মাংস

’সিটি কর্পোরেশন বলে দিক কোথায় ৫২৫ টাকায় গরুর মাংস পাওয়া যায়’

যতই হম্বিতম্বি করা হোক না কেন, রামাজানের শুরুতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না৷ মাছ-মাংস, শাক-সবজি, ছোলা, পিঁয়াজ রসুন, ফল সব কিছুর দামই বাড়তি৷

এই পরিস্থিতিতে রমজান মাসে গরুর মাংস ও খাসির মাংসের দাম বেঁধে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন৷ গরুর গোশত প্রতি কেজি ৫২৫ এবং খাসির গোশত প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা৷ দুপুরে নগর ভবনে গোশত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে গোশতের দাম নির্ধারণ করেন মেয়র সাঈদ খোকন৷

এ বিষয়ে কথা হয় শুক্রাবাদের চা দোকানদার জামাল হোসেনের সঙ্গে৷ তিনি ক্ষোভের সঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কয়েকদিন আগে গরুর মাংসের দাম একটু কম ছিল৷ কিন্তু রমজানের আগে সোমবার ৬৫০ টাকায় এক কেজি গরুর মাংস কিনেছি৷

সিটি কর্পোরেশন আমাদের বলে দিক কোথায় ৫২৫ টাকায় গরুর মাংস পাওয়া যায়৷ আমরা সবাই সেখানে গিয়ে মাংস কিনবো৷” তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন খাসির মাংসের কেজি সাড়ে ৮ শ’ টাকা৷ সিটি কর্পোরেশনের দামে মাংস চাইলে আমাদের দোকানদাররা ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেবে৷”

তিনি জানান, ‘‘গত রমজানেও সিটি কর্পোরেশন গরুর মাংসের কেজি সাড়ে ৪ শ’ টাকা ঠিক করে দিয়েছিল৷ কিন্তু তখন আমাদের মাংস কিনতে হয়েছে সাড়ে ৫ শ’ টাকা করে৷”
সিটি কর্পোরেশন মহিষের মাংসের কেজি নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ৪ শ’ ৮০ টাকা৷ ভেড়া বা ছাগীর মাংসের প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা৷

কিন্তু বাজারে মহিষের মাংস বলে কিছু পাওয়া যায় না৷ সবই নাকি গরুর মাংস৷ এর আগে একবার মাংসের দোকানে গরুর মাংস রাখা বাধ্যতামূলক করা হলেও তা কার্যকর হয়নি৷ ঢাকায় প্রতিদিন প্রচুর মহিষ এলেও মাংসের দোকানে মহিষের মাংস নেই৷ ভেড়া বা ছাগীর মাংসও কোনো দোকানে পাওয়া যায় না৷

এসব বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল ইসলাম বলেন, ‘‘৫২৫ কেন, যদি চাঁদাবাজি বন্ধ হয়, তাহলে আমরা সাড়ে ৩ শ’ টাকা কেজিতেও মাংস বিক্রি করতে পাবব৷

ঘাটে ঘাটে চাঁদা দেয়ার পর একটি গরু যখন ঢাকার গাবতলি গরুর হাটে আসে, তখন ইজারাদার ট্যাক্সের নামে আরো একদফা চাঁদা আদায় করে, যার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি৷ ফলে একটি গরুর প্রকৃত যে দাম, তার চেয়ে দুই গুণ-আড়াই গুণ বেশি দামে আমাদের একটি গরু কিনতে হয়৷ আমরা এটা বন্ধের দাবি জানিয়েছি৷ তা হলে নির্ধারিত দামেই গরুর মাংস বিক্রি করতে পারবো৷ না হলে দাম যেভাবে ফ্রি-স্টাইল চলছে, সেভাবেই চলবে৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন গরুর মাংসের কেজি ৬ শ’ সাড়ে ৬ শ’ টাকা৷ এটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে৷ নিম্নবিত্ত মানুষ কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে বাধ্য হলে মাংস কেনে, তার বাইরে নয়৷ আমাদের অনেক দোকানও বন্ধ হয়ে গেছে৷”

জামাল হোসেন জানান, রমজানের আগে সব কিছুর দামই বেড়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘পিঁয়াজ এক সপ্তাহ আগে ছিল ২৫ টাকা, এখন ৩৫ টাকা কেজি৷ ৮০ টাকার আদা এখন ১২০ টাকা৷ বুটের ডাল ছিল ৭০ টাকা, এখন হয়েছে ৯০ টাকা৷ ছোলার দামও কেজিতে ২০ টাকা বেড়েছে৷ চিনির দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা৷”

তবে কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা আব্দুর রহিম মনে করেন, ‘‘রমজানের আগে ভোগ্য পণ্যের দাম যে পরিমাণ বাড়ার কথা, সেরকম বাড়েনি৷ কিছু কিছু পণ্যের দাম কেজিতে ৫-১০ টাকা বেড়েছে৷ মশুরের ডাল কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে৷ আর যারা বলছে বেড়েছে, তারা গত বছরের রমজানের সঙ্গে তুলনা করছেন না৷ মাঝে কমেছিল৷ তার সঙ্গে তুলনা করছেন৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘রমজানকে সামনে রেখে লোকজন একটু বেশি ভোগ্যপণ্য কিনছেন, যার লাগে এক কেজি সে কেনে ৫ কেজি৷ সে কারণেও দাম একটু বেড়েছে৷”

তবে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি ব্যবসায়ী শুক্কুর ট্রেডার্সের মালিক শফিকুল ইসলাম দাবি করেন, ‘‘রমাজানের আগে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য ও ভোজ্য তেলের দাম পাইকারি পর্যায়ে বাড়েনি৷ আমাদের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে৷ খুচরা পর্যায়ে কেন দাম বাড়ছে তা আমাদের জানা নেই৷ হয়তো লোডিং-আনলোডিংয়ের সমস্যা, অথবা রমাজানের আগে চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে এরকম হতে পারে৷”

আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী মোহসীন আহমেদ বলেন, ‘‘অজুহাতের তো শেষ নেই, খুচরা বিক্রেতারা নাকি ঘুর্ণিঝড় ফণীর কারণে পণ্য দোকানে তুলতে পারেনি৷”

এদিকে মাছ, শাক-সবজি ও ফলের দামও রামজানের আগে বেড়ে গেছে৷ কলাবাগানের গৃহিণী জামিলা আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার তরমুজের দাম বেশি৷ ছোট একটি তরমুজের দাম ১৮০ টাকা৷ তরমুজের কেজি ৮০-৯০ টাকা৷

বড় একটি তরমুজের দাম ৫-৬ শ’ টাকা৷ সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না৷ কমলা আপেল, মালটা, খেজুর সব ফলের দামই বাড়তি৷ খেজুরের কেজি ৩৫০ টাকা থেকে শুরু৷ মাছের দাম বেড়ে গেছে৷ ১৫-২০ টাকার নিচে কোনো ধরনের এক আঁটি শাক পাওয়া যায় না৷”

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতি মুনাফা করার প্রবৃত্তি কমছে না৷

ফলে সরবরাহ ঠিক থাকলেও তারা নানা অজুহাতে রমজান বা কোনো উৎসবের আগে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়৷ তবে আমাদের ক্রেতাদেরও সচেতন হতে হবে৷ একসঙ্গে সব কেনার মানসিকতা ছাড়তে হবে৷ আর কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিলে তার ব্যহার কমিয়ে দিতে হবে৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘শুধু আইন করে বা নির্দেশ দিয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়৷ প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন এবং মনিটরিং৷ বাজারের বাস্তবতার সঙ্গে মিল না রেখে কোনো পণ্যের দাম যদি বেঁধে দেয়া হয়, বাস্তবে তা কার্যকর হয় না৷ গরুর মাংসের দাম বেঁধে দেয়ার ক্ষেত্রেও তাই হবে৷”

এদিকে এই রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মনিটরিংয়ের জন্য মনিটরিং সেল খুলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়৷ সেল এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে৷ বাজারে যে-কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির তথ্য দেয়ার জন্য ফোন নাম্বার দিয়ে সেলে সেলে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে৷ সেলের ফোন নম্বরগুলো হচ্ছে ৯৫৪৯১৩৩, ০১৭১২-১৬৮৯১৭, ৯৫১৫৩৪৪ ও ০১৯৮৭-৭৮৭২০৯৷

এর বাইরে রমজানে ডিএমপি ও সিটি কর্পোরেশন ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করবে৷ আর রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে৷

তারা প্রতি কেজি চিনি ৪৭ টাকা, মসুরের ডাল ৪৪ টাকা এবং সয়াবিন তেল লিটার প্রতি ৮৫ টাকায় বিক্রি করছে৷ ছোলা প্রতি কেজি ৬০ টাকা এবং খেজুর ১৩৫ টাকা৷ একজন ক্রেতা একবারে সর্বোচ্চ ৫ লিটার তেল কিনতে পারবেন৷ খেজুর কিনতে পারবেন ১ কেজি করে৷ ছোলা, চিনি ও ডাল ৪ কেজি করে৷ সূত্ : ডয়চে ভেলে

শেয়ার করুন: