ঐক্যফ্রন্ট

২০ দল না ভাঙলেও সংকটে ঐক্যফ্রন্ট: স্টিয়ারিং কমিটি চায় বড় শরিকরা

বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত এমপির শপথ নেওয়াকে ঘিরে কিছুটা অস্থিরতা এখনো থাকলেও আপাতত ভাঙছে না ২০ দলীয় জোট। তবে সংসদে যাওয়া নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে সৃষ্ট সংকট এখনো দূর হয়নি।

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী চিঠি দিয়ে ফ্রন্ট ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, অবস্থান বদল করে শপথ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি ও গণফোরাম অন্য তিন শরিক দলকে কী বলবে তারও সুরাহা হয়নি।

পাশাপাশি ফ্রন্টের বৈঠকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা অংশ নেবেন কি না তা নিয়েও সংশয় আছে। ফলে গত রবিবার ফ্রন্টের বৈঠক ডেকেও পরে তা স্থগিত করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কার্যত কিছুটা অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে বলে জানা গেছে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘৩০ ডিসেম্বরের মতো একটি ফ্রড নির্বাচনের পরও গত চার মাসে আমরা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারিনি।

উল্টো সংসদে যোগদান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুতরাং এগুলো নিষ্পত্তি হতে হবে। তা না হলে ঐক্যফ্রন্টের সামনে এগোনো কঠিন।’ তবে তিনি বলেন, ‘যে ধরনের ভয়ংকর এক স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় আছে তাতে জোট ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি।’

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংকট থাকলেও আলোচনা করে সেগুলো নিষ্পত্তি করা যায়। কাদের সিদ্দিকীকে যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘আশা করি দেশের সংকটকালের কথাও তিনি বিবেচনায় নেবেন।

আমাদের বিশ্বাস, তিনি ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে যাবেন না।’ সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘যে যত কথাই বলুক, কে কোথায় যাবে? যাওয়ার কোনো জায়গা আছে? সরকার তো সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে ফ্রন্ট বা বিএনপিকে ছেড়ে গেলেই রাতারাতি সব সমস্যা সমাধান হবে না। জোটে থেকেই লড়াই করতে হবে।’

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বীরপ্রতীক বলেন, ‘আমরা ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে যাব এ কথা বলিনি। বরং আমরা ফ্রন্ট শক্তিশালী করার পক্ষে। তবে যে অসংগতিগুলো নির্বাচনের আগে ও পরে হয়েছে সেগুলো দূর করতে বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জোটে থাকব কি না সেটি বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এমপিদের শপথ নেওয়ার বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম এবং বিএনপির আনুষ্ঠানিক অবস্থান প্রায় একই রকম। কারণ ওই দুটি দলের মোট সাত এমপি শপথ নিয়েছেন। যদিও দুটি দলের ভেতরেই এ নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে।

অন্যদিকে শপথ নেওয়ায় ক্ষুব্ধ ফ্রন্টের শরিক জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্য। কারণ প্রথমত, ওই তিন দলের কেউ নির্বাচিত হননি। দ্বিতীয়ত, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রথম থেকেই নির্বাচনের ফল প্রত্যখ্যান করে শপথ না নেওয়ার অবস্থান নিয়েছিল। অথচ বিএনপি ও গণফোরাম এ বিষয়ে ফ্রন্টের বৈঠকে আলোচনা না করেই শপথ নিয়েছে। বৈঠক হলে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাইছে অন্যরা।

অন্যদিকে প্রশ্ন তুললেও বিএনপি কি জবাব দেবে সে বিষয়টি এখনো নির্ধারিত হয়নি। কারণ বিএনপির ভেতরেই এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিএনপি সূত্রে জানা যায়, ওই প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়ায় বিএনপিরই স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকেও পরে তা স্থগিত করা হয়েছে। তা ছাড়া নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব কারা করবেন তা নিয়েও সংকট রয়েছে। নির্বাচনের আগে বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করতেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

কিন্তু ড. কামাল হোসেন নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি না হওয়ার পর থেকে মওদুদ ও মোশাররফ বৈঠকে যাচ্ছেন না। এরপর কিছুদিন মির্জা ফখরুল একা এবং পরে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানকে ওই বৈঠকের জন্য পাঠানো হলেও বৈঠকের কার্যকারিতা অনেকখানি কমে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এরপর এমপিদের শপথ নিয়ে সংকট আরেক দফা বাড়ায় ফ্রন্টের মধ্যে কিছুটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। যদিও বিএনপি মনে করে, অচিরেই এসব সংকট কেটে যাবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যে ধরনের প্রহসনের নির্বাচন দেশে হয়েছে তারপর অনেক কিছু নিয়ে কথা হবে এটিই স্বাভাবিক। ফলে এগুলো মেনেই সামনে এগোতে হবে।’ তিনি দাবি করেন, ২০ দলীয় জোট ভাঙবে না। আর ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক হলেও সব কিছু আলোচনা করে নিষ্পত্তি করা হবে। শেষ পর্যন্ত কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না।

ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তের বাইরে সাত এমপি শপথ নেওয়ায় গত ৯ মে জোট ছাড়ার হুমকি দেন কাদের সিদ্দিকী। এ ছাড়া গত শনিবার ড. কামাল হোসেনকে দেওয়া এক চিঠিতে আগামী ৮ জুনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েও ফ্রন্ট ছাড়ার হুমকি দেন তিনি। এর আগে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেও সংসদে যোগদানের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন কাদের সিদ্দিকী।

স্টিয়ারিং কমিটি চায় জোটের বড় দলগুলো : বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থর জোট ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও গত সোমবার ২০ দলীয় জোটের বৈঠক শেষ পর্যন্ত বেশ শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।

শরিক দলগুলোর কেউ কেউ সংসদে যোগদান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও শেষ পর্যন্ত জোটে থাকার বিষয়ে অঙ্গীকার করেন। তবে জোট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ২৪ ঘণ্টার নোটিশে অল্প সময়ের জন্য বৈঠকে তাঁরা খুশি নন। তা ছাড়া অগুরুত্বপূর্ণ দলগুলোকে বাদ দিয়ে বড় দলগুলোকে নিয়ে তারা একটি স্টিয়ারিং কমিটি করারও পক্ষে। কিন্তু অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য বৈঠক হওয়ায় গত সোমবার তাঁরা ওই দাবি তুলতে পারেননি বলে জোটের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।

বর্তমানে ‘২০ দলীয় জোট’ নামে থাকলেও সংগঠন এবং নেতৃত্বের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ দল রয়েছে চার-পাঁচটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নামসর্বস্ব দলের নেতা হয়েও কেউ কেউ বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এলডিপির ড. অলি আহমেদ, কল্যাণ পার্টি মেজর জে. (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম, জাতীয় পার্টির মোস্তফা জামাল হায়দার ও খেলাফত মজলিসের মাওলানা মুহম্মদ ইসহাকের মতো নেতার পাশে বসে বৈঠক করার সুযোগ পাচ্ছেন। যদিও বৈঠকে তাঁরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। আবার জোটের সিনিয়র নেতারা তাঁদের সামনে নীতিগত কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে অস্বস্তিবোধ করেন।

সূত্র মতে, এসব কারণে সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে স্টিয়ারিং কমিটি করার দাবি ২০ দলে জোরালো হচ্ছে। তবে কোনো দলই আপাতত ২০ দল ছাড়ছে না। এলডিপি গত ৮ মে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আপাতত ২০ দলীয় জোট ছেড়ে তারা যাচ্ছে না।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাওয়ার বাস্তবতা এই মুহূর্তে দেশে নেই। কারণ রাজনীতির ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দল ভাঙাগড়ার সুযোগে অতীতে কৌশল করে বিএনপি অগুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সুযোগ দিয়ে দলের যে সংখ্যা বাড়িয়েছে সেটি সঠিক ছিল না। সংখ্যা বাড়ানোর রাজনীতি তাই আজ বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে।’

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘আমি ও কল্যাণ পার্টি বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নির্যাতিত নেতাকর্মীদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম। তাই এই বন্ধুত্ব বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়।’ তিনি বলেন, ‘অন্য কোনো দলেরও এই জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখছি না। তবে ২০ দলীয় জোটের কাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই কামনা করি। জোটের ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্ব কার্যকর করার জন্য স্টিয়ারিং কমিটি গঠনও এখন সময়ের দাবি।’

জানা যায়, অন্তত পাঁচটি দল আছে যাদের মূল নেতৃত্ব ২০ দল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ভগ্নাংশ দিয়ে নামমাত্র ২০ দলের সংখ্যা পূরণ করা হয়েছে। ন্যাপের সভাপতি জেবেল রহমান গানি চলে যাওয়ার পর তাঁরই দলের এক অখ্যাত নেতাকে ওই দলের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে গোলাম মোর্তজা চলে যাওয়ার পর অখ্যাত একজনকে ওই দলের প্রতিনিধি করা হয়েছে, যাকে নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে। ন্যাপ ভাসানীর আনোয়ারুল হক চলে যাওয়ায় কল্যাণ পার্টির পঞ্চগড় জেলার স্থানীয় এক নেতা অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামকে বানানো হয়েছে ন্যাপের শীর্ষ নেতা।

শেয়ার করুন: