ইয়াবা কারবার করে এখন দালানকোঠায়ও ঘুম নেই

কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিতি রয়েছে নাজিরপাড়া গ্রামের। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের এই গ্রামটি নাফ নদের তীরবর্তী হওয়ায় একসময় দেদারছে চলেছে ইয়াবা কারবার।

ইয়াবার ছোবল থেকে বাদ পড়েনি এই গ্রামের কোনো মানুষ। কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ একসাথে যে যার মতো চালিয়ে গেছে ইয়াবা কারবার। লজ্জাশরম বাদ দিয়ে পিতা-পুত্র মিলে ইয়াবা কারবার করতেও দ্বিধা নেই এই গ্রামের মানুষের। ঝাঁকের কৈ-এর মতো পিতা, মাতা, পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী এমনকি নারীরাও একে অপরকে সহায়তা করত এই কারবারে। তাই কোটিপতি হতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি এই গ্রামের মানুষকে।

একসময় দিনদুপুরেও এই গ্রামে যেতে মানুষ ভয় পেত। সেসময় ইয়াবা কারবারিদের আধিপত্য ও দাম্ভিকতায় ভয়ের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল নাজিরপাড়া। সেখানে গেলে ইয়াবা কারবারিরা যে কাউকে প্রশাসনের লোক বা সাংবাদিক ভেবে অগত্যা লাঞ্ছিত করতো, মারধর করতো। হামলার আশঙ্কা থেকে ভয়ে কোনো সাধারণ মানুষ তখন ওই গ্রামে যেতে চাইত না। নাফনদ তীরের সেই ইয়াবা গ্রামটিই এখন বলতে গেলে পুরুষশূন্য। এমনকি নাজিরপাড়ায় এখন মৃতের দাফনকাজ করার মতো কোনো যুবক বা পুরুষও নেই।

এসব প্রসঙ্গে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, আমরা সীমান্তের প্রতিটি ইয়াবা বাড়ি এবং প্রতিটি ইয়াবা পাড়ায় হানা দেব। ইয়াবা কারবারিরা যতদিন পর্যন্ত কারবার না ছাড়বে ততদনি ধরেই চলবে অভিযান। এককথায় তাদের নাস্তানুবাদ করেই ছাড়ব।

পুলিশ সুপার বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, দেশকে মাদকমুক্ত করতে আইনের প্রয়োগে যেরকম কঠোরতার দরকার সেটুকুই করা হবে।

একসময় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা নাজিরপাড়া গ্রামের প্রায় মানুষ ইয়াবার স্পর্শে এসে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। ইয়াবার বদৌলতে অবৈধপথে উপার্জন করেছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে এই গ্রামের এক সময়ের পিঠা বিক্রেতা, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফেরিওয়ালা- তারাও কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। নুন আনতে পান্তা পুরায় অবস্থা যাদের, ইয়াবার উপার্জনে তাদের অনেকেই করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। কেউ কেউ সম্পদ দৃশ্যমান হওয়ার আশঙ্কায় আলিশান বাড়ি করার পরিবর্তে কিনে রেখেছেন কোটি কোটি টাকার জায়গা জমি। ওই সময় দিনের নাজিরপাড়ার চেয়ে রাতের নাজিরপাড়া ছিল আলোয় ঝলমল। আলিশান অট্টালিকা ও ইয়াবা কারবারিদের ভিটেবাড়ি রাতের ঝলমলে আলোতে ঝিকঝিক করতো।

ইয়াবা কারবারের টাকায় নাজিরপাড়ার মানুষ তাদের নিজেদের জীবনের সুখ সাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যয় করেছে কোটি কোটি টাকা। শক্তি সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে অনেক ইয়াবা কারবারিরা স্বশস্ত্র গুণ্ডা বাহিনীও লালন করেছে ওই গ্রামে। ইয়াবা ঘাটের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে সেখানে।

দীর্ঘ সময় ইয়াবার প্রবেশদ্বার বা ইয়াবা গ্রাম হিসেবে পরিচিত নাজিরপাড়ার দৃশ্য এখন অনেকটাই পাল্টেছে। ইয়াবা কারবারের ভরমৌসুমে এসে এ গ্রামের ইয়াবা কারবারিদের ভিত ভাঙতে 'চিনে জোঁকের' ভূমিকায় অবতীর্ণ হন টেকনাফ থানা পুলিশের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। পুলিশের উপর্যূপরি অভিযানে শেষ পর্যন্ত ভিত নড়বড়ে হয়ে যায় নাজিরপাড়ার ইয়াবা কারবারিদের। সেদিনের আলো ঝলমলে গ্রামটি এখন প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে ভূতের রাজ্যে পরিণত হয়েছে।

বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি করা ইয়াবা কারবারির তালিকায় নাজিরপাড়ায় অন্তত ২০ জনের নাম রয়েছে। এদের মধ্যে চারজন পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন এবং আত্মসমর্পণ করেছেন সাতজন। এ ছাড়া সরেজমিনে ওই গ্রামে আরো অর্ধশতাধিক শীর্ষ ইয়াবা কারবারির নাম জানা গেছে। তারা এখন পুলিশের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে।

ইয়াবা কারবারের মাধ্যমে অর্থ ও শক্তির আধিপত্য বিস্তারকারী নাজিরপাড়া গ্রামের প্রতাপশালীরা এখন ঘরছাড়া হয়ে পড়েছে। তাদের কেউ এখন নিজেদের আলিশান ঘরে ঘুমাতে পারছে না। আত্মীয়স্বজনদের মরা মুখ দেখতেও তারা এলাকায় আসতে পারছেন না। নিজেদের অপকর্মের বেড়াজালে নিজেরাই আটকা পড়েছে। সরকার ঘোষিত মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কারণে এ গ্রামের কোটিপতি ইয়াবা কারবারিদের স্বপ্নযাত্রা যেন এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। তবে তাদের মধ্যে ইয়াবা কারবারি মৌলভী নুরুল হক ভুট্টো নামের একজন ছাড়া বাকিদের সম্পদ জব্দ না হওয়ায় তারা পরিস্থিতি বুঝে আবারও এলাকায় এসে ইয়াবা কারবারে বিনিয়োগ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত কয়েকদিন ধরে সরেজমিনে গ্রাম ঘুরে জানা যায়, দুই শতাধিক পরিবারের বসতির নাজিরপাড়া গ্রামের প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই রয়েছে ইয়াবা কারবারি। কোন কোন পরিবারে বাড়ির সব পুরুষ সদস্যই ইয়াবা কারবারের বড় গডফাদার। ইয়াবা সাম্রাজ্যখ্যাত নাজিরপাড়ার সবচেয়ে বড় ইয়াবা গডফাদারের নাম ছিদ্দিক আহমদ। বাবার সঙ্গে ইয়াবা কারবার সামাল দিয়ে ছেলে ফরিদ আহমদও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

নাজিরপাড়া গ্রামের অন্য গডফাদারদের মধ্যে এজাহার মিয়ার ছেলে নুরুল হক ভুট্টো, তার ভাই নূর মোহাম্মদ মংগ্রী ও খোকনও রয়েছেন। ভুট্টোর রয়েছে আলিশান দুটি বাড়ি এবং কোটি টাকার জায়গা জমি। সর্বশেষ গত ১ জুন আদালতের নির্দেশে পুলিশ তার বাড়িসহ প্রায় ৩৫ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করেছে। এর আগে তার ভাই নূর মোহাম্মদ মংগ্রীও পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন। ভুট্টোর বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে মামলাও হয়েছিল। বর্তমানে এই ইয়াবা কারবারি ও সন্ত্রাসী এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে বলে জানা যায়।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করেছেন নাজিরপাড়ার শীর্ষ সাত ইয়াবা কারবারি। এরা হলেন এনামুল হক ওরফে এনাম মেম্বার, সৈয়দ হোসেন, জামাল হোসেন, আব্দুর রহমান, জাফর আলম, মো. রফিক, মো. হেলাল। এ ছাড়া পুলিশের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' জিয়াউর রহমান, কামাল হোসেন, দুদু মিয়া এবং নূর মোহাম্মদ মংগ্রী নামের চার ইয়াবা কারবারি নিহত হয়েছে। এই ১১ জন ইয়াবা কারবারি ছাড়াও অনুসন্ধানে পাওয়া প্রায় ৭০ জনের অধিক বড়মাপের ইয়াবা কারবারির নাম। তারা দেশেই আত্মগোপন করে আছেন।

আত্মসমর্পণের বাইরে থাকা নাজিরপাড়ার যেসব বড় ইয়াবা কারবারি রয়েছেন এরা হলেন ছিদ্দিক আহমদ, ফরিদ আহমদ, নুরুল হক ভুট্টো, খোকন, মো. আলী, মো. আয়ুব, সৈয়দ আলম, নূর আজিজ মিয়া, মো. ইসমাইল, জসিম উদ্দীন, নূরু, আকতার, আমির হোসেন, জাফর আলম, মো. রাশেদ, মো. রফিক, কালু মিয়া, শাহাব মিয়া শাফু, নুরুল ইসলাম, নূরুল আলম, ফরিদ আলম, আব্দু শুক্কুর , মোস্তাক আহমদ, কামাল হোসেন, আবুল কালাম, ধইল্যা, মো. আয়ুব, জাফর আহমদ, সৈয়দ আলম, জাফর আলম, ভুলু, জামাল হোসেন, নুরুল আলম, মো. আলমগীর, নবী উল্লাহ, মিয়া, জসিম উদ্দীন, সোনা মিয়া, মো. আলম, খোরশেদ আলম, রেজাউল করিম, আব্দুল গফুর, ফিরোজ আহমদ, মো. তকির, সালেহ আহমদ, নূরুল আলম, গুরা মিয়া, আব্দু শুক্কুর প্রমুখ।

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে পুলিশের একের পর এক কার্যকর অভিযানে প্রথম দিকেই ঘর ছেড়ে পালিয়ে ছিটকে পড়ে বড় ইয়াবা কারবারিরা। এরপর ইয়াবা গ্রাম নাজির পাড়াকে টার্গেট করে পুলিশও থেমে থাকেনি। উপর্যুপরি পুলিশের মাদকবিরোধী ওই অভিযানে শেষ পর্যন্ত ঘরছাড়া হয়ে পড়ে নাজিরপাড়ার ইয়াবা গডফাদাররা। ধরা না পড়লেও এ গ্রামের ইয়াবা কারবারিরা কেউ এখন এলাকায় নেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, যে গ্রামে দিন দুপুরে সাধারণ মানুষ কোনো প্রয়োজনে গেলেও ইয়াবা কারবারিরা প্রশাসন বা সাংবাদিক ভেবে তাকে লাঞ্ছিত ও মারধর করতেন, সেই নাজিরপাড়ায় এখন মৃতের দাফন কাজ সারাবার মতো যুবক বা পুরুষ নেই। ইয়াবা কারবারি কোটিপতি ভুট্টোর যে মায়ের গত কয়েক বছরের জীবন কেটেছে ছেলের গড়া রাজ প্রাসাদসম ডুপ্লেক্স বাড়িতে, সেই ভুট্টোর মা এবারের ঈদ করেছে কুড়ে ঘরে। ঈদের আগেই কারবারি ভুট্টোর বাড়িটি জব্দ করার ফলে পরিবারের সদস্যরা অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

টেকনাফ সীমান্তের নাফনদ তীরের নাজিরপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'একসময় হালাল ব্যবসার মতো যে যার মতো করে প্রতিযোগিতা দিয়ে ইয়াবা কারবার করেছে। তখন ঘরে ঘরে ইয়াবা কারবারি সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদের দেখাদেখিতে অর্থের লোভে পড়ে আমার ছেলেটাকে নিষেধ করেও ইয়াবা কারবার থেকে বিরত রাখতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত তাদের পাপের পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে। এ মুহূর্তে তাদের মা-বাপ মারা গেলেও জানাজা, দাফন করার সুযোগও তাদের নেই।'

শেয়ার করুন: