রোহিঙ্গা

বাংলাদেশিদের বরাদ্দ কেটে রোহিঙ্গাদের উন্নয়ন!

জনগণের অর্থ, বিদেশি ঋণ ও অনুদানের অর্থে চলমান দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। বিভিন্ন কারণে কাজের ধীরগতি, সময় মতো অর্থব্যয় না হওয়ায় অর্থ প্রত্যাহার; অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পে অর্থ স্থানান্তর কিংবা কর্মসূচি স্থানান্তরের ঘটনা প্রায়সই ঘটে। কিন্তু দেশের হতদরিদ্রদের জন্য গৃহীত কোনো প্রকল্প থেকে অর্থ প্রত্যাহার করে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যবহার কিংবা দেশের এক অঞ্চলের মানুষের জন্য নেয়া কর্মসংস্থান কর্মসূচি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় স্থানান্তরের ঘটনা বিরল।

অনুসন্ধানে এমন দুটি প্রকল্পের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রকল্প দুটি মূলত গৃহীত হয়েছিল বাংলাদেশের অতিদরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে। উপকারভোগীদের মধ্যে ছিল দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুরা। এমন একটি প্রকল্প হলো ‘ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর দ্য পুওরেস্ট (আইএসপিপি)- যত্ন (তৃতীয় সংশোধিত)’। প্রকল্পটি রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার ১৮টি উপজেলায় এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ময়মনসিংহ, জামালপুর ও শেরপুর জেলার ২৫টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রতি মাসে শিশুপুষ্টি ও সচেতনতা সংক্রান্ত কর্মশালায় অংশ নেয়া, অন্তঃসত্ত্বাদের চারবার গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শূন্য থেকে ২৪ মাস বয়সী শিশুদের প্রতি মাসে গ্রোথ (বৃদ্ধি) পরীক্ষা এবং ২৫ থেকে ৬০ মাস বয়সী শিশুদের তিন মাস অন্তর গ্রোথ পরীক্ষার জন্য নগদ অর্থ দেয়া।

জানা গেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয়ভাবে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই প্রকল্প থেকে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪২৫ কোটি টাকা) প্রত্যাহার করেছে বিশ্ব ব্যাংক।

প্রকল্প সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৫ সাল থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি তিনবার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন শেষ করা সম্ভব হবে ২০২২ সালের জুনে। প্রকল্পের মোট ব্যয় এক হাজার ৯৮০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার দিচ্ছে ১৭ কোটি ৮৫ লাখ টকা। আর বিদেশি অর্থায়ন এক হাজার ৯৬২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। বিদেশি ওই অর্থায়ন থেকেই ৪২৫ কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।

তবে স্থানীয় সরকার বিভাগ দাবি করছে, বিশ্ব ব্যাংক ৫০ মিলিয়ন ডলার প্রত্যাহার করলেও প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও সুবিধাভোগীর লক্ষ্যমাত্রা (ছয় লাখ) অর্জন ব্যাহত হবে না।

অর্থ প্রত্যাহারের কারণ জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহরিন আহমেদ মাহবুব বলেন, ‘তখন রোহিঙ্গাদের জন্য ইমার্জেন্সি সাপোর্টের দরকার ছিল। এই প্রকল্পে কিছু টাকা ছিল, যেটা কখনও খরচ হয়নি। তখন ওই অংশটা রোহিঙ্গাদের ইমার্জেন্সি (জরুরি) হিসাবে দেয়া হয়।’

অপর কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন হচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ৯০ দিনের কর্মসূচিটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে (ইজিপিপি)। কিন্তু দেশের অন্য এলাকা থেকে এই ইজিপিপি স্থানান্তর করে রোহিঙ্গাদের হোস্ট কমিউনিটিতে (রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার স্থানীয় বাংলাদেশি জনপদ) তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওখানে হোস্ট কমিউনিটি (স্থানীয় জনগোষ্ঠী) আছে, যারা বাংলাদেশি। তারা ওখানে এখন কাজ করতে পারে না, যেহেতু রোহিঙ্গারা ওই কাজ করে ফেলে। ওদের জীবনযাপন খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সেখানকার স্থানীয় বাংলাদেশিদের যে বন্ধুত্ব ছিল শুরুতে, সেটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে রোহিঙ্গা এলাকার হোস্ট কমিউনিটিকে আমরা ৯০ দিনের কর্মসূচির (ইজিপিপি) আওতায় আনব। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ইজিপিপি বাস্তবায়ন করা হবে হোস্ট কমিউনিটিতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইজিপিপিতে বিশ্ব ব্যাংক অতিরিক্ত ফান্ড দিয়েছে। তবে সেটা ছিল ঋণ। অন্য এলাকা থেকে শিফট করে রোহিঙ্গা এলাকার হোস্ট কমিউনিটিতে এখন বিনিয়োগের কারণে ঋণকে তারা অনুদান দেখাচ্ছে। এতে হোস্ট কমিউনিটি প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল পাবে এবং তারা ওখানে কাজকর্মের সুযোগ পাবে।’

‘ইনকাম সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর দ্য পুওরেস্ট (আইএসপিপি)- যত্ন (তৃতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্প থেকে অর্থ প্রত্যাহার এবং ইজিপিপি কর্মসূচি স্থানান্তর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তা মেহরিন আহমেদ মাহবুব বলেন, ‘এই প্রকল্পের (আইএসপিপি- যত্ন) বাইরে এভাবে অন্য প্রকল্পের টাকা রোহিঙ্গাদের জন্য হস্তান্তর করা হয়নি।’

বিশ্ব ব্যাংকের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্ব ব্যাংক থেকে যেটা করা হয়েছে, ৪৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান হিসেবে রোহিঙ্গা এবং ওখানকার যে লোকাল কমিউনিটি (স্থানীয় বাংলাদেশি) আছে, তাদের জন্য দেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ছোট ছোট অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে সেবা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে। আর ওখানে যেহেতু জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বেশি, রোহিঙ্গা নারীর উন্নয়ন— এসব কাজে এই টাকা ব্যয় হচ্ছে। এর কিছু অংশ থেকে লোকাল কমিউনিটিও উপকৃত হবে। যেমন- সাইক্লোন শেল্টার, রাস্তা, সৌরবিদ্যুৎ— এগুলো লোকাল কমিউনিটি ও রোহিঙ্গাদের জন্য করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা ও লোকাল কমিউনিটির জন্য অনুদান দেয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘আমাদের সরকারের টাকা দিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো প্রকল্প করতে দেই না। রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকল্পেই সরকার দেশের টাকা খরচ করে না। তবে রোহিঙ্গারা যখন নির্যাতিত হয়ে প্রথম বাংলাদেশে আসে, তখন দেশের টাকা খরচ করা হয়েছিল কিছু কাজে। তারপর থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ-সংস্থার কাছ থেকে। বিশ্ব ব্যাংক যেটা দিয়েছে, সেটাও রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংক যে টাকাগুলো দেয়, তা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেয়। কখনও ওই সময়ের মধ্যে তাদের দেয়া টাকা খরচ না হলে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হয়। তখন বিশ্ব ব্যাংক ওই টাকা বসিয়ে রাখে না। তখন তারা বলে যে, এই টাকা অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর করেন। যে প্রকল্প থেকে স্থানান্তর করা হলো, সেই প্রকল্পে আবার যখন প্রয়োজন হবে তখন সেটা তারা আবার দেবে। সুতরাং তারা তো টাকা বসিয়ে রাখবে না। এমনকি বাংলাদেশ যদি খরচ না করতে পারে, তখন এশিয়ার অন্য কোনো দেশে তারা সেই অর্থ শিফট করে। এর অর্থ এই নয় যে, টাকাটা আর পাওয়া যাবে না। যেমন- আমরা সংশোধিত বাজেট যখন করি, যারা বা যে প্রকল্পের টাকা খরচ হচ্ছে না, সেই প্রকল্পের টাকা আরেক প্রকল্পে নিয়ে যাই। এই মিনিস্ট্রির টাকা, আরেক মিনিস্ট্রিতে দিয়ে দেই। এর অর্থ এই নয় যে, ওই প্রকল্প আর টাকা পাবে না। পরবর্তী বছরে পাবে আবার।’

বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগ রয়েছে এমন আরেকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- (এডিবি)। সংস্থাটি এ দেশে বাস্তবায়নাধীন কোনো প্রকল্প থেকে অর্থ প্রত্যাহার করে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যয় করছে কি-না, জানতে চাইলে এডিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা গবিন্দ বার বলেন,‘অন্য কোনো প্রকল্প থেকে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় আমরা ঋণ স্থানান্তর করিনি। এ সঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করার জন্য আমরা ১০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান হিসাবে দিয়েছি। একটা নতুন প্রকল্প করে ফ্রেশ অনুদান দিয়েছি। আমরা কোনো শিফট করি না।’

শেয়ার করুন: