জামায়াত

কোন পথে জামায়াত: মঞ্জু নয়, সংস্কারপন্থিদের নিয়েই দুশ্চিন্তা

নতুন নামে দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে মাস তিনেক আগে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কমিটি হলেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। বরং নতুন নামে দল গঠনের পরামর্শ দেওয়া সংস্কারপন্থিদের আরও কোণঠাসা করা হয়েছে। একই সঙ্গে যারা দলের কর্মপদ্ধতি, নীতিতে পরিবর্তন আনতে চান তাদের ওপর নজরদারি করার জন্য কমিটি করা হয়েছে।

এরই মধ্যে ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় জামায়াত কোন পথে হাঁটছে, তা নিয়ে দলটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে থাকা লোকজন ও রাজনীতিসচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

সংস্কার ও নতুন দল নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায় দলের তরফ থেকে জামায়াত নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে দু'জন কর্মপরিষদ সদস্য ও একজন নির্বাহী পরিষদ সদস্য বলেছেন, তাদের জানামতে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ থমকে গেছে। যারা সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলেন, তারা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

সংস্কারের দাবি জানিয়ে জামায়াত থেকে বহিস্কার হওয়া ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জুর নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ প্রকাশ্যে আসায় প্রশ্ন উঠেছে, সংস্কারপন্থিরা এ উদ্যোগে শামিল হবেন কি-না। তবে জামায়াতের একাধিক কর্মপরিষদ সদস্য জানিয়েছেন, মঞ্জুর নেতৃত্বে যে দল হচ্ছে তা তাদের জন্য হুমকি নয়। এর ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন, মঞ্জু যে দল করতে যাচ্ছেন তা ধর্মভিত্তিক হবে না।

ওই দলে জামায়াতের তরুণ নেতাকর্মীদের যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন যেতে পারেন। তবে গণহারে দলবদলের ঘটনা ঘটবে না। কারণ, জামায়াতের নেতাকর্মীরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দলে আসেন। দলীয় প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনার কারণে ইসলামী দলের বাইরে স্বস্তি বোধ করবেন না তারা।

একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, মঞ্জুর নেতৃত্বে যে দল গঠন হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে তারা চিন্তিত নন। প্রত্যেকের দল গঠনের অধিকার রয়েছে। মঞ্জুর নতুন দলকে তিনি সেই দৃষ্টিতেই দেখছেন। জামায়াতে সংস্কারপন্থি বলে কিছু নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, মঞ্জুর দল নয়, জামায়াতের জন্য বরং দুশ্চিন্তার কারণ দলের অভ্যন্তরে থাকা সংস্কারপন্থিরা। যারা দলের ভেতরে থেকে জামায়াতে পরিবর্তন আনতে চান, একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মনে করেন, তাদের নিয়ে চিন্তিত দল। তারা চান, জামায়াত একটি ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে সমাজসেবার কাজ করুক।

জোট ও ভোটের রাজনীতি থেকে দূরে থাকুক। সংস্কারপন্থিরা চান, জামায়াতের একটি রাজনৈতিক শাখা থাকা উচিত। যে শাখাটি ভোটে অংশ নেবে। তার নেতৃত্বে থাকবে একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম। বর্তমান নেতৃত্বের সঙ্গে এ ইস্যুতে মতবিরোধ চলছে সংস্কারপন্থিদের।

জামায়াতে সংস্কার ও একাত্তরের ভূমিকার জন্য শীর্ষ নেতৃত্বকে ক্ষমা চাইতে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন দলটিতে দীর্ঘদিনের নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। যিনি কয়েক বছর ধরে লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তার জামায়াত ত্যাগের ঘটনা রাজনীতিতে আলোচনার জন্ম দেয়।

আবদুর রাজ্জাক জামায়াত বিলুপ্ত করে একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন নামে দল গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। সংস্কারপন্থিরা একই পরামর্শ দিয়েছেন। মজিবুর রহমান মঞ্জু সংস্কারের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ও প্রকাশ্যে দলের সমালোচনা করলেও বাকি সংস্কারপন্থিরা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা দলের প্রকাশ্য সমালোচনা না করলেও সংস্কারের দাবিতে সরব ছিলেন দলীয় ফোরামে।

এ অংশের চাপেই গত ফেব্রুয়ারিতে জামায়াত নেতৃত্ব দলে ভাঙন ঠেকাতে নেতাকর্মীদের 'সাংগঠনিক নির্দেশনার' মাধ্যমে জানায়- নতুন নামে দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ জন্য গঠিত কমিটি কাজ শুরু করেছে। সংস্কারপন্থি নেতারা জানিয়েছেন, আগেও এমন কমিটি করে সংস্কার করা হয়নি। এবারও কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।

সংস্কারপন্থিদের সূত্র জানিয়েছে, সংস্কারের দাবিকে চাপা দিতে তাদের আরও কোণঠাসা করা হয়েছে। নতুন দলের জন্য গঠিত কমিটির পাঁচ সদস্যের মধ্যে একমাত্র ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সংস্কারের পক্ষপাতী। কিন্তু তিনি এক মাস ধরে কারাগারে। সংস্কারপন্থিদের একটি সূত্রের দাবি, ডা. তাহের দলের পরামর্শেই জামিন চাইতে আদালতে গিয়েছিলেন। তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল জামিন হবে। তবে তা হয়নি। এখন তিনি কারাগারে থাকায় কমিটির বাকি চার সদস্য বর্তমান নীতি ও কৌশল অব্যাহত রাখার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কমিটির প্রধান ডা. শফিকুর রহমান ও সদস্য রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা আবদুল হালিম বর্তমান নাম ও নীতি-কর্মপদ্ধতি অব্যাহত রাখার পক্ষপাতী। নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত নতুন নামে দল গঠনের বিরোধী তারা। একাত্তরের ভূমিকার জন্যও ক্ষমা চাইতে রাজি নন।

জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, সংস্কারপন্থি নেতাকর্মীদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। তাদের 'বোঝাতে' শিবিরের সাবেক সভাপতি নুরুল ইসলাম বুলবুল, মুহাম্মদ সেলিমউদ্দিন, ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও ডা. ফখরুদ্দিন মানিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সাবেক দল সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি নন মঞ্জু। দলটিতে সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, জামায়াত নেতৃত্ব হয়তো মনে করছেন যেভাবে সব চলছে সেভাবেই থাকা ভালো। তারা হয়তো বর্তমান নীতি ও কর্মপদ্ধতিতে স্বস্তি বোধ করছেন।

শেয়ার করুন: