বায়োগ্রাফি

সুভাষ চন্দ্রঃ ভারতের মিডিয়া মুঘল

টিভি চ্যানেলের সংখ্যার দিক থেকে এশিয়া মহাদেশে চীনের পরই অবস্থান ভারতের। মার্চ, ২০১৯ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে অনুমোদিত স্যাটেলাইট চ্যানেলের সংখ্যা ৯০২।

অর্থাৎ, চার অংকের সংখ্যা স্পর্শ করতে আর খুব বেশি বাকি নেই। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্য এই যে, ভারতীয় টেলিভিশনের ইতিহাসে স্যাটেলাইট চ্যানেলের পদচারণার সূচনা কিন্তু মাত্র তিন দশকেরও কম সময় আগে। ১৯৯২ সালে ভারতে প্রথম স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল হিসেবে যাত্রা শুরু করে জি টিভি। আর যে ব্যক্তির হাত ধরে জি টিভির উদ্ভব ঘটেছিল, তার নাম সুভাষ চন্দ্র।

না, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র নন। তিনি সুভাষ চন্দ্র গোয়েল। এসেল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং হরিয়ানা থেকে নির্বাচিত রাজ্য সভার সংসদ সদস্য সুভাষ চন্দ্র ভারতের নিজস্ব মিডিয়া মুঘল। এছাড়া ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যমানের এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। অনেকে তাকে "ভারতীয় টেলিভিশনের জনক" হিসেবেও অভিহিত করে থাকে।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবনঃ সুভাষ চন্দ্রের জন্ম ১৯৫০ সালের ৩০ নভেম্বর, হরিয়ানা রাজ্যের হিসার জেলার আদমপুরে, এক আগারওয়াল বানিয়া পরিবারে। অর্থাভাবে খুব বেশিদূর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। ১৯ বছর বয়সে, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর পড়াশোনার পাট চুকাতে বাধ্য হন তিনি। প্রবেশ করেন চাল রপ্তানির পারিবারিক ব্যবসায়। তাদের পরিবারের তখন পাঁচ লাখ রুপির মতো দেনা ছিল। সেই দেনা পরিশোধের দায়িত্ব বর্তায় তিনি ও তার ভাইদের কাঁধেই।

সুভাষদের কোম্পানি বিভিন্ন জায়গা থেকে চাল সংগ্রহ করে তা সরবরাহ করত ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়াকে। এছাড়া তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজস্ব একটি উদ্ভিজ্জ তেলের ব্যবসা শুরু করার। এর কিছুদিন পর তিনি খাদ্যশস্য রপ্তানির ব্যবসাও শুরু করেন।

একটি প্যাকেজিং প্রদর্শনীতে গিয়ে সুভাষ এতটাই মুগ্ধ হন যে, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এসেল প্যাকেজিং লিমিটেড। পরবর্তীতে এসেল প্যাকেজিং লিমিটেড যুক্ত হয় সুইস গ্রুপ, প্রোপ্যাক এজির সাথে। তখন কোম্পানিটির নতুন নাম হয় এসেল প্রোপ্যাক লিমিটেড। এরপর সুভাষ ভারতে বিনোদন পার্ক তৈরির প্রকল্পও হাতে নেন।

সম্প্রচার জগৎঃ সুভাষের পরবর্তী আগ্রহ ছিল সম্প্রচার জগতে প্রবেশের। স্টার টিভির মালিকানাধীন এশিয়াস্ট্যাটের ট্রান্সপন্ডার ইজারা নেয়ার ক্ষেত্রেও সফল হন তিনি। এরপর তিনি ১৯৯২ সালে ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল হিসেবে জি টিভি চালু করেন। এছাড়া ওই বছরের অক্টোবরেই তিনি জি টেলিফিল্মস লিমিটেড চালু করেন, যেটির কাজ ছিল জি টিভির জন্য অনুষ্ঠান সরবরাহ করা।

এভাবেই ভারতে যে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের বিশাল সম্ভাবনা আছে, সে বিষয়টি উপলব্ধি করে প্রথম কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সুভাষই। জি টিভির আগমনের আগপর্যন্ত, ভারতীয় দর্শকরা ছিল কেবলই রাষ্ট্রায়ত্ত টেরেস্ট্রিয়াল নেটওয়ার্ক দূরদর্শনের হাতে বন্দি। উন্নত বিশ্বের মতো ভারতেও যে প্রাইভেট চ্যানেলের মাধ্যমে স্বাধীন অনুষ্ঠান নির্মাণ সম্ভব হতে পারে, এ বিষয়টি তখন পর্যন্ত ছিল সিংহভাগ ভারতীয়র ধারণারও বাইরে।

জি টিভি চালুর পর, সুভাষ ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতের সর্ববৃহৎ মাল্টি সিস্টেম অপারেটর, সিটিক্যাবল। এছাড়া নতুন যৌথ প্রকল্প শুরু করেন নিউজ কর্পের সাথে। ওই বছরই নতুন দুটি চ্যানেল, জি নিউজ ও জি সিনেমা নিয়ে আসেন তিনি। ফলে একাধারে যেমন ভারতীয় দর্শক প্রথমবারের মতো সারাদিন স্থানীয় সংবাদ দেখার একটি মাধ্যম পেয়ে যায়, ঠিক একইভাবে তাদের সুযোগ ঘটে অনবরত হিন্দি চলচ্চিত্র দেখারও।

সুভাষের জি-ই ভারতের প্রথম ক্যাবল কোম্পানি, যারা ২০০০ সালে ইন্টারনেট ওভার ক্যাবল সার্ভিস চালু করে। আর ২০০৩ সালে জি ভারতে প্রথম ডিরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) সার্ভিসও নিয়ে আসে। এভাবেই খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে, ভারতের নিজস্ব উদ্যোগে সৃষ্ট জি টিভিই পরিণত হয় দেশটির সবচেয়ে বড় গণমাধ্যমে। এবং আজও, সনি এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশন এবং স্টার প্লাসের মতো বিশাল দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর আগমনের পরও, প্রতিযোগিতায় বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে চ্যানেলটি।

সামগ্রিকভাবে জি টিভি নেটওয়ার্কে রয়েছে প্রায় ৯০টি চ্যানেল, যার মাধ্যমে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে ১.৩ বিলিয়নেরও বেশি দর্শক রয়েছে তাদের। ভারতে স্টার ও সনির পাশাপাশি জি-ই সবচেয়ে বড় টিভি নেটওয়ার্ক। ২০১৯ সালের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেও, দেশটির সেরা ১০ জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের তালিকায় স্টারের পাশাপাশি জি টিভি নেটওয়ার্কের রয়েছে তিনটি চ্যানেল। একটি করে চ্যানেল রয়েছে এন্টার ১০, সনি, সান ও ভায়াকম ১৮-এর।

সংবাদপত্রের লড়াইঃ ভারতের স্যাটেলাইট টিভি ইন্ডাস্ট্রিকে নিজ হাতে দাঁড় করানোর পরও, সুভাষের মনে দুটি অপূর্ণতা রয়েই গিয়েছিল। প্রথমটি হলো: ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তার যে সাফল্য, তেমনটি তিনি পাননি প্রিন্ট মিডিয়ায়। আর দ্বিতীয়টি হলো: ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তার সাফল্যও মূলত হিন্দিভাষীদের কল্যাণে। ইংরেজি ভাষায় তার বলার মতো তেমন কোনো সাফল্য নেই।

এই দুই অতৃপ্তি ঘোচানোর লক্ষ্য নিয়ে, ২০০৫ সালে দৈনিক ভাস্কর গ্রুপের সাথে হাত মিলিয়ে সুভাষ বাজারে নিয়ে আসেন নতুন একটি ইংরেজি সংবাদপত্র- ডিএনএ। তার লক্ষ্য ছিল, জেইন পরিবারের মালিকানাধীন টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকাকে হটিয়ে দিয়ে, ডিএনএ-ই হবে ভারতের সর্বাধিক পঠিত ইংরেজি সংবাদপত্র। শুরুর দিকে মুম্বাইয়ে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাথে লড়াই জমেছিল ডিএনএ-র, যা জায়গা করে নিয়েছে সংবাদপত্রের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য লড়াইসমূহের তালিকায়।

তবে এই লড়াইয়ে সুভাষ শুরুর দিকে একদমই সুবিধা করতে পারেননি। সরাসরি টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাথে লড়াই করে ডিএনএ প্রথম স্থান দখল করতে তো পারেইনি, বরং তাদেরকে প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাই ধীরে ধীরে টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে পেছনে ফেলার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে সরে আসে ডিএনএ। তাদের নতুন লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক প্রতিপন্ন হওয়া, পাশাপাশি ভারতের সেরা পাঁচটি ইংরেজি সংবাদপত্রের একটিতে পরিণত হওয়া। শেষোক্ত লক্ষ্যটি এখনো পূরণ না হলেও, অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তারা।

অন্যান্য ব্যবসাঃ সম্প্রচার মাধ্যমের পাশাপাশি, সুভাষের এসেল গ্রুপের কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে বিনোদন পার্ক, প্যাকেজিং থেকে শুরু করে অবকাঠামো, লটারি প্রভৃতির ব্যবসাতেও। এছাড়া তিনি জাহাজের ব্যবসায় প্রবেশ করেছেন জালেশ ব্র্যান্ড হিসেবে। সব মিলিয়ে, ২১ এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত সুভাষের মোট সম্পদের পরিমাণ ২.৬ বিলিয়ন। ফোর্বস বিলিয়নিয়ার্স ২০১৯ এর তালিকা অনুযায়ী, তিনি বিশ্বের ৯১৬তম ধনী।

গণমাধ্যমে সুভাষঃ জীবনের লম্বা একটা সময় পর্যন্ত পর্দার অন্তরালে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও, সম্প্রতি পর্দার সামনেও দেখা মিলছে তার। জি মিডিয়া কর্পোরেশনের ফ্ল্যাগশিপ অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে তার উপস্থাপনায় "ড. সুভাষ চন্দ্র শো"। জি নিউজ, জি বিজনেস-সহ জি নেটওয়ার্কের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি। এছাড়া ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনীমূলক বই, "দ্য জেড ফ্যাক্টর"। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

রাজনীতিতে আগমনঃ ২০১৬ সালে জি মিডিয়া গ্রুপের ডিরেক্টর এবং নন-এক্সিকিউটিভ পদ থেকে সরে দাঁড়ান সুভাষ। তখনই আন্দাজ করা গিয়েছিল যে, রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করতে চলেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তা-ই। ওই বছরই হরিয়ানার রাজ্যসভা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন তিনি। তবে তার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল ক্ষমতাসীন দল বিজেপির।

শেয়ার করুন:

এই পোস্টটি প্রকাশিত হয় ২৯ এপ্রিল ২০১৯, ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ

শেয়ার করুন

সর্বশেষ সংবাদ

  • লাইফস্টাইল

নোংরা শৌচাগার থেকে মূত্রাশয়ের সংক্রমণ

মূত্রাশয় বা মূত্রথলিতে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ প্রদাহ ও অস্বস্তি বাড়ায়। লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, ঘন…

২৬ মার্চ ২০২৪, ১:০২ অপরাহ্ণ
  • ইসলাম

টাকা-পয়সার ক্ষেত্রে স্বর্ণের নেসাব মানদণ্ড হবে নাকি রূপার?

মুফতি মুহাম্মাদ খাইরুল ইসলাম: ইসলামী শরীয়তে স্বর্ণ ও রুপা প্রত্যেকটির নেসাব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। একটি অপরটির…

২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৯ অপরাহ্ণ
  • লাইফস্টাইল

যেভাবে রমজানে তেল ছাড়া খাবার বানাবেন

রমজান দরজায় কড়া নাড়ছে। এ সময়টাতে ইফতার থেক সেহরিতে কী, খাবেন ঘরের রাঁধুনির জন্য তা…

৯ মার্চ ২০২৪, ৭:৪৪ অপরাহ্ণ