জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর কমপক্ষে চারটি আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনোনীত ধানের শীষের কোনো বৈধ প্রার্থী নেই। ফলে ওই সব আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে কেউ নির্বাচন করতে পারছে না! আসনগুলো হলো বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর), মানিকগঞ্জ-২ (সিংগাইর-হরিরামপুর), রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) ও ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ)। তবে বিএনপির যে সব প্রার্থী নির্বাচন করার বৈধতা হারিয়েছেন, আগামীকাল বুধবারের মধ্যে আপিলের মাধ্যমে আবার ভোটের মাঠে ফেরার সুযোগ রয়েছে তাঁদের। যদি আপিলের মাধ্যমেও দলীয় প্রার্থীরা ভোটে ফেরার সুযোগ না পান তাহলে ওই সব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়েই শূন্যস্থান পূরণের চিন্তা বিএনপির। তবে ওই আসনগুলোতে ধানের শীষ প্রতীক কেউ পাবেন না।
এদিকে নির্বাচন থেকে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াসহ হেভিওয়েট অনেক নেতা ছিটকে পড়লেও এ নিয়ে আর ভাবতে চাইছে না বিএনপির হাইকমান্ড। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে হেভিওয়েট প্রার্থীদের ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টা করবে তারা। তা না হলে যাঁরা বিকল্প প্রার্থী আছেন তাঁদেরকে সামনে রেখেই ভোটের মাঠে নামার ছক কষবে দলটি। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জানা গেছে, প্রার্থী চূড়ান্ত করতে গতকাল সোমবার রাতেও মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রার্থী বাতিলের পর কারা সবচেয়ে যোগ্য তা নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে বৈঠকে। এ ছাড়া ভোটের মাঠে কে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবে সে বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া জোটের শরিকদের শেষ পর্যন্ত কয়টি আসনে ছাড় দেওয়া হবে তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘সরকারের লক্ষ বিএনপিকে ভোট থেকে দূরে রাখা। তার প্রমাণ বেগম জিয়াসহ দলের জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করা। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তাঁদের ভোটে ফিরিয়ে আনার। সরকারের অপচেষ্টায় সেটা সম্ভব না হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা হবে।’
এবার জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৫ আসনে প্রায় ৮০০ প্রার্থীকে মনোনয়নের চিঠি দিয়েছিল বিএনপি। এর মধ্যে ৬৯৬ প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন দাখিল করে। গত রবিবার যাচাই-বাছাইয়ে খালেদা জিয়াসহ ৮১ প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়। গতকাল সোমবার বাতিল হওয়া ৪৬ প্রার্থী তাঁদের প্রার্থিতা ফিরে পেতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আপিল করেছেন।
তবে দলটির নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, এখনো বিএনপির যেসব প্রার্থী আছে তাঁদের মধ্য থেকে চূড়ান্ত প্রার্থী ঠিক করাও কঠিন কাজ। মনোনয়ন বোর্ডের নেতাদের বাসায় এখনো ভিড় লেগে আছে। কিন্তু ৮ ডিসেম্বরের আগে প্রার্থী চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে না। কারণ নির্বাচন কমিশনের আপিল নিষ্পত্তি হতে সময় লাগবে। এর মধ্যে বিএনপির হেভিওয়েট কোনো নেতার প্রার্থিতা বৈধ হলে তাঁকেই দলের চূড়ান্ত প্রার্থী করা হবে। নইলে বিকল্প প্রার্থী দিয়েই ভোটের লড়াইয়ে থাকবে বিএনপি।
বগুড়া থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসন নিয়ে ভাবনায় পড়েছে নেতাকর্মীরা। যাচাই-বাছাইয়ের সময় খালেদা জিয়াসহ তিন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করেছেন রিটার্নিং অফিসার। ফলে এ আসনটিতে এখন বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই। এমনকি ঐক্যফ্রন্টের কোনো প্রার্থীও এ আসনে নেই।
খালেদা জিয়া দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়া এবং উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ না করায় মোরশেদ মিল্টন ও সরকার বাদলের মনোনয়ন বাতিল করেন রিটার্নিং অফিসার। এতে করে দীর্ঘ ২৭ বছর পর বগুড়ার কোনো আসন থেকে জিয়া পরিবারের কোনো সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হলেন। খালেদা জিয়ার বিকল্প প্রার্থী মোরশেদ মিল্টন জানান, তিনি আপিল করবেন। কারণ গাবতলী উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেই তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। এ কারণে আপিল করলে তাঁর প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার ফয়েজ আহাম্মদ জানান, মামলায় সাজা হওয়ায় খালেদা জিয়া ও উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ না করায় ধানের শীষের অপর দুই প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। মোর্শেদ মিল্টনের পদত্যাগ করার কোনো কাগজপত্র তাঁরা পাননি। এখন আপিল শুনানিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আপিলেও বগুড়ার এ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী বৈধতা না পেলে কী হবে নির্বাচনের মাঠ? বিকল্প কাকে সমর্থন দেওয়া হবে সে ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন চাঁন। তাঁরা বলেছেন বিষয়টি কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
এ আসনে ১৪ প্রার্থীর মধ্যে খালেদা জিয়াসহ সাতজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। এখন যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হলেন জাতীয় পার্টির দুজন এ টি এম আমিনুল ইসলাম ও মুহাম্মদ আলতাফ আলী, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির দুজন ফজলুল হক ও মন্তেজার রহমান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের দুজন রিয়াজুল মোর্শেদ ও শহিদুল ইসলাম এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মজিবর রহমান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক নেতা জানান, যাঁরা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে কাউকে ধানের শীষের সমর্থন দেওয়ার সুযোগ নেই।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মানিকগঞ্জ-২ (সিংগাইর-হরিরামপুর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন দুজন। যাচাই-বাছাইয়ে দুজনেরই মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন রিটার্নিং অফিসার। বাতিল হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর মনোনয়নপত্রও। ঐক্যফ্রন্টের কোনো প্রার্থী নেই এ আসনে।
এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য মাঈনুল ইসলাম শান্ত ও সিংগাইর উপজেলা চেয়ারম্যান আবেদুর রহমান রোমান। রিটার্নিং অফিস সূত্রে জানা গেছে, শান্তর মনোনয়নপত্রে মহাসচিবের সইয়ে মিল না থাকার কারণে বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে আবিদুর রহমানের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায়।
এই আসনের বৈধ প্রার্থীরা হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মমতাজ বেগম, বিকল্পধারার গোলাম সারোয়ার মিলন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের মোহাম্মদ ফেরদৌস আহমেদ আসিফ ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মোহাম্মদ আলী।
রংপুর থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনে বিএনপির দুই প্রার্থীসহ চারজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় নির্বাচনী মাঠ অনেকটা ছোট হয়ে এসেছে। বাতিল হওয়া চার প্রার্থী হলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী শাহ সোলাইমান আলম ফকির, বিএনপির বিকল্প প্রার্থী ডা. মমতাজ হোসেন, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম মণ্ডল এবং সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মওদুদা আক্তার।
বিএনপির দাবি, শাহ্ সোলাইমান আলম ফকির বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী। কারণ অষ্টম সংসদ নির্বাচনে তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের এইচ এন আশিকুর রহমান। উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এ কে এম রুহুল্লাহ জুয়েল বলেন, বিএনপির দুজন প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে আপিল করেছেন। আমরা আইনি প্রক্রিয়া চালিয়ে যাব।
স্থানীয় ভোটাররা জানায়, ১০ প্রার্থীর মধ্যে বিএনপির শাহ্ সোলাইমান আলম ফকির বেশ প্রভাবশালী। এবারও মাঠ সরগরম করেছিলেন তিনি। কিন্তু মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে। আপিলের পর শাহ্ সোলাইমান আলম ফকির নির্বাচনের বৈধতা না পেলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য মাঠে বড় কোনো বাধাই থাকবে না।
দোহার-নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-১ আসনে নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হিসেবে বিএনপি দলীয় মনোনয়নের চিঠি দিয়েছিল ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান খোন্দকার আবু আশফাক ও সাবেক সংসদ সদস্য ফাহিমা হোসাইন জুবলীকে। গত রবিবার মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে তাঁদের দুজনেরই মনোনয়ন বাতিল বলে করেন রিটার্নিং অফিসার। খোন্দকার আবু আশফাক প্রার্থিতা ফিরে পেতে গতকাল বিকেলে আপিল করেছেন।
জানা গেছে, ঢাকা-১ আসনে বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের অন্য কেউ মনোনয়ন জমা দেননি। ফলে ধানের শীষ প্রতীকের আর কেউ থাকছেন না এ আসনে। আর আওয়ামী লীগ থেকে এ আসনে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়েছেন বেক্সিমকো গ্রুপের মালিক সালমান এফ রহমান। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী থেকে নির্বাচন করছেন শিল্পপতি নুরুল ইসলাম বাবুলের স্ত্রী বর্তমান সংসদ সদস্য সালমা ইসলাম। মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাক বলেন, ‘আমি গত ২৮ নভেম্বর জেলা প্রশাসন (স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে) ও আমার নির্বাচনী এলাকা নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলাম। সুতরাং আমার মনোনয়নপত্র বাতিলের কোনো সুযোগ নেই।