খালেদা

বিএনপিতে সমন্বয়হীনতা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ মুহূর্তে বেশ সংকটে আছে বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতেও দলটিতে নেই কোনো সমন্বয়। সংসদে যোগ দেয়া, নারী আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত, বগুড়া উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতারা থাকছেন অন্ধকারে। আবার ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলেও তারা কিছুই জানতে পারছেন না। এ নিয়ে তারা প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

এসব বিষয়সহ নানা ইস্যুতে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূলে সৃষ্টি হয়েছে অনৈক্য ও বিভ্রান্তি। সিনিয়র নেতাদের প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ ও দলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা না থাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে ভর করেছে হতাশা ও ক্ষোভ। অবিলম্বে দলে ঐক্য ও সমন্বয় ফিরে আনার ওপর তাগিদ দিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, দলের এমন সমন্বয়হীনতা দূর ও নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ নিরসনের চিন্তাভাবনা করছেন বিএনপির হাইকমান্ড। ঈদুল ফিতরের পর জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা ডাকা হতে পারে। সেখানে নেতাদের মতামত নেয়া হবে। কারও কোনো ক্ষোভ থাকলে বলার সুযোগ দেয়া হবে। নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মতামত নেয়ার পর দলের পরবর্তী করণীয় চূড়ান্ত করা হবে বলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচিত এমপিদের শপথ, বগুড়া উপনির্বাচনে অংশ নেয়াসহ কয়েকটি ইস্যুতে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই কিছু জানেন না। যার প্রভাব পড়ছে তৃণমূলেও। দ্রুত এসব সমন্বয়হীনতা দূর করা সম্ভব না হলে দলে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

তবে দলের সমন্বয়হীনতা মানতে নারাজ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, কোনো কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতারা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ ছিল।

তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় তা এখন নেই। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দলে কোনো সমন্বয়হীনতা নেই। চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পরামর্শে যৌথ নেতৃত্বেই সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে। তিনি বলেন, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে শুধু দল নয়, সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে বিভক্তি-বিভাজনের চিন্তা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

জানা গেছে, বগুড়া উপনির্বাচনে অংশ নেয়া, সংরক্ষিত নারী আসনে প্রার্থী দেয়া ও তার আগে সংসদে যোগদানসহ সাম্প্রতিক সময়ে দলটির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতাদের মতামত নেয়া হয়নি। কোন প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেয়া হল সেটাও তারা জানেন না। এ নিয়ে তারা ক্ষুব্ধ। দলের অনেক সিদ্ধান্তে বিএনপি চেয়ারপারসনও থাকেন অন্ধকারে।

এমন পরিস্থিতিতে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত কোন প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব সিদ্ধান্তে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার কতটা সায় আছে তা নিয়েও নেতাকর্মীদের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি বগুড়া উপনির্বাচনে তাকে প্রার্থী করার খবর শুনে তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। কারাগারে তার মনোনয়নপত্র স্বাক্ষরের জন্য পাঠালে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। জানতে চান নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কে নিয়েছে। সংসদে যাওয়ার ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটি সংসদে যোগ দেয়।

দলের চেয়ারপারসনের এমন মনোভাব জানতে পেরে সিনিয়র নেতারাও খটকায় পড়েছেন। এ নিয়ে এতদিন সবাই চুপ থাকলেও সম্প্রতি কেউ কেউ মুখ খুলছেন। কেন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার পর আবার সংসদে যাওয়া হল, শপথ না নিয়ে কেনই বা ফের উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ- এসব নিয়ে হাইকমান্ডের কাছে ব্যাখ্যাও চাচ্ছেন কোনো কোনো নেতা। তারা মনে করেন, বগুড়ার উপনির্বাচনে অংশ নেয়ায় জনগণের কাছে ভোট চাইলে অবশ্যই তারা প্রশ্ন করবে কেন শপথ নেয়া হল না। ফের কেন ভোট চাচ্ছেন।

দলটির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য বলেন, সিদ্ধান্ত কি হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আগে থেকেই আমরা একটা কিছু আঁচ করতে পারছি। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ায় নিজেদের গুরুত্বহীন মনে হয়। নেতাকর্মীদের কাছেও আমাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সিদ্ধান্ত আগে নেয়া হলেও অন্তত আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে নিলে ভালো হতো। তাহলে দলে প্রকাশ্যে এমন বিরোধ দেখা দিত না।

দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ যখন হাইকমান্ডের কাছে এমন ব্যাখ্যা চাচ্ছেন ঠিক সেই মুহূর্তে দলের একটি অংশ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পদত্যাগও দাবি করছেন। ব্যর্থতার দায় নিয়ে তাদের সরে যাওয়া উচিত বলে মত দেন। সরকারের কৌশলের বিপরীতে পাল্টা কর্মকৌশল নিতে ব্যর্থতার জন্য বর্তমান স্থায়ী কমিটির নেতাদের দুষছেন তারা।

জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সুপরিকল্পিত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তে দল পরিচালনা করছেন।

তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর করা হচ্ছে। তারেক রহমান বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর সর্বস্তরের নেতাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলছেন। জেলা নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। তাদের যৌক্তিক পরামর্শ গ্রহণ করে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটিগুলো গঠনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনর্গঠন ও সাংগঠনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছেন।

তিনি দাবি করেন, দলে কোনো সমন্বয়হীনতা নেই উল্টো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সুনিপুণ নির্দেশনায় সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে এসেছে নতুন গতি। দলে সৃষ্টি হচ্ছে ইস্পাত কঠিন সুদৃঢ় ঐক্য।

বুধবার জিয়াউর রহমানের ৩৮তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, নির্বাচনের পর দলীয়ভাবে আমরা ফল প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। সংসদকে অনির্বাচিত, অবৈধ সংসদ হিসেবে অভিহিত করেছিলাম।

সে কারণে আমরা এই সরকারের অধীনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি। যারা অংশ নেয় তাদের বহিষ্কার করেছিলাম। কিন্তু হুট করে শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ায় আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

এই বিভ্রান্তি দূর করতে হবে। বিভ্রান্তি দূর করার জন্য সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রতিনিধিসহ জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা ডেকে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে হবে। তিনি আরও বলেন, হঠাৎ করে সংসদে যোগ দেয়ায় সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিএনপির বর্তমান অবস্থান নিয়ে শত শত প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের দিতে হবে।

শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় মওদুদের সুরেই কথা বলেন স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, বিএনপির এমপিদের শপথ গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারি চাপের চেয়ে লোভ বেশি ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সংসদে যাব না। কিন্তু সংসদে গেলাম। এখানেই তো বুঝতে হবে আমাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রবণতা আছে।

জানতে চাইলে বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান বলেন, সম্প্রতি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে এ নিয়ে সমাবেশ বা প্রকাশ্যে না বলাই ভালো। এতে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কারও কোনো অভিযোগ বা ক্ষোভ থাকলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করা উচিত।

তিনি বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বের প্রতি সব নেতাকর্মীর আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের অনুভূতি ধারণ করেই তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই।

শেয়ার করুন: