ইরান

ইরানের বিক্ষোভে নিহত ১০৬: অ্যামনেস্টি

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ইরানে কয়েকদিন ধরে চলা বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা গোটা দেশের ১০৬ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে এই তথ্য দিয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আলজাজিরা।

মঙ্গলবার এ নিয়ে বিবৃতি দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তাতে মানবাধিকার সংগঠনটি গত শুক্রবার শুরু হওয়া বিক্ষোভে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত ও প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ তুলে বলেছে, ‘বিশ্বস্ত প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গোটা দেশের ২১টি শহরে অন্তত ১০৬ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন।’

তারা আরও জানায়, ‘বিক্ষোভকারী নিহতেদর প্রকৃত সংখ্যাটা আরও বেশি। কিছু কিছু প্রতিবেদন তো বলছে যে অন্তত ২০০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন।’ তবে মঙ্গলবার অ্যামনেস্টি এমন দাবি করলেও ইরান সরকারের পক্ষ থেকে এই বিবৃতির বিরুদ্ধে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

আলজাজিরা বলছে, ইরানের বিক্ষোভে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে তাদের হাতে আসা সর্বশেষ তথ্যমতে গত পাঁচ দিনে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে পাঁচজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং বাকি ছয়জন বেসামরিক নাগরিক। তবে ইরান সরকার বিক্ষোভে হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানায়নি।

কিন্তু ইরানের আধাসরকারি বার্তা সংস্থা আইএসএনএ গত সোমবারের এক প্রতিবেদনে জানায়, রাজধানী তেহরানে পাশে বিক্ষোভকারীদের মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনীর তিনজন সদস্য নিহত হয়েছেন। একইদিনে ইরান সরকারের মুখপাত্র দাবি করেন যে, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে গোটা দেশের পরিস্থিতি এখন শান্ত।

মানবাধিকার কর্মী ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ইরান বিষয়ক গবেষন রাহা বাহরেইনি বলেন, ‘মূলত বিক্ষোভে অংশ নেয়া প্রত্যক্ষদর্শী, দেশটিতে অবস্থানরত মানবাধিকারকর্মী, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইরানের বিক্ষোভে নিহতের এই সংখ্যা আমরা জানতে পেরেছি।’

লন্ডনে অবস্থানরত ওই মানবাধিকারকর্মী আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের হাতে আসা এসব তথ্য বলছে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী গোটা দেশে বিচারবহির্ভূতভাবে এত মানুষকে হত্যা করেছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে যে, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে যারা নিহত হচ্ছেন তাদের লাশও পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া হচ্ছে না।’

গত শুক্রবার ইরান জ্বালানি তেলের দাম ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে। সরকার এমন ঘোষণা দেয়ার পর গোটা দেশে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, একদফায় জ্বালানি তেলের এত মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য বিশাল এক চাপ। তবে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, তিনি সরকারের এই সিদ্ধান্তের পক্ষে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, গাড়িতে চালক বসে থাকা অবস্থায় তাতে ভাঙচুর চালাচ্ছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন ভবনের ছাদ থেকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে স্নাইপার দিয়ে গুলি ছোড়া হচ্ছে। শুধু ছাদ নয় একবার হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছুড়তে দেখা যায়।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিক্ষোভকারীরা ইরান সরকারের নেতাদের ছবিতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন এবং ধর্মীয় নেতাদের পদত্যাগ দাবি করছেন। একইসঙ্গে সেসব ভিডিও ফুটেজে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হতেও দেখা যায়।

বিক্ষোভ শুরুর পরদিন থেকেই বিক্ষোভ যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তাই দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। কর্তৃপক্ষের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, গত শুক্রবার শুরু হওয়া বিক্ষোভ থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও শত শত বিক্ষোভকারী।

বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে দমনে নানা পন্থা অবলম্বন ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ইরান সরকারের সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিসহ সরকার ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ইরানের বিরুদ্ধে কূটচাল চালছে শত্রুপক্ষরা।

আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, দেশে ও দেশের বাইরে ইরানের যেসব শত্রু ও বিরোধী রয়েছে তারাই চক্রান্ত করে এই অন্তর্ঘাতমূলক বিক্ষোভে উসকানি দিচ্ছেন। তিনি সরকারি সিদ্ধান্তের পক্ষে থেকে বিক্ষোভকারীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নিরাপত্তার বিষয়টি সরকার দেখবে সাধারণ মানুষ নয়।

যুক্তরাষ্ট্র বিক্ষোভকারীদের সমর্থনের ঘোষণা দেয়ার পর ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার সমালোচনা করেছেন। এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বিক্ষোভ দমনে ইরান সরকারের সমালোচনা করে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আপনাদের সঙ্গে আছে।’

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মুসাভি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যকে ভন্ডামি অভিহিত করে বলেছেন, ‘গত বছর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ইরানের অর্থনীতিসহ সাধারণ নাগরিক নানা রকম সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। আর এখন তারা পাশে আছি বলে ভন্ডামি করছেন।’

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার ইরান সরকার প্রতি লিটার পেট্রলের মূল্য ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার রিয়াল করার ঘোষণা দিলে এ বিক্ষোভ শুরু হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, মাসে প্রতিটি ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য ৬০ লিটার জ্বালানি বরাদ্দের কথা জানিয়ে নির্ধারিত পরিমাণের বাইরে পেট্রল কিনতে চাইলে প্রত্যেক লিটারের মূল্য ৩০ হাজার রিয়াল করা হয়।

শেয়ার করুন: