরামের পক্ষ থেকে ‘রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা’ ও ‘অর্থনৈতিক লুটপাটের’ বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনে কথা চিন্তা করছেন- গণমাধ্যমে এমন সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আমরা সংশোধন নয়, আইনটি বাদ দেওয়ার পক্ষে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এভাবে হলে বাকস্বাধীনতা, চিন্তা করা স্বাধীনতাকে যেভাবে আঘাত দেওয়া হচ্ছে সেখান থেকে আমাদের সমাজকে পুরোপুরি মুক্ত করা দরকার।

ড. কামাল হোসেন বলেন, আজ যারা নিজেদের নির্বাচিত দাবি করে দেশ শাসন করছে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও সমর্থন নেই। জনবিচ্ছিন্ন এই সরকার জনগণকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার অপকৌশল হিসেবে বিভিন্ন কালা কানুন জারি করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তারই অংশ।

এ সময় তিনি দেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া পদত্যাগের পর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে কে জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, এখন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আওম শফিকউল্লাহ। উনি খুব পরিচিত লোক।

এদিকে বিকাল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের হলরুমে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামের সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, ঠিক তখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের বাইরে মানববন্ধন করে অধ্যাপক আবু সাইয়িদের নেতৃত্বাধীন দলের অন্য একটি অংশ। কারা হেফাজতে মারা যাওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ এবং নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন ওরফে মোজাক্কির হত্যার বিচার এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিলের দাবিতে তারা এই কর্মসূচি পালন করে।

যুব গণফোরামের ও ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সমাজের ব্যানারে আয়োজিত কর্মসূচিতে মোস্তফা মহসিন মন্টু, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক, লতিফুল বারী হামিম, নাসির হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের পর থেকেই গণফোরামের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টুকে বাদ দিয়ে ড. রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক পদে বসানোর মধ্য দিয়েই গণফোরাম দুই অংশে বিভক্ত হয়। একটি অংশ ড. কামাল হোসেনকে কেন্দ্র করে এবং অন্য অংশটি মন্টু-সুব্রত ও আবু সাইয়িদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে। এরপর দলের মধ্যে বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর বেইলী রোডের নিজ বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেন, দলের গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া সব বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার অকার্যকর করা হচ্ছে। দলে কোনো সমস্যা নেই। যা বিরোধ ছিল তা কেটে গেছে। এরই মধ্যে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন ড. রেজা কিবরিয়া। এরপর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ড. কামাল হোসেনকে বাদ দিয়ে গণফোরামের বিদ্রোহী অংশটি কমিটি গঠন করে।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে গণফোরামের বিদ্রোহী অংশের কমিটির সদস্য সচিব মোস্তফা মহসিন মন্টু শনিবার বলেন, গণতন্ত্রের চর্চা প্রথমে সংগঠন থেকে করতে হবে। কাউন্সিলর, জেলা প্রতিনিধি, মাঠপর্যায়ের কর্মীরা গণফোরামের নেতৃত্বে নির্বাচন করবেন। কোনো ঘরে, চেম্বারে বসে নেতা নির্বাচন হবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলো- ড. কামাল হোসেন কয়েকজন ব্যক্তির কারণে সংগঠনের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা করেননি। যার ফলে আজকে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

গণফোরামের অপর একটি অংশ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পৃথক কর্মসূচি করছে, তারা কি গণফোরামে অংশ কিনা জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, গণফোরাম থেকে কিছু লোক বেরিয়েছেন, বেরিয়ে গিয়ে বক্তব্য রাখতে পারেন। তারা বেরুতেই পারেন। বাধ্য করে কাউকে তো রাখা যায় না। ওদেরকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন আপনারা কেন বেরিয়ে গেছেন।

শেয়ার করুন: