ফখরুল

চোর-ডাকাতের চেয়েও বিএনপির খোঁজ বেশি নেয় পুলিশঃ ফখরুল

কয়েক দিন আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৭৪ বছরে পা দিয়েছেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁর দলের ভরাডুবি ঘটেছে।

একের পর এক নির্বাচনে বিএনপি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হচ্ছে এবং এ জন্য সব সময়ই বিএনপি অনিয়ম ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ করে আসছে। তার পরও বিএনপি কেন নির্বাচনে অংশ নেয়—এটিসহ আরো কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন মির্জা ফখরুল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এনাম আবেদীন।

৭৩তম জন্মদিন কিভাবে পালন করলেন? ফখরুল: আসলে নিজের জন্মদিন আমি কখনোই পালন করি না। আমাদের মতো মানুষদের জন্মদিন পালনের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা আসলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো ব্যক্তিদের মানায়। তবে আমার নাতি-নাতনিদের জন্মদিন এবং মেয়েদের বিবাহবার্ষিকী সুযোগ হলে পালন করি।

৭৪ বছরে পা দিয়ে কেমন দেখছেন এখনকার বাংলাদেশকে? ফখরুল: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন মানুষ হিসেবে আজকের বাংলাদেশকে দেখতে চাইনি। গণতন্ত্র, পরমতসহিষ্ণু একটি মুক্ত সমাজব্যবস্থার বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছি। রাজনৈতিক কারণে হয়রানি, হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম—এগুলো দেখতে চাইনি। আর রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে গুম হবে এটা কল্পনাও করা যায় না। একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারব্যবস্থা আমরা দেখতে চেয়েছি। তার বদলে দেখছি একটি শ্রেণি বড়লোক থেকে আরো বড়লোক হচ্ছে। আরেকটি শ্রেণি গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছে। উন্নয়নের নামে হরিলুট চলছে। দলবিশেষ ও ব্যক্তিবিশেষের আজ গুণকীর্তন চলছে। ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও অনিয়ম, ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও বিএনপি অংশ নিচ্ছে কেন?

ফখরুল: মূলত দুটি কারণে বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে যাচ্ছে। প্রথমত, আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে চাই। নির্বাচনগুলোর সুযোগে যতটুকু স্পেস আমরা পাই সেটুকু ব্যবহার করতে চাই। কারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া যায়, কথা বলা যায়। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দেশের সাধারণ মানুষ করতে চায়। এটা এ দেশের মানুষের বহু যুগের প্র্যাকটিস। কিন্তু যেদিন থেকে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন দলীয় মার্কা দিয়ে শুরু হলো, সেদিন থেকেই এই নির্বাচনের ক্যারেক্টার চেঞ্জ হয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মার্কার এই নির্বাচন দেশকে বিভক্ত করে ফেলেছে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়করণের ফলে পশ্চিমবঙ্গের সমাজেও বিভক্তি দেখা যাচ্ছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। দল-মত-নির্বিশেষে আগের সেই ভালো মানুষটাকে নির্বাচিত করার এ দেশের জনগণের স্বপ্ন আজ ধ্বংস করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের বিষয় থাকে। কিন্তু এখানে সরকার পরিবর্তন নয়; জনগণকে সেবা দেওয়ার বিষয় আছে। এখন কী হচ্ছে? দুর্নীতিপরায়ণ লোকেরা কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন করছে। সবচেয়ে খারাপ হলো, প্রশাসনকে ব্যবহার করে সরকারি দলের লোকেরা স্থানীয় সরকারগুলো নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে। সব কিছু একদলের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হচ্ছে।

তাহলে নেতাকর্মীদের আগ্রহের কারণে আপনারা স্থানীয় নির্বাচনে যাচ্ছেন? ফখরুল: শুধু নেতাকর্মীদের আগ্রহ বা উৎসাহ-উদ্দীপনা নয়, আমাদের রাজনৈতিক বিবেচনাও এখানে আছে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা সরকারের মুখোশ জনগণের সামনে উন্মোচন করতে পারছি। নির্বাচনের আড়ালে সরকারের এই স্বৈরতান্ত্রিকতা বিশ্ববাসীর কাছেও অজানা থাকছে না। এই নির্বাচন করতে গিয়ে আমরা কথা বলতে পারছি। মানুষের কাছে যেতে পারছি। যদিও এতে আমাদের ক্ষতি হয়তো অনেক হচ্ছে। কারণ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের সময় নির্বাচনে এমন অনিয়মের বিষয়টি ধারাবাহিকভাবে আলোচনায় থাকার পরেও আপনারা যাচ্ছেন। এর কারণ কী? ফখরুল: সরকার প্রথমদিকে এতটা অনিয়ম করতে পারেনি। তাদের প্রথম মেয়াদে পৌরসভা ও উপজেলায় ফলাফল তুলনামূলকভাবে বিএনপি ভালো করেছে। ওই সময় অনেক আসন পেয়েছি। নির্বাচনের নামে প্রহসন প্রথম চালু হয়েছে ২০১৪ সালের পরে এবং ২০১৮ সালের পরে এটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।

কিন্তু সরকারি দল এটি করবে তা তো বিএনপির জানা কথা! তাহলে এর চেয়ে একটু বেশি শক্তি নিয়ে মাঠে নামার প্রয়োজন ছিল কি? ফখরুল: এখন নির্বাচনে শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে আমরা তো বন্দুক-পিস্তল ব্যবহার করতে পারি না। কারণ বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করি না।

আমি রাজনৈতিক ডেমোনেস্ট্রেশন বা নেতাকর্মীদের শোডাউনের কথা বলছি... ফখরুল: ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক বড় বড় শোডাউন হয়েছে। এসব মিছিল-মিটিং দেখে শাসক দল ভয় পেয়ে গেছে। প্রতিটি পৌরসভায় বড় বড় মিছিল হয়েছে। প্রচারণায় বিএনপি পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো—প্রশাসনের সহায়তায় ভোটকেন্দ্রগুলো তারা দখল করে নিচ্ছে। বিএনপির এজেন্টদের বের করে দিচ্ছে।

ভোটকেন্দ্রে কি আরো পাহারার দরকার ছিল না? ফখরুল: এখন ইভিএমে ভোট হলে কেন্দ্র পাহারা দিয়ে কতটুকু ফল পাওয়া যাবে। তা ছাড়া প্রশাসন, পুলিশ ও সরকারি দল একাট্টা হয়ে নির্বাচন করছে। নির্বাচন কমিশন তাদের সহায়তা করছে। সব কিছু দেখেও তারা চোখ বুজে থাকে। চট্টগ্রামে ইভিএমে ভোট করে তারা যা খুশি করেছে। সেখানে ব্যাপক সহিংসতা, এমনকি খুন পর্যন্ত হয়েছে। আসলে সরকারি দল, প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন যদি একাট্টা হয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে, সেখানে রক্ষা করা কঠিন। তবে একটা কথা বলে রাখি; সত্যিকারের জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ক্ষমতায় এলে অবশ্য আজকের নির্বাচন কমিশনকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। অতীতের ঘটনাবলি নিয়ে বর্তমান সরকার অনেক কিছু করছে। তেমনি আজকের জনগণবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়েও একদিন প্রশ্ন উঠবে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।

নির্বাচনের বর্তমান নিয়ম বা ধারা অব্যাহত থাকলে আর কত দিন ধৈর্য ধরে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে?

ফখরুল: ঠিক এই মুহূর্তে এটা বলা সম্ভব নয়। পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর সেটি নির্ভর করবে। তবে আমরা নির্বাচনে থাকতে চাই। আপনারা দেখেছেন যে আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছি। কেন গিয়েছি? উত্তর একটাই—গণতান্ত্রিক স্পেসটুকু ব্যবহার করা।

চসিক নির্বাচনে ঢাকা থেকে সিনিয়র নেতারা যাননি বলে আলোচনা আছে। ফখরুল: এটা একেবারেই সত্যি নয়। প্রয়োজনীয় সবাই সেখানে গেছেন। তবে বেশি বয়স্ক হওয়ার কারণে স্থায়ী কমিটির কেউ কেউ যেতে পারেননি। তাও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সেখানে অবস্থান করে নির্বাচন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া আমানউল্লাহ আমান, খায়রুল কবীর খোকনসহ ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ এবং যুগ্ম মহাসচিবদের অনেকে সেখানে গেছেন। আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, আজকের সরকারের বিরুদ্ধে যারা মুখ বুুজে থাকে সুযোগ পেলে তারাই বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। এটা বললাম এ জন্য যে, দেখেন আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের বা প্রেসিডিয়ামের কেউ কি সেখানে গিয়েছেন?

সংসদের উপনির্বাচনে অংশ নেওয়াও কি একই কারণে? ফখরুল: হ্যাঁ। তা ছাড়া বিএনপির মতো গণতান্ত্রিক দল নির্বাচনে না গিয়ে কী করবে! একটা হতে পারে রাজপথের আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনের জন্যও পরিবেশ পরিস্থিতি বা স্পেসের দরকার হয়। সেটার জন্য বিএনপি লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার কি করছে সেটিও সবাইকে বিবেচনা করা উচিত। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং বিএনপি সেটি করছে। এক লাখের বেশি মামলায় বিএনপির প্রায় ৩৬ লাখ লোক আসামি। আমাদের দলের কত লোক গুম হয়ে গেল। আদালতে গেলে দেখা যায় বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো লোক নেই। বিএনপির লোকেরাই হাজিরা দিচ্ছে, শুনানি হচ্ছে ও জামিন নিচ্ছে। দেশের চোর-ডাকাতরা এখন মহা আনন্দে আছে। পুলিশ এখন চোর-ডাকাতের তুলনায় বিএনপির খোঁজ বেশি নেয়।

শেয়ার করুন: