বাংলাদেশ পুলিশের বিরুদ্ধে সবসময় গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ করে বিএনপি। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি এবার রাজনৈতিক কারণে হয়রানিমূলক মামলার যে তালিকা করেছে তা লেনদেনের বিনিময়ে তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ৭ নভেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই তালিকা সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। জানা গেছে, এই তালিকার ৮০ ভাগ ব্যক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিএনপির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এরা চিহ্নিত অপরাধী এবং সন্ত্রাসী। এদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এবং চুরির মামলা রয়েছে।
কিছুদিন আগে বিএনপি ২০ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীর তালিকা সরকারের কাছে জমা দিয়েছে যাদের বিরুদ্ধে গায়েবানা মামলা রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় সেই তালিকা পর্যালোচনা করে দেখেছে তালিকার অধিকাংশই চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ অথবা ছিনতাইকারী যাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা নয়, বরং একাধিক চুরি, ছিনতাই অথবা চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে।
তবে এই তালিকায় ২ হাজার জনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা রয়েছে বলে চিহ্নিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ তালিকার কয়েকজন রাজনৈতিক কারণে ভুক্তভোগী থাকলেও প্রায় ৮০ ভাগই বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত। এদের অনেকে মামলা হওয়ার পরে বিএনপিতে যোগ দিয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিপুল পরিমাণ উৎকোচের বিনিময়ে রাজনৈতিক মামলায় ভুক্তভোগী হিসেবে একেকজনের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধানমন্ডিতে গত বছর ১১ অক্টোবর একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
প্রকাশ্য দিবালোকে একটি গাড়িতে গুলি করে ২০ লাখ টাকা ছিনতাই করা হয়। সেই ছিনতাই মামলার তিনজন সুনির্দিষ্ট আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, পরবর্তীতে এরা জামিনে বেরিয়ে যায়।
জামিনে বেরিয়ে যাওয়ার পর এই তিন আসামি নিজেদের বিএনপি কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়। তালিকায় এই ছিনতাইকারীদের জন্যও সুপারিশ করা হয়েছে।
দেশের আরেক প্রান্ত মাগুরায় এক ডাকাতির মামলায় ৪ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালত চার্জশিট দেওয়ার পর পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পায়। এই জামিন প্রাপ্তদেরকেও রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বিএনপি সুপারিশ করেছে।
দিনাজপুরে গত বছরে একটি জমি দখলের সন্ত্রাসী মামলায় দুই পক্ষের গোলাগুলি হয় এবং উভয়পক্ষ মামলা করে। এই ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। বিএনপির প্রস্তুতকৃত তালিকায় দেখা যাচ্ছে জমি দখলের মামলার আসামিরাও বিএনপির নেতা বনে গেছেন।
নাটোরে ১৪ জনের নামের তালিকা পাওয়া গেছে যাদের বিরুদ্ধে একটি ধান কাটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখন তাদেরকেও বিএনপি নিজেদের নেতা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
আবার নরসিংদীতেও একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল যারা পরবর্তীতে আদালত থেকে জামিন পায়। তারাও বিএনপির নেতা হিসেবে তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, সুনির্দিষ্ট যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং মামলাগুলো রাজনৈতিক হয়রানি মূলক বলেই এই নামগুলো সুপারিশ করা হয়েছে।
কিন্তু তালিকার নামগুলো কারা দিয়েছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, স্থানীয় বিএনপি নেতারা এই নামগুলো দিয়েছে। একাধিক সূত্র বলছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং যারা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা বিএনপির রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে পরিত্রাণ পেতে চাইছেন।
মামলা ভেদে বিএনপির লোকেরা এ তালিকায় নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মজার বিষয় হচ্ছে, এই তালিকায় যাদের নাম পাওয়া গেছে, কয়েকজন ছাড়া তাঁদের মধ্যে কেউই বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নন। রাজনৈতিক কারণে হয়রানিমূলক মামলা রয়েছে, এই তালিকায় বিএনপির এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতার নাম নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমূল বিশ্বাসের কথা। তিনি দীর্ঘদিন যাবত গ্রেপ্তার, তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে।
রাজশাহী অঞ্চলের বাঘমারার বিএনপি যুগ্ম সম্পাদক রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার কিন্তু তাঁর নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। জানা গেছে, যারা বিএনপির নেতাদের খুশি করতে পারেনি তাদের নাম এই তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। মামলা তালিকার নামে বিএনপি একটি বড় ধরনের বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।