জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কিংবা ২০ দলীয় জোট কোনোটি রক্ষার বিষয়েই এখন আর খুব একটা গরজ নেই বিএনপির। বরং দলটির মনোভাব হলো—যার ইচ্ছা চলে যাক ঠেকানোর কিছু নেই।
বিএনপি মনে করে, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রায় সব বিরোধী দলই সংকটের মধ্যে আছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়ার অর্থ সরকারকে সুযোগ করে দেওয়া। জোটভুক্ত দলের নেতারা এটি না বুঝলে জোর করে তাঁদের জোটে রাখা অর্থহীন বলেও মনে করেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতে দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই সংকটের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় নিজেদের ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার অর্থ সরকারকে সুযোগ করে দেওয়া।’
তিনি আরো বলেন, ‘২০ দলীয় জোট এবং ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের এটি বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। কারণ বিভেদ কোনো ফল বের করে আনার সুযোগ দেয় না।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘তারা (জোটভুক্ত দল) নিজেদের সিদ্ধান্তে বিএনপির সঙ্গে জোটে এসেছে, আবার নিজেরাই চলে যাচ্ছে, বিএনপি তো তাদের বের করে দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে জোর করে আনিনি, আবার কাউকে জোর করে বেরও করে দিইনি। কিন্তু আমার প্রশ্ন, তারা এখন কোথায় যাবে? আওয়ামী লীগে? যদি না পারে তাহলে নিজেরা কিছু করুক।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গত বুধবার বলেন, ‘বর্তমান অস্থির সময়ে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি প্রবল। কিন্তু বিএনপি এটি বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না।’
জানা গেছে, উভয় জোটে অস্থিরতার মধ্যেও কোনো দলকে জোটে রাখার তৎপরতা নেই বিএনপিতে। কারণ সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়েই অনেকে জোট ছাড়বে এটি ভাবনায় ছিল দলটির। আবার তৃতীয় শক্তির প্রেক্ষাপট রচিত হতে পারে—এমন সম্ভাবনা থেকেও কেউ কেউ জোট ছাড়তে পারেন বলে মনে করে বিএনপি। তা ছাড়া জোট শরিকদের অনেকে এখনই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচির পালনের পক্ষে। কিন্তু বিএনপি মনে করে, সর্বশেষ নির্বাচনের পর উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতিতে সেটি আর সম্ভব নয়। ফলে আপাতত ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পক্ষে দলটি।
গত ৮ জুলাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার ঘোষণা দেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। এর আগে গত ৬ মে ২০ দলীয় জোট ছেড়ে চলে যায় ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থর বিজেপি। অন্যদিকে সংসদে যোগদানের বিরোধিতা এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে না—এমন অভিযোগ তুলে গত ২৭ জুন আলাদা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের ঘোষণা দেন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ড. অলি আহমদ।
জোটের শরিক কল্যাণ পার্টি, জাগপাসহ ছোট কয়েকটি দল ওই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বিএনপি এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য গত সপ্তাহে অলি আহমদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল বিএনপি মহাসচিবের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর যাওয়া হয়নি।
এদিকে আন্দালিব পার্থকেও বিএনপির দায়িত্বশীল কোনো নেতা ফোন করে জোটে থাকতে বলেননি। আর কাদের সিদ্দিকীর ভূমিকা নিয়ে প্রথম থেকেই সন্দিহান ছিল বিএনপি। ফলে তাঁর দলের সর্বশেষ অবস্থান জানার পরও বিএনপি তাঁকে নিবৃত করার চেষ্টা করেনি। বিএনপি স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘কাদের সিদ্দিকী সব সময়ই আনপ্রেডিক্টেবল। তিনি জোটে থাকবেন না এটি হিসাবের মধ্যেই ছিল।’
এ বিষয়ে এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বিদেশ থেকে বলেন, ‘বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে শরিকরা কেন চলে যাচ্ছে সেটি বিএনপি ভালো বলতে পারবে। তবে আমার মনে হয়, শরিকদের কারো কারো বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছিল না। আমার পৃথক মঞ্চ এবং আন্দালিব রহমান পার্থ ও কাদের সিদ্দিকীর চলে যাওয়াটা ভিন্ন বিষয়।’
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, “আমার মত হলো, বিএনপি নির্জীব অবস্থায় আছে। তাদের কোনো শক্তি নেই। তাই তারা শরিকদের আটকাতে পারছে না। তা ছাড়া লন্ডন থেকে বোধ হয় কোনো ‘ওহি’ আসছে না।” তিনি আরো বলেন, ‘এ কথা তো সত্যি যে গত সাত মাসে আমরা কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারিনি। তাই শরিকদের মধ্যে হতাশা আসা স্বাভাবিক।’
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘ফ্রন্ট গঠনের এক মাস পরে কাদের সিদ্দিকী সাহেব যোগদান করে আবার ধৈর্য না ধরে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর মনে রাখা দরকার ছিল যে এখন একটা অস্থির সময় এবং সরকারি ও বিরোধী দল সকলেই অস্থিরতার মধ্যে আছে। ফলে রাজনীতি গতিশীল হতে সময় লাগবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপিকেও এ জন্য সময় দিতে হবে। তা ছাড়া সব কিছু বিএনপি কেন করবে? উনি নিজেও কিছু দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। শুধু অন্যকে দোষ দিয়ে চলে গেলেই হলো না।’
গত ৯ মে সংবাদ সম্মেলন করে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন কাদের সিদ্দিকী। কিন্তু তাঁকে ফ্রন্টে রাখার জন্য বিএনপি কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন ফোন করলেও নির্ধারিত বৈঠকে যোগ না দেওয়ায় কাদের সিদ্দিকী ক্ষুব্ধ হন।
যদিও গত বছর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনকালে সিদ্দিকী ছিলেন না। নির্বাচনের আগে তিনি ফ্রন্টে যোগ দেন। এর আগে যুক্তফ্রন্ট গঠনকালেও যোগ দেননি তিনি। ফলে রাজনৈতিকভাবে তাঁর বিষয়ে বিএনপিতে কখনোই আস্থা দৃঢ় ছিল না।
তবে বিজেপি ১৯৯৯ সাল থেকে বিএনপির সঙ্গে ছিল। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত এমপিদের সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হতে পারা এবং মনোনয়নের সময় যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ২০ দলীয় জোট ছেড়েছেন পার্থ। তবে এখনো প্রকাশ্যে বিএনপির বিষয়ে কোনো বিষোদগার করেননি তিনি।
বিএনপি নেতাদের মতে, সেই তুলনায় অলি আহমদ প্রকাশ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে নির্বাচনের সময় ‘টাকা নেওয়া’র অভিযোগ তুলেছেন। শুধু তাই নয়, বিএনপির নেতৃত্বদানের বিষয়েও তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ফলে ভেতরে ভেতরে বিএনপি তার ওপর প্রচণ্ড রুষ্ট বলে জানা যায়।