পাঠ্যবই ছাপা-বাঁধাই

কাগজ সংকটে বিঘ্নিত বিনামূল্যের বই মুদ্রণ

কাগজ সংকটে বিঘ্নিত হচ্ছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ। সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর মাঝে বিতরণের লক্ষ্যে এবার প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে। কিন্তু বাজারে এ বইয়ের কাগজের বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে।

কাগজ সংকটে বিঘ্নিত হচ্ছে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ। সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর মাঝে বিতরণের লক্ষ্যে এবার প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে। কিন্তু বাজারে এ বইয়ের কাগজের বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে।

বেশিরভাগ মিল এ বইয়ের নির্দিষ্ট কাগজ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। হাতেগোনা যে ক’টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করছে তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সংকট বই উৎপাদনে গতি চেপে ধরেছে। এখন পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ৫ কোটি বই পাঠানো সম্ভব হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মুদ্রাকররা বলছেন, এ সংকট থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারি হস্তক্ষেপ। দেশীয় মিলগুলোকে উৎপাদনের ব্যাপারে আগ্রহী করা যেতে পারে। সেটা সম্ভব না হলে বিনা শুল্কে কাগজ আমদানির অনুমতি প্রয়োজন। এ দুই পদক্ষেপ না নিলে ১ জানুয়ারির আগে বইয়ের মুদ্রণ কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক চেয়ারম্যান এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, মিলগুলোর সঙ্গে চুক্তি করেও তারা কাগজ পাচ্ছেন না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, দেশে ৬০-৭০টি মিল থাকলেও ৪-৫টি উৎপাদনে আছে। করোনায় ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে বাকিরা উৎপাদনে নেই। এ সুযোগে অন্যরা ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

মুদ্রাকরদের অনেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না। বইয়ের কাজে নিয়োজিত আছে প্রায় দেড়শ’ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। ‘সিলিং’ (পর্যায়ক্রমে) করে সবাইকে কাগজ দেয়ায় অনেকেই সক্ষমতা অনুযায়ী মুদ্রণ কাজ এগিয়ে নিতে পারছেন না।

মুদ্রাকরদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, প্রাথমিক স্তর এবং মাধ্যমিক স্তরের চাররঙা বই ছাপা হয় ৮০ জিএসএম কাগজে। আর মাধ্যমিকের একরঙা বই ছাপানো হয় ৬০ জিএসএম কাগজে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া যখন চলছিল তখন বাজারে এ মানের কাগজের দর ছিল গড়ে প্রতি টন ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে দাম বেড়ে হয়েছে ৫৮ হাজার টাকা। বইয়ের কাভারে ব্যবহারের আর্ট কার্ডের দামও একই হারে বেড়েছে বলে জানান মুদ্রাকররা। মূলত উৎপাদন আর আমদানি সংকটে দাম বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জানান, বিদ্যমান সংকট জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) তারা জানিয়েছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও (এনবিআর) স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছেন তারা। শুধু এনসিটিবির নির্ধারিত কাগজই বিনা শুল্কে আমদানির অনুমতি চাইছেন তারা।

এক্ষেত্রে এনসিটিবির দরপত্রের দলিল প্রমাণ হিসেবে থাকবে। তিনি মনে করেন, কাগজ শুল্কবিহীন আমদানির অনুমতি দেয়া হলেও সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হবে না। কেননা, কাগজ রফতনিকারক প্রতিষ্ঠান কোনো শুল্ক দেয় না। তাই যে কাগজ আমদানি হবে সেটা রাজস্বে প্রভাব ফেলবে না। বরং এ পদক্ষেপ নিলে কাজ দ্রুত হবে। আর এ ধরনের আমদানির সুযোগ ঘোষণা করা হলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চাপে পড়ে দাম কমানোর পাশাপাশি উৎপাদন বাড়াতে পারে। এসব বিষয় উল্লেখ করে ২৬ নভেম্বর এনসিটিবি এবং এনবিআরে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, এনসিটিবি যে কাগজে বই ছাপে সেগুলো বর্তমানে ৫টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করছে। এগুলো হচ্ছে- আম্বার, আল নূর, বেইজ এবং রশিদ পেপার মিল। এছাড়া মেঘনা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান কাগজ উৎপাদন করছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি এবার এনসিটিবিকে কাগজ সরবরাহ করায় সাধারণ মুদ্রাকররা সেখান থেকে পাচ্ছেন না।

একজন মুদ্রাকর বলেন, তবে এনসিটিবির কাগজ সরবরাহ শেষে মেঘনা গ্রুপের এ প্রতিষ্ঠানটি আগামী মাসের মাঝামাঝি সরবরাহ করতে পারবে বলে তাদের জানিয়েছে। কিন্তু ততদিনে কাজ জমে যাবে। এতে বই উৎসব বিঘ্নিত হবে।

উল্লিখিত ৫টি মিলের একটির ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা জানান, কাগজের দাম বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে পাল্পের (কাগজ তৈরির কাঁচামাল) মূল্যবৃদ্ধি। এছাড়া শ্রমিকের খরচও বেড়েছে। যখন চাহিদা ছিল না তখন উৎপাদিত কাগজ দাম কমিয়ে বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে উল্লিখিত খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই তারা দাম বাড়িয়েছেন।

ব্রাইট প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী এসএম মহসিন জানান, কাগজ সংকটের কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী তার প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারছে না। সিলিং করে কাগজ পাওয়ায় সপ্তাহে একাধিক দিন তার প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বসে কাটাতে হয়। বড় মিলগুলো উৎপাদনে থাকলেও একদিকে যেমন কাগজের দাম বাড়ত না, অন্যদিকে বাজারে সংকটও থাকত না। এখন সংকট নিরসনের একমাত্র পথ হচ্ছে কাগজ আমদানির অনুমতি।

কাগজসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমিতি এবং পেপার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৮ লাখ টন কাগজের চাহিদা আছে। এর বড় অংশই দেশে উৎপাদিত কাগজে মেটানো হতো। সরকারের বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বই ছাপার কাজে বছরে প্রায় ৮০ হাজার টন পেপার দরকার। এর মধ্যে ১২ হাজার টন কিনে দেয় এনসিটিবি। এ কাগজ কয়েক বছর ধরে দেশের মিল থেকে কেনা হচ্ছে। আগে দেশির পাশাপাশি আমদানি কাগজে চাহিদা মিটত। এখন শুধু আর্টপেপারসহ বিশেষ ধরনের কাগজ আমদানি হয়।

উৎপাদন বন্ধ রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির ব্যবস্থাপক জানান, বাজারে বর্তমানে কাগজের চাহিদা অন্তত ৯০ শতাংশ কমে গেছে। কাগজ ব্যবহারের বড় দুটি খাত বাংলাবাজারের প্রকাশনা শিল্প এবং সংবাদপত্র। প্রথম খাতে চাহিদা নেই বললেই চলে। সংবাদপত্রেও ব্যবহার কমেছে অনেক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় খাতাপত্রের ব্যবহার নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ আছে। সব মিলে কাগজ শিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যে কারণে শ্রমিক ছুটি দিয়ে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, কাগজ সংকটে বইয়ের উৎপাদনে ধীরগতির কথা মুদ্রাকররা তাদের জানিয়েছেন। কিন্তু তারা নির্দিষ্ট শর্তে কাজ দিয়েছেন। মুদ্রাকরদের দায়িত্ব সময়মতো বই সরবরাহ করা। তবে জাতীয় স্বার্থে তারা মুদ্রাকরদের সহায়তার চেষ্টা করবেন। তারা এ বিষয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাতে মুদ্রাকররা বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ চেয়েছেন। সমস্যার বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে।

শেয়ার করুন: