আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

বিএনপির নৌকা থেকে কারা নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বিশ্বে একটি প্রবচন প্রচলিত আছে। নৌকা যখন ডোবে, তা সবার আগে টের পায় ইঁদুর। ইঁদুর যখন নৌকা থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন মাঝি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারে নৌকা ডুবছে। এই নজিরটি টেনে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘আপনারা জেনে রাখুন, পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ চিরদিনের জন্য ডুবছে। দেখছেন, মুসলিম লীগ থেকে ইঁদুররা কিভাবে দল ছাড়ছে।’ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের চরম পরাজয়ের পর দল থেকে অনেক ছোট-বড় নেতার পদত্যাগের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। তা দেখে মওলানা ভাসানী এ কথা বলেছিলেন।

বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে একই দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। মিডিয়ায় বিএনপির অনেক তৃণমূল নেতাকর্মী দল ছাড়ছেন—এই খবর পড়েছি। কিন্তু দলের পালের গোদাদের মধ্যেও ভাঙন দেখা দিয়েছে, তা জানতাম না। মওলানা ভাসানী আজ বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, ‘বিএনপির জাহাজ ফুটো হয়েছে। তাই ইঁদুররা আগে লাফিয়ে বের হয়ে আসছে।’ মওলানা সাহেবের মতো কোনো দলের নেতাদের ইঁদুর বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। তাতে বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির তরি ডুবছে।

বিএনপির দুজন শীর্ষ নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন বহু আগেই। এই খবর চেপে রাখা হয়েছিল। এখন লুকানো খবর জানাজানি হতেই বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এঁদের বয়স হয়েছে, দলের কাজে আর সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এ জন্য তাঁরা দল ছেড়েছেন।

বিএনপি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেয়েছিল, পারেনি। সত্যের বাজনা আপনি বাজে। বৃদ্ধ হয়ে কোনো নেতা দলের কাজ করতে না পারলে তিনি ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি ছাড়েন। দল ছাড়ার কথা বলেন না। এখানে বিএনপির দুই নেতা মোরশেদ খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.) দুজনেই দলের বর্তমান অবস্থা দেখে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। দল সেই পদত্যাগের কথা চেপে রাখতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত চেপে রাখা যায়নি।

পদত্যাগকারী দুজন নেতার একজন লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.) ঢাকার একটি কাগজকে জানিয়েছেন, দলের নেতার সঙ্গে মতানৈক্যের জন্য তিনি দল ছেড়েছেন। দুই মাস আগে তিনি পদত্যাগ করেন। বিএনপি তা চেপে রেখেছিল। সেপ্টেম্বর মাসে দলের ভারপ্রাপ্ত নেতা তারেক রহমানের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই মতানৈক্যের জন্ম। ওই সেপ্টেম্বর মাসে তারেক রহমান লন্ডনে দলীয় সভায় বলেন, ‘তাঁর পিতা জেনারেল জিয়াউর রহমান হচ্ছেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পিতা।’

মাহবুবুর রহমান এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশে জাতির একজন পিতার আসনে বসানোর চেষ্টা করা ঠিক নয়। ইতিহাস বিকৃত করে তারেক নিজের বাবাকে জাতির পিতা বানানোর অপচেষ্টা করছেন। তাতে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে এবং জাতিকে একটি ভয়ংকর সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’

সেনাবাহিনীর এই সাবেক প্রধান (পরে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন) তাঁর বক্তব্যে স্বীকার করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে তিনি জাতির পিতা মনে করেন। এটা শুধু মাহবুবুর রহমান নন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন অনেক নেতাই স্বীকার করেন। কিন্তু তারেক রহমানের ভয়ে মুখ ফুটে কথাটা বলতে পারেননি। মাহবুবুর রহমান এখন প্যানডোরা বাক্সের ডালা খুলে দিলেন। তাঁর পদাঙ্ক আরো অনেক নেতা অনুসরণ করবেন।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল, এখন বিকল্পধারার নেতা ড. বি. চৌধুরীও মুখে যা-ই বলুন, মনে মনে বঙ্গবন্ধু যে জাতির পিতা এই সত্যটি মানেন। তাই বিএনপির মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি হয়েই তিনি জিয়াউর রহমানের কবর নয়, জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটেছিলেন এবং তারেক রহমানের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তারেক তাঁকে অসম্মান করে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে তাড়িয়েছিলেন।

তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্বে বসে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতিদের কোলে না নেওয়া পর্যন্ত বিএনপিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বহু নেতাকর্মী ছিলেন। তারেক যাঁদের দলে নিষ্ক্রিয় হতে বাধ্য করেন অথবা দল থেকে তাড়িয়ে দেন। আমার মনে পড়ে, বিএনপির শাসনামলে লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার ডাক্তার ইউসুফ ছিলেন বিএনপিদলীয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন।

তিনি একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব জাতির পিতা—এই জ্বলন্ত সত্যটিকে অস্বীকার করে বিএনপি দেশে রাজনীতি করতে চায়, এটা কী করে সম্ভব? কিছুদিন এভাবে চলতে পারে? আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার মতো লোক কী করে বিএনপিতে এলেন? তিনি বলেছেন, ডাক্তার বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব খুব গভীর। তাঁর অনুরোধ এড়াতে পারিনি।

বিএনপি আসলে একটি এক আদর্শে বিশ্বাসী দল নয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে কিছু ক্ষমতালোভী লোককে নিয়ে দল গঠন করেন। তখন কিছু ভালো লোকও ছিলেন। তারেক রহমান তাঁদের দল থেকে তাড়িয়েছেন। তবু দলটির ভেতরে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি টান রয়েছে এমন নেতা ও কর্মী এখনো রয়ে গেছেন। বিএনপি ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হতেই দুই ধরনের লোক দল ছেড়েছেন। একদল (এঁদের সংখ্যাই বেশি) যাঁরা ক্ষমতার লোভে এসেছিলেন। আরেক দল যাঁরা সংখ্যায় কম, কিন্তু বিএনপিকে একটি প্রকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা চোখের সামনে এখন বিএনপিকে চরিত্রভ্রষ্ট অবস্থায় ডুবতে দেখে ব্যথা পাচ্ছেন এবং দল ছাড়ছেন। এঁদের মধ্যে মাহবুবুর রহমান, মোরশেদ খানকে গণ্য করা চলে।

বিএনপি আদর্শভিত্তিক দল নয়, ক্ষমতাভিত্তিক দল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে না পারায় তাতে বড় ধরনের ভাঙন ধরেছে। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বিএনপি আগামী নির্বাচনেও যদি ক্ষমতায় যেতে না পারে, তাহলে পাকিস্তানে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পরপরই কনভেনশন মুসলিম লীগ যেমন অস্তিত্ব হারিয়েছিল, বিএনপিও তেমনি অস্তিত্ব হারাবে। শুনছি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর জীবনের শেষ খেলা দেখাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। অর্থাৎ খালেদা জিয়ার শিগগিরই মুক্তিলাভের সম্ভাবনা না থাকলে তিনি বিএনপির একটি বিদ্রোহী অংশকে নিয়ে দলছুট বিএনপি গঠন করবেন। এই গুজব কতটা সঠিক, জানি না। তবে মওদুদ আহমদকে যতটা জানি, তাতে তাঁর দ্বারা যেকোনো কাজ সম্ভব। চট্টগ্রাম অথবা কুমিল্লা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে একসময় মওদুদ গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। খালেদা জিয়া সারারাত তাঁর শয্যাপাশে জেগে তাঁর সেবা করেছেন। ঢাকায় ফিরেই মওদুদ বিএনপি ছেড়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে ঢুকে মন্ত্রী হয়েছিলেন।

বস্তুত বিএনপির জন্ম কোনো আদর্শকে ভিত্তি করে নয়। জিয়াউর রহমান এককালে পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের জুনিয়র অফিসার ছিলেন। বাংলাদেশে বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করেই তিনি পাকিস্তানের এই গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্যে বিশেষ উদ্দেশ্যে দল গঠন করেন। এই বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল—এক. বাংলাদেশে আইয়ুবের কায়দায় গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করা। দুই. নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধ্বংস করা। তিন. বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যা করে বাংলাদেশে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধ্বংস করা। চার. বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক সমাজতন্ত্রী ধাঁচের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করা।

বিএনপিকে এই ভৌতিক রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত করে কেউ যদি সুনির্দিষ্ট আদর্শভিত্তিক (হোক তা রক্ষণশীল ডানপন্থী কর্মসূচি) রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করতে পারতেন, তারেকের কবল থেকে মুক্ত করতে পারতেন, তাহলে বিএনপি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হতো। তাঁকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে হতো না। রাজনীতির অন্ধ গলিতে ঢুকে অস্থিত্ব হারানোর আশঙ্কায় ভুগতে হতো না।

মোরশেদ খান, মাহবুবুর রহমানের মতো নেতারা দল ত্যাগ করেছেন। সন্দেহ নেই, আরো অনেকে করবেন। হয়তো করেছেন। কিন্তু বিএনপি তা চেপে রেখেছে। বিএনপির বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় নীতি ও নেতৃত্বের বদল। চক্রান্ত ও সন্ত্রাসের সঙ্গী জামায়াতকে ছেড়ে, তারেকের মতো সিন্দবাদের দৈত্যকে কাঁধ থেকে তাড়িয়ে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি নয়, প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে এবং প্রকৃত রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে মাঠে নামলে বিএনপি এখনো অস্থিত্ব ফিরে পেতে পারে। ইতিহাসের বাস্তবতা ও সত্যতাকে অস্বীকার করে রাজনীতি করতে চাইলে বিএনপি বাংলার মাটিতে অস্তিত্ব হারাবে।

শেয়ার করুন: