রাজধানীতে ক্লাব ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে একটি নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। নামটি হচ্ছে- ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। তিনি ঢাকার ক্লাবগুলোতে যাতায়াতকারীদের কাছে ক্যাসিনো সম্রাট হিসেবে পরিচিত। রাজধানীর বেশ কয়েকটি ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালিত হচ্ছে তার ইশারায়। তার শেল্টারে জুয়াড়িরা এখানে গভীর রাত অবধি জুয়া ও নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত বুধবার রাজধানীর ইয়াংমেনস ক্লাবে অভিযানের পর ক্লাবটির মালিক যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে র্যা ব। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের ডান হাত হিসেবে পরিচিত। তাকে গ্রেফতারের পর দু-একদিন সম্রাটকে কাকরাইলের অফিসে দেখা গেলে এর পর থেকে তিনি লাপাত্তা।
ক্যাসিনো সম্রাটের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। সম্রাট কোথায় এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর হয়ে গেছে। কেউ বলছেন আত্মগোপনে রয়েছেন, কেউ বলছেন খালেদ মাহমুদের গ্রেফতারের পর ছয় দিন কাকরাইলের কার্যালয়েই অবস্থান করেন এই ক্যাসিনো সম্রাট। পুলিশ বলছে, যুবলীগ নেতা সম্রাট এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে আছেন। তাকে গ্রেফতারের কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সম্রাটের অবস্থান নিয়ে মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। খালেদের পরই সম্রাটের গ্রেফতারের গুঞ্জন ছিল। কিন্তু এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় একেকজন একেক ধরনের কথা বলছেন। যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, খালেদ গ্রেফতারের পর নড়ে বসেন সম্রাট। গ্রেফতার এড়াতে নানা মহলে লবিং শুরু করেন। যুবলীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বোঝাতে চান যে, তাকে ছাড়া ঢাকায় যুবলীগের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মতো কেউ নেই। এভাবে তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই এসব করেন সম্রাট।
সম্রাটের অবস্থান নিয়ে কেউ বলছেন, গ্রেফতার আতঙ্কে নেতাকর্মীবেষ্টিত হয়ে কাকরাইলে ভূঁইয়া ম্যানশনে তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে টানা ছয় দিন অবস্থান করেন। সেখানে শতাধিক যুবক তাকে পাহারা দেন। সেখানে সবার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
ওই সূত্রটির দাবি, যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের পরামর্শে সম্রাট বাসায় না থেকে ব্যক্তিগত কার্যালয়ে অবস্থান করেন। পরে মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর মনোভাব বুঝতে পেরে গা ঢাকা দেন সম্রাট।
কেউ বলছেন বর্তমানে নিরাপদ কোনো স্থানে আত্মগোপনে আছেন ক্যাসিনো সম্রাট। তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা। পাশাপাশি তার সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
একটি সূত্র দাবি করছে, ঢাকার ক্লাবগুলোতে অবৈধ ক্যাসিনোর সঙ্গে যুবলীগ নেতাদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশ্যে আসার পরই ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গেছেন আত্মগোপনে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতির খোঁজ মিলছে না কোথাও; কার্যালয়েও যাচ্ছেন না, বাড়িতেও পাওয়া যাচ্ছে না বলে যুবলীগের কর্মীরা জানিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্রাট পুলিশের নজরদারিতে রয়েছেন। তিনি ঢাকাতেই আছেন। সম্রাটের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, সবাই সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছেন।
যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা জানান, সম্রাট কিছুটা চাপে আছেন। তাকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হবে কিনা, বিষয়টি এখনও তিনি নিশ্চিত নন। তবে তাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে চাপ বাড়ছে। এ কারণে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন তিনি।
এদিকে ক্যাসিনোকাণ্ডে অভিযুক্ত সম্রাটের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। গত রোববার এ-সংক্রান্ত একটি আদেশ দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া সম্রাটের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্রাটের গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার সাহেববাজার এলাকায়। তিনি প্রয়াত ফয়েজ উদ্দিন চৌধুরীর ছেলে। সম্রাট যুবলীগে খুবই প্রভাবশালী এক নেতা। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বিগত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
পরবর্তী কাউন্সিলে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই সভাপতি নির্বাচিত হন। এর পর থেকে যুবলীগের গুরুত্বপূর্ণ এ ইউনিটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। যুবলীগের দিবসভিত্তিক কর্মসূচি এবং রাজধানীতে আওয়ামী লীগের জনসভাগুলোতে সবসময়ই বড় শোডাউন থাকত সম্রাটের লোকজনের।
যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী সম্রাটের নেতৃত্বাধীন যুবলীগের এ ইউনিটকে ‘শ্রেষ্ঠ সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণাও দিয়েছেন।
আলোচিত এ সম্রাট মাসে অন্তত ১০ দিন সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলেন। এটি তার নেশা। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ থেকেও আসেন জুয়াড়িরা। সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত।
প্রথমসারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থাও আছে। সিঙ্গাপুরে গেলে সম্রাটের নিয়মিত সঙ্গী হন যুবলীগ দক্ষিণের নেতা আরমানুল হক আরমান, মোমিনুল হক সাঈদ ওরফে সাঈদ, সম্রাটের ভাই বাদল ও জুয়াড়ি খোরশেদ আলম। এদের মধ্যে সাঈদ কমিশনারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চললেও গডফাদার হিসেবে পরিচিত সম্রাটকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না- এ প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্ট প্রায় সবার। সোমবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, গডফাদার-গ্র্যান্ডফাদার বলতে কিছু নেই। আমরা চিনি অপরাধীকে। অপরাধী যে বা যারাই হোক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।