২৫ কোটি টাকার বাড়ির মালিক ভ্যানচালক!

আদালতের নির্দেশে টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসায়ী পিতা-পুত্রের অবৈধভাবে অর্জিত প্রায় ২৫ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কক্সবাজার পুলিশ সুপারের পক্ষে টেকনাফ থানা পুলিশ জব্দ করেছে।

আজ শনিবার (১ জুন) সকাল ১০টা হতে বিকেল ৩টা পর্যন্ত টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ প্রদীপ কুমার দাশ-বিপিএম (বার) এর নেতৃত্বে একদল পুলিশ এক সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ইয়াবা বিক্রি করে অর্জিত এ অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দ করা হয়।

ক্রোককৃত সম্পদের মধ্যে দুটি আলিশান দালান, ৮ টি পৃথক তফসিলের মূল্যবান জমি রয়েছে। বিষয়টি টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ নিশ্চিত করেছেন।

ওসি প্রদীপ কুমার দাশ জানান, শনিবার দীর্ঘ ৫ ঘন্টা অভিযান চালিয়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দকৃত সম্পদের মূল্য ২০ কোটি টাকা থেকে ২৫ কোটি টাকা হতে পারে। সুরম্য দালান ও জমিগুলো আদালতের রায় অনুযায়ী পুলিশ সুপারের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা হয়ে হয়েছে এবং অস্থাবর সম্পদ সমুহ সিজার লিস্ট করে শনিবার থানার গোডাউনে নিয়ে আনা হয়েছে।

প্রদীপ কুমার দাশ আরও জানান, আদালতের নির্দেশে শনিবার সকালে তিন ইয়াবা কারবারির বিলাসবহুল দুটি বাড়িসহ সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এই বাড়িগুলো এখন পুলিশের হেফাজতে থাকবে। আদালতের নির্দেশে পরবর্তীতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

যাদের বাড়ি ও মালামাল জব্দ করা হয়েছে তারা একসময় ভ্যানচালক ছিলেন। বর্তমানে তারা কোটি কোটি টাকার মালিক। ইয়াবার টাকায় রাতারাতি কোটিপতি হয়েছেন তারা সবাই। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

ওসি বলেন, কক্সবাজার সীমান্তে অনেক লবণ চাষি, দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যানচালক ইয়াবা বেচাকেনা করে টেকনাফে রাজকীয় বাড়ি বানিয়েছেন। সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় তালিকাভুক্ত এসব ইয়াবা কারবারি। এর মধ্যে অনেকেই গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। ইয়াবার টাকায় যারা অবৈধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন পর্যায়ক্রমে তাদের একই পরিণতি হবে।

প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের স্পেশাল জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মো. ফিরোজ পিতা, দুই পুত্রসহ তিনজন ইয়াবা ব্যবসায়ী মানিলন্ডারিং করে অবৈধভাবে অর্জিত ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৭ টাকার সম্পদ ক্রোক করার জন্য গত ৫ মার্চ এ যুগান্তকারী এই আদেশ দিয়েছিলেন। যেসব ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সম্পদ ক্রোক করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা হলো-

টেকনাফ উপজেলার নাজির পাড়ার এজাহার মিয়ার দুই পুত্র নুরুল হক ভূট্টো ও নুর মোহাম্মদ এবং তাদের পিতা নজু মিয়ার পুত্র এজাহার মিয়া। তারা তিন জনই পিতা-পুত্র। আদালতের এই রায়টি কার্যকর করার মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ক্রোক করা শুরু হলো।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, টেকনাফ মডেল থানার ২৯ আগষ্ট ২০১৭ সালের ৭৪ নম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়েরকৃত মামলার এজাহারের ১ নম্বর আসামী নুরুল হক ভূট্টো, ২ মম্বর আসামী নুর মোহাম্মদ ও ১০ নম্বর আসামী পলাতক এজাহার মিয়া ২০১০-২০১১ সাল হতে ২০১৭-২০১৮ সাল পর্যন্ত মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে প্রচুর পরিমানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

এসব সম্পদের মধ্যে দালানকোঠা, ভূসম্পত্তি রয়েছে। যার মূল্য ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৭ টাকা। এসব অবৈধ সম্পদ ক্রোক করে রাষ্ট্রের হেফাজতে নিয়ে আসার জন্য ক্রোকের অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ পুলিশের অর্গানাইজড ক্রাইম (ইকোনোমিক ক্রাইম স্কোয়াড) এর বিশেষ সহকারী পুলিশ সুপার মো. নাজিম উদ্দিন আল আযাদ কক্সবাজারের স্পেশাল জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার হাসান মো. ফিরোজের আদালতে গত ২৭ জানুয়ারি ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইনের ১৪ (১) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন।

যার ক্রিমিনাল পারমিশন মিচ মামলা নম্বর হচ্ছ-৫৭৭/২০১৯ ইংরাজি। মামালার ফৌজদারি আবেদনে মাদক ব্যবসা ও ইয়াবা বিক্রয় করে অর্জিত এসব অবৈধ সম্পদ ক্রোক করা নাহলে, এসব অবৈধ সম্পদ রাষ্ট্রের আর্থিক করতে পারে। অন্যত্র বিক্রি হতে পারে। তাই এসব অবৈধ সম্পদ ক্রোকের অনুমতি দিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে তত্ত্বাবধারক নিয়োগ দেয়ার জন্য মামলার আবেদনে প্রার্থনা করা হয়।

মামলা দায়েরের পর আদালত সম্পদের তফশিল, বিস্তারিত বিবরণসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা ও এএসপি মো. নাজিম উদ্দিন আল আযাদকে নির্দেশ দেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা গত ২০ ফেব্রুয়ারি সম্পদের স্থির চিত্র, সম্পদের রেজিস্ট্রাড দলিল, সহি মুহুরী অবিকল কপি, খতিয়ান, অবস্থান, চৌহদ্দি, তফশিল, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র, মামলার সমর্থনে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট,

তথ্য, উপাত্তসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। গত ৫ মার্চ মামলাটি স্পেশাল জজ খোন্দকার হাসান মো. ফিরোজের আদালতে চুড়ান্ত শুনানী করা হয়। শুনানী শেষে আদালত তফসিলে বর্ণিত অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অন্যত্র বিক্রি, হস্তান্তর ও বেহাত হওয়ার আশংকা থাকায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মন্ঞ্জুর করে টেকনাফ মডেল থানার ৭৪/২০১৭ নম্বর মূল মামলা নিষ্পত্তি নাহওয়া পর্যন্ত ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ১৪ (১) ধারায় তফশিলে বর্ণিত সমুদয় সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছিলেন।

স্পেশাল জজ খোন্দকার হাসান মো. ফিরোজের দেয়া আদেশ মতে, একই আইনের ১৪ (৩), উপবিধি (১) অনুযায়ী উক্ত অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তির সরকারি গেজেট প্রকাশ করা হয় এবং একটি বহুল প্রচারিত বাংলা জাতীয় দৈনিক ও একটি জাতীয় ইংরাজি দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি

প্রচার করা হয়। আদালত কক্সবাজার জেলা রেজিস্টারকে এসব সম্পত্তি আদালতের অনুমতি ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় নাকরার নির্দেশ দেন। আদেশের কপি তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. নাজিম উদ্দিন আল আজাদ ও কক্সবাজারের জেলা রেজিস্টারের নিকট কপি প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

এই আদেশের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট মোহাম্মদ ছৈয়দ আলম বলেন, নিঃসন্দেহে রায়টি যুগান্তকারী ও এ রায় কার্যকর করায় সেটি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নূন্যতম সময়ের মধ্যে হওয়া এ রায় ও তার কার্যকারিতা দেখে ইয়াবা ব্যবসায়ীসহ মাদক কারবারিদের মাদক ব্যবসা করে অবৈধ সম্পদ অর্জনে নিরুৎসাহিত করবে।

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছৈয়দ আলম বলেন, তিন দশকের আইন পেশায় আমার জানা মতে মাদক কারবারীদের অর্জিত অবৈধ সম্পদ ক্রোকের এই ধরণের আদেশ ও তা সহসায় কার্যকর করা এটাই সর্বপ্রথম।

কক্সবাজারে পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম বলেন, সরকারের ‘মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বনে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সকল সম্পদ তদন্ত করে পুলিশের সিআইডির ইকনোমিক ক্রাইম স্কোয়াড, এনবিআর, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকের

ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ হাইস্কুল মাঠে আত্মসমর্পণকারী ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সম্পদের হিসাব চাওয়া শুরু করেছে। এজন্য দুদক থেকে তাদের নিকট পত্র পাঠানো হয়েছে।

তিনি বলেন, মামলাটির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অবৈধ সম্পদের ক্রোকের প্রক্রিয়া শুরু হলো।

তিনি বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অর্জিত অবৈধ সম্পদ শুধু ইয়াবা ব্যবসায়ী নয়, তাদের সন্তান-নাতি-পুতিরাও ভোগ করতে পারবনা।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির স্পেশাল সহকারী পুলিশ সুপার মো. নাজিম উদ্দিন আল আজাদ মুঠোফোনে শুকরিয়া জ্ঞাপন বলেন, অত্যন্ত শ্রম, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সাথে তদন্ত ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক কাজ করেছি।

বিজ্ঞ আদালতের রায়ে কার্যকর করাতে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ রায় কার্যকরের ফলে মাদক প্রতিরোধ অভিযানে নিয়েজিত সকল পুলিশ সদস্যকে প্রেরণা ও প্রত্যয়ে সমৃদ্ধ করবে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মুহাম্মদ ইকবাল হোসাইন জানান, আদালতের এই রায় কার্যকর করে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানকে আরো গতিশীল করা হলো।

তার মতে, এ রায় কার্যকর হওয়ার কারণে দ্রুত সম্পদশালী হওয়ার জন্য ইয়াবা কারবারের দিকে ঝুঁকে পড়া ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সংখ্যা এখন কমে আসবে।

শেয়ার করুন: