প্রতিদিন সামহি মুস্তাফা কায়রোর কাছে তার বাড়ি থেকে মিসরের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ বানি সোয়েফ পর্যন্ত ২০০ কিলোমিটার যাত্রা করেন। কারণ আদালতের আদেশে আগামী কমপক্ষে পাঁচ বছর তার জন্য এই যাত্রা বাধ্যতামূলক। সামহি মুস্তাফা প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক একটি পুলিশ স্টেশনে কাটান।
শাস্তির এই ধরনকে বলা হচ্ছে, ‘সাপ্লিমেন্টারি পেনাল্টি।’ এর আগেও সামহি পাঁচ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। ছাড়া পেয়েছেন গত বছর। মিসরে ইতোমধ্যে জেল খেটেছেন এমন ব্যক্তিদের জেল থেকে ছেড়ে দেয়ার পর বাড়তি শাস্তি হিসেবে এই ‘সাপ্লিমেন্টারি পেনাল্টি’ দেয়া হচ্ছে।
২০১৩ সালে ‘মিথ্যা সংবাদ’ প্রচার এবং সেসময় দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি বিরোধী এক বিক্ষোভ চলাকালীন মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের সাহায্য করার অভিযোগে ৩২ বছর বয়সী এই সাংবাদিকের কারাদণ্ড হয়েছিলো।
মুসলিম ব্রাদারহুড এখন মিসরে একটি নিষিদ্ধ গোষ্ঠী। কয়েকদিন আগে সামহি টুইটারে একটি দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ির ছবি পোস্ট করেছিলেন। তিনি সেখানে লিখেছেন, প্রতিদিন ২০০ কিলোমিটার যাত্রায় একদিন তিনি বেশ বড়সড় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন।
তাই তাকে দেয়া বাধ্যতামূলক ‘সাপ্লিমেন্টারি পেনাল্টি’ পালন করতে বানি সোয়েফের সেই পুলিশ স্টেশনে যেতে পারেননি। দুর্ঘটনা সত্ত্বেও তার অনুপস্থিতিতে আদালত তাকে আবারো এক মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে।
মিসরে এরকম শাস্তি শুধু তিনি পাচ্ছেন এমন নয়। দেশটিতে শতশত বিরোধী মতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মীকে একই ধরনের সাজা দেয়া হচ্ছে। এই সাজার মুশকিল হলো- কোন ছোটখাটো অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আবার কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া যায়।
খুব ভোরে কায়রোর একটি পুলিশ স্টেশনের বাইরে খুব মনমরা অবস্থায় এলোমেলো কাপড় পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন রামি। এটি তার আসল নাম নয়। রামির শাস্তি হল আগামী তিনি বছর তাকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত এই পুলিশ স্টেশনে কাটাতে হবে।
তিনি বলছেন, ‘এমন শাস্তির জন্য আমি কোনো চাকরি করতে পারি না, আমার কোন পারিবারিক জীবন নেই। টাকা পয়সা সব শেষ হয়ে গেছে।’ তিনিও সামহির মতো ইতোমধ্যেই তিন বছর কারাগারে কাটিয়েছেন।
তার অপরাধ ছিল তিনি একটি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। রামির বয়স ২০ বছর। তাই কারাদণ্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি অর্থনৈতিকভাবে এখন পুরোপুরি পরিবারের উপর নির্ভরশীল।
এমন শাস্তি আবার এক এক পুলিশ স্টেশনে ভিন্ন রকম। যেমন রামি যেখানে রাত কাটান সেখানে তাকে হাজতে রাখা হয়না। কোন বিছানাও দেয়া হয়না। থানার সাথে লাগোয়া একটি খোলা জায়গায় তাকে থাকতে হয়।
খোলা আকাশের নিচেই রাতে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন বেশিরভাগ রাত। নিজের খাবার নিজেকেই নিয়ে আসতে হয়। কোন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস নিয়ে আসতে পারবেন না। শুধু বই নিয়ে আসতে পারবেন।
কিছু থানায় শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি কম্বল নিয়ে আসতে পারবেন। অনেক জায়গায় হাজতের ভেতরে বিছানায় তাদের থাকতে দেয়া হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে রামির মতো তাদের থানার উঠোনে রাখা হয়।
মিসরে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এমন শাস্তিকে ‘বাড়াবাড়ি’ বলে উল্লেখ করেছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের বা সরকারের সমালোচকরাই মূলত এর শিকার হচ্ছেন। এর সংখ্যাও শত শত। শুধু গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২১৫ জনকে সাজা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে শওকান নামের একজন বিখ্যাত আলোকচিত্রী রয়েছেন।
নিপীড়নমূলক এমন শাস্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন আলা আব্দেল ফাত্তাহ। ব্লগার ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ফাত্তাহ ২০১১ সালের হোসনি মুবারক পতন আন্দোলনের সময় প্রথম পরিচিত হয়ে ওঠেন।
তাকে গতমাসে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তবে তাকেও কায়রোর একটি থানায় রোজ রাতে বারো ঘণ্টা কাটাতে হয়। এত নিপীড়নের মাঝেও তিনি অনলাইনে একটি প্রচারণা শুরু করেছেন। কারাগার থেকে মুক্তির পর প্রথম যেদিন তাকে থানায় যেতে হয়েছে।
সেদিনই তিনি এই ক্যাম্পেইন শুরু করেন। যাতে তিনি ‘হাফ ফ্রিডম’ লিখে হ্যাশট্যাগের প্রচলন করেন। মুখ বন্ধ না করলে তাকে আবারো কারাগারে পাঠানো হবে বলে ইতোমধ্যেই হুমকি দেয়া হয়েছে।
মিসরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। ওদিকে আলা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দুঃখজনক বিষয় হল আমি আসলে এখনো স্বাধীন নই।’