যে বিরোধ মিটবার নয়

একই রাজনৈতিক দল করেন, একই আদর্শে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ, সাপে নেউলে সম্পর্ক। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। কেউ কারো নাম শুনতে পারে না। তাদের বিরোধের খবর জানে না, এমন মানুষ এই দেশে খুঁজে পাওয়া দায়।

কেন তাদের বিরোধ সেটাও কেউ জানে না। কিন্তু এই বিরোধ কখনোই মিটবার নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এমন বেশকিছু ব্যক্তি আছেন, যাদের এই বিরোধ সবাই জানেন। তারা এটাও জানে যে বিরোধ মিটবার নয়। আসুন জেনে নেয়া যাক কার সঙ্গে কার বিরোধ…

সেলিনা হায়াৎ আইভী- শামীম ওসমান: আলী আহাম্মদ চুনকার মেয়ে আইভী। শামীম ওসমান হলেন একেএম শামছুজ্জোহার ছেলে। চুনকা এবং শামসুজ্জোহা দুজনেই নারায়নগঞ্জে আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তাদের অবদানও অনস্বীকার্য। তাদের রক্তের উত্তরাধিকার হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং শামীম ওসমান রাজনীতিতে এসেছেন।

সেলিনা হায়াৎ আইভী এখন মেয়র এবং শামীম ওসমান হলেন সংসদ সদস্য। একই এলাকার এই দুই প্রভাবশালীর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। দুজনার সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে। দুজনে কেউ কারো নাম সহ্য করতে পারে না। তাদের সম্পর্কের এই অবনতি কেন, সেটা কেউ জানে না। নারায়নগঞ্জবাসী মনে করে এই সম্পর্কের অবনতি উত্তরাধিকার সূত্রেই।

অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, চুনকা এবং শামসুজ্জোহার সম্পর্কের তেমন কোন অবনতি ছিল না। দুজনের সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই ছিল। কিন্তু সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে শামীম ওসমানের সম্পর্কের কিভাবে অবনতি হলো, দুই মেরুতে কেন তারা অবস্থান করছে তার পেছনে অনেক বক্তব্য আছে। সেই বক্তব্যে নাই বা গেলাম। কিন্তু তাদের সম্পর্কের যে কোনদিনই উন্নতি হবে না, সেটা জানেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্বয়ং।

কাজী জাফরুল্লাহ চৌধুরী- নিক্সন চৌধুরী: নিক্সন চৌধুরী সরাসরি আওয়ামী লীগ করেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ পরিবারের তিনি একজন সদস্য। নিক্সন চৌধুরী ফরিদপুর থেকে নির্বাচিত এমপি এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি তিন তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও প্রত্যেকবার তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এই দুজনার মধ্যেও মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

জাফরুল্লাহ রাজনীতিতে সবই পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি নির্বাচিত এমপি হতে পারেননি, কারণ হলো নিক্সন চৌধুরী। নিক্সন চৌধুরীর বাড়ি হলো মাদারিপুর।

কিন্তু তিনি মাদারিপুর থেকে ফরিদপুর এসে এই আসনটিকে নিজের করায়ত্ত করেছেন এবং ব্যাপক জনপ্রিয়। তার বক্তৃতায় লক্ষবস্তু একটাই, কাজী জাফরুল্লাহকে আক্রমন করা। কাজী জাফরুল্লাহকে তিনি স্বাধীনতা বিরোধী, পাকিস্তানের এজেন্টসহ নানা রকম অভিযোগে অভিযুক্ত করতে এতটুকু কার্পণ্য করেন না। তাদের দুইজনের সম্পর্কের অবনতির কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জানেন এবং কেউই তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঝুঁকি নিতে রাজি নন।

শাহজাহান খান- আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাছিম: শাহজাহান খান করতেন জাসদ আর বাহাউদ্দিন নাছিম করতেন আওয়ামী লীগ। জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন শাহজাহান খান। শাহজাহান খান আওয়ামী লীগের হয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। মন্ত্রীও হয়েছেন দুদফায়। অন্যদিকে বাহাউদ্দিন নাছিম শেখ হাসিনার সহকারী একাণ্ড সচিব ছিলেন, তারপর এমপি হয়েছেন। এখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। দুজনার বাড়ি মাদারীপুর।

কিন্তু দুজনের সম্পর্ক সাপে নেউলে। কারো কাছে অপরজনের নাম বললেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তার সম্বন্ধে সমালোচনা মূলক বক্তব্য রাখে। বাহাউদ্দিন নাছিম যেমন মনে করেন যে, শাহজাহান খান কখনোই আওয়ামী লীগ করতেন না। সে জাসদ থেকে এসেছে। এরা আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতিকারক। অন্যদিকে শাহজাহান খান মনে করেন, বাহাউদ্দিন নাছিম হলেন জনসমর্থনহীন উড়ে এসে জুড়ে বসা কিছু নেতা।

তাদের দুজনার সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন সময় চেষ্টা তদবির হয়েছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে এবার নির্বাচনে শাহজাহান খান বাহাউদ্দিন নাছিমকে মনোনয়ন বঞ্চিত করেছেন। আবার তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে শাহজাহান খানের মন্ত্রী না হওয়ার পেছনেও বাহাউদ্দিন নাছিমের অবদান আছে বলে অনেকে মনে করেন।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী- নিজাম হাজারী: ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে গুটিকয়েক প্রার্থী পরাজিত হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী। মনে করা হয়, ইকবাল সোবহানের পরাজয়ের পেছনে নিজাম হাজারীরই হাত রয়েছে। নিজাম হাজারী হলেন জয়নাল হাজারীর উত্তরসূরী। যদিও ইকবাল সোবহান চৌধুরী পরাজিত হবার পর সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।

তিনি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু যেটাই করুক না কেন, ফেনীতে তিনি সমালোচিত। ফেনীতে তার অবস্থান অত্যন্ত নড়বড়ে। ফেনীর রাজনীতিতে নিজাম হাজারীই হলো শেষ কথা। মাঝে ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে ফেনীতে যাওয়াই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন নিজাম হাজারী। যদিও সেই বরফ কিছুটা গলেছে।

এবার ইকবাল সোবহান চৌধুরী মনোনয়ন পাননি এবং রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু দুজনার মধ্যে যে সম্পর্কের শীতলতা, তা এতটুকু কমেনি। রাজনীতিতে এরকম বিরোধগুলো একটা দলকে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ করে, তেমন একই আদর্শের অনুসারি হয়ে তারা যদি স্ব- বিরোধী অবস্থানে থাকেন, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরী হয়।

শেয়ার করুন: