একে একে ১২টি বিয়ে করেছেন শাহনুর!

করেছেন শাহনুর – নিজেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রেমের জালে আটকে ১২টি বিয়ে ও প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন সাভারের শাহনুর রহমান সিক্ত নামে এক নারী।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও সিক্তর কথিত স্বামীর দায়ের করা একটি প্রতারণা মামলায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব প্রতারণার গল্প।

নিজের নামের সঙ্গে শাহনুর আকতার নামে একজন বিসিএস ক্যাডারের নামের মিল থাকায় এই পরিচয় ব্যবহার করে আসছিলেন শাহনুর রহমান সিক্ত। আসলে তিনি একজন প্রতারক।

সিক্তর দেওয়া পরিচয়ে, তার মা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী ও সাভারের বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) ট্রেনিং ডিরেক্টর। তার ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও বিপিএটিসির ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর।

বড় বোন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক। দুলা ভাই প্রকৌশলী, একমাত্র চাচা সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং মামা একজন মন্ত্রী। এমনকি তিনি নিজেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৩৮তম ব্যাচের সাবেক ছাত্রী ও ৩৬তম বিসিএস ক্যাডার বলে দাবি করে আসছিলেন।

পরে পুলিশের তদন্তে জানা যায়, প্রকৃতপক্ষে সিক্তর বাবা বিপিএটিসির একজন গাড়িচালক ছিলেন। বাবার অকাল মৃত্যুর পর মা বিপিএটিসিতে আয়ার চাকরি পান। সিক্ত তার মায়ের সঙ্গে বিপিএটিসির কর্মচারী কোয়ার্টারে বড় হন। সেখানেই বিসিএস ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এই সুযোগে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির পদ, পদমর্যাদাসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ধারণা পান তিনি।

বাসার কাছেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হওয়ায় মাত্র পঞ্চম শ্রেণী পাস সিক্ত সেখানকার শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণের ভিত্তিতে নিজেকে গড়ে তোলেন নিজেকে। এমনকি ভালোভাবে ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতাও অর্জন করে ফেলেন তিনি।

ক্যাম্পাসের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরদের সম্পর্কেও অনেক তথ্যও সংগ্রহ করেন তিনি। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষার্থীর মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার বন্ধু গড়ে তোলেন। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ব্যাচের রি-ইউনিয়নে অংশগ্রহণ শুরু করেন তিনি।

শাহনুর রহমান সিক্ত ছাড়াও তিনি নিজেকে সিক্ত খন্দকার, তাহামিনা আক্তার পলি ও তামিমা আক্তার পলি নামে পরিচয় দিতেন। ৩৬তম বিসিএস ক্যাডার শাহনুর আক্তারের নামের সঙ্গে নামের মিল থাকায় বিসিএস ক্যাডার শাহনুরের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে নিজেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে আসছিলেন দীর্ঘদিন থেকেই।

এই পরিচয়েই প্রথমে প্রেম ও পরে বিয়ের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। বিসিএস ক্যাডার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিচয় দিয়ে শাহনুর রহমান সিক্ত অন্তত ১২ জনকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছেন। পাশাপাশি স্বামীর পরিচিত ব্যক্তিদের চাকরি দেয়ার প্রলোভন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের অর্থ।

এই পদ্ধতিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রথমে বিয়ে করেন সিক্ত। পরে স্বামীর আত্মীয়-স্বজনদের চাকরি দেওয়ার নাম করে সাত লাখ টাকা ও ১০ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নেন।

আরেক স্বজনকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির নাম করে হাতিয়ে নেন মোটা অংকের অর্থ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫তম ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থীকেও প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রথমে বিয়ে করেন সিক্ত। পরে তার সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে নিরুদ্দেশ হন তিনি।

সিক্তর বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, ‘একটি প্রতারণার মামলায় সিক্ত নামের ওই নারীকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে মনে হয়েছে তিনি একজন প্রতারক। মামলার তদন্ত এখনও চলছে। তার সম্পর্কে এরই মধ্যে অনেক তথ্য জানা গেছে। বিয়ের ফাঁদে ফেলে অন্তত ১২ জনের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এই নারী’।

এদিকে এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ. স. ম. ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘এই নারীর মতো কোনো জালিয়াতি চক্রের হাতে কেউ যাতে না পড়ে সেজন্য সবার সতর্ক থাকা উচিত। এমন জালিয়াতির কোনো তথ্য যদি কারো কাছে থাকে, সবার কাছে অনুরোধ তারা যেন দ্রুত আমাদের বিষয়টি জানায়। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে’।

জানা যায়, প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এই ধরনের প্রতারণা করে আসছিলেন সিক্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্তত ১০ জনকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেন তিনি।

পরে বিভিন্ন উপায়ে তাদের সর্বস্ব হাতিয়ে নেন তিনি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা প্রতারণার কাজে তাকে সহায়তা করতেন বলেও জানা গেছে। থানায় দায়ের করা প্রতারণার মামলায় সিক্তর দুলা ভাই আফতাব উদ্দিনকেও গ্রেফতার করে পুলিশ

শেয়ার করুন: