একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আসামি হয়েছেন জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুল হান্নানের জবানবন্দীর ভিত্তিতে। হরকাতুল জিহাদের এই নেতা আদালতে যা বলেছেন, তার একটি ভিডিও আছে সামাজিক মাধ্যম ইউটিউবে।
এই ভিডিওতে মুফতি হান্নান তার জঙ্গি জীবনে জড়িয়ে পড়া, বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা, এই পরিকল্পনায় সে সময়ের সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর সম্পৃক্ততা, একাধিক বৈঠকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের উপস্থিতি, তার সহযোগিতার আশ্বাসের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
হামলার পরের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বিএনপির সমালোচনা আছে। হামলার পরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলাকারীদেরকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে।আবার আলামত নষ্ট, প্রকৃত হামলাকারীদেরকে বাঁচিয়ে জজ মিয়া নামে নিরীহ একজনকে ফাঁসানোর চেষ্টা, হামলাকারীদের মধ্যে অন্যতম মাওলানা তাজউদ্দিনকে গোয়েন্দা সহায়তায় ভিন্ন নামে পাসপোর্টে দেশ ছাড়তে সহযোগিতার অভিযোগও আছে।
এর সবই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে প্রকাশ হয়। আর সে সময় আদালতে দেয়া প্রতিবেদনে জোট সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টুসহ ২২ জনকে আসামি করে বিচার শুরু হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে আসামি হন তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফু্জ্জামান বাবর, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ,
খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ গোয়েন্দা সংস্থার বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পুলিশের তিনজন সাবেক আইজি, জোট সরকারের আমলে তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা।
সব মিলিয়ে ৫২ জন আসামির মধ্যে তিন জনের ফাঁসি কার্যযকর হয়েছে অন্য মামলায়। বাকি ৪৯ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হবে আজ। আর আসামিদের সিংহভাগেরই মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
মুফতি হান্নান তার ভিডিও জবানবন্দিতে জানান, ২১ গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তিনি যুক্ত হন ১৮ তারিখে। হরকাতুল জেহাদের সাংগঠনিক সম্পাদক তাকে লোক মারফত জরুরি খবর পাঠিয়ে ওই বৈঠকে ডেকে নেন।
তখন হান্নানের বাসা ছিল মেরুল বাড্ডার আনন্দনগর। সেখান থেকে তিনি যান মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে দারুল আরকা মাদ্রাসায়। সেখানে ছিলেন শেখ ফরিদ এবং হুজির সে সময়ের আমির মাওলানা আব্দুস সালাম, আওসানুল্লা কাজল এবং কমান্ডার জাহাঙ্গীর বাদল জান্দাল।
মুফতি হান্নান বলেন, ‘ওখানে আলোচনা হয়, ওরা পূর্বের আলোচনা করলেন। বললেন আমাদের সঙ্গে বিএনপির হাওয়া ভবনে মিটিং হয়েছিল। ওখানে তিনটা মিটিং হয়েছিল, আমরা সব কয়টা মিটিং-এ অংশগ্রহণ করেছি।’
‘ওনারা বললেন প্রথম মিটিংটা ১৪ তারিখে হয়েছিল, ওই মিটিং-এ উপস্থিত ছিল তারেক জিয়া, আলী আহসান মুজাহিদ সাব, হারিছ চৌধুরী এবং আবদুস সালাম পিন্টু সাব এবং হরকাতুল জেহাদের আমির মাওলানা আব্দুস সালাম সাব, শেখ ফরিদ সাব এবং আল-মারকাজুল ইসলামের নায়েবে আমির মুফতি আবদুল সাব।’
“এখানে তারেক জিয়াসহ আলোচনা করেন, ‘বর্তমান দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। যে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা এই দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতেছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দিচ্ছে। জঙ্গিবাদ করে দেশকে উৎশৃঙ্খল ও নষ্ট করে দিচ্ছে। এবার আমাদের একটা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’
“এরপরে আলী আহসান মুজাহিদ সাব বলেন, ‘কথা সত্য…শুধু তাই নয় ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করতেছে। অতএব এর বিরুদ্ধে একটা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’ ‘এরপরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফর জামান বাবর সাব বললেন, ‘কথাগুলো সবই সত্য, এখন পরিস্কারভাবে বলেন কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?’
‘উনি (তারেক রহমান) বললেন এখানে দুইটা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। হয়ত এ দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হইছে সেটার রাজনৈতিক মোকাবেলা করা দরকার ব্যাপকভাবে। নচেৎ তাকে এ দেশ থেকে চিরবিদায় করে দিতে হবে অর্থাৎ তাকে শেষ করে দেওয়ার দরকার।’
ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর নূর চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান মুফতি হান্নান। তিনি এখন কানাডায় আছেন। তারেক রহমান তাকে কিছু বলতে বলার পর তিনি বলেন, ‘আপনারা রাজনৈতিকভাবে অবশ্যই মোকাবেলা করবেন।
কিন্তু আমি তো রাজনীতি করি না। এটার জন্য তিনটা পদক্ষেপ নিতে হবে। এক. তার বাড়িতে হামলা বা আক্রমণ করতে হবে অথবা তার আসা যাওয়ার পথে আক্রমণ করে মেরে ফেলতে হবে। নচেৎ তার কোনো মিটিং-এ তাকে আক্রমণ করে মেরে ফেলতে হবে।’
নূর আরও বলেন, ‘তবে একটা কথা আছে যেন জনগণের ক্ষতি না হয়। যত কম ক্ষতি করে তাকে শেষ করা যায় এই চিন্তাটা করেন।’ তখন বাবর বলেন, ‘আমার কাছে গ্রেনেড আছে…এই গ্রেনেডও ব্যবহার করা যেতে পারে।’
মেজর নূর বলেন, ‘গ্রেনেড দিয়ে যদি হয় তবে কোনো রাস্তায় আক্রমণ করা যাবে না। ওনাকে কেনো মিটিং-এ আক্রমণ করতে হবে। মিটিং-এ আক্রমণ করলে কামিয়াব (সফল) হওয়া যাবে।
এই পর্যায়ে বৈঠক শেষ হয় বলে জানান মুফতি হান্নান। পরে আবার এক বৈঠকে ডাকা হবে জানিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, গ্রেনেড যখন আছে তখন রাইফেল, অর্থাৎ অস্ত্র প্রয়োজন হবে। এটা করা হলে মানুষ কম মারা যাবে। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় নেন গ্রেনেডই ব্যবহার করা হবে।
বাবর বলেন, ‘২১ তারিখে পল্টনের কাছাকাছি মিটিং ডেকেছে মুক্তাঙ্গনে। সেখানে মিটিং-এর অনুমতি দিয়েছি ওখানেই এই পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।’ বৈঠকে আরও জানানো হয়, পুলিশও থাকবে তাছাড়া গোয়েন্দার লোকেরাও থেকে সহযোগিতা করবে।
মুফতি হান্নান জানান, এরপর বৈঠক হয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের সরকারি বাসভবনে। সেখানে তারেক রহমান ছাড়াও জামায়াত নোত মুজাহিদ, হারিছ চৌধুরী, আবসুদ সালাম পিন্টু, হরকাতুল জেহাদের আমির মাওলানা আব্দুস সালাম সাব, শেখ ফরিদ সাব এবং আল-মারকাজুল ইসলামের নায়েবে আমীর মূফতি আবদুল উপস্থিত ছিলেন।
হামলার তিন দিন আগে ১৮ আগস্ট হরকাতুল হিহাদের অফিসে মাওলানা শেখ ফরিদ, আওসানুল্লা কাজল, মাওলানা আব্দুস সালাম ও আমাদের কমান্ডার জাহাঙ্গীর বাদল জান্দালসহ উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসায় যান হানান। সেখানে পিন্টুর ছোট ভাই তাজউদ্দিন ও তার আত্মীয় মাওলানা আবু তাহের ছিলেন।
সেখানে কালো রঙের পাজারো আসে এবং একটি থেকে বাবর নামেন। আরেকটা গাড়ি থেকে তিনজন লোক নামেন। তারা সবাই মিলে ভেতরে বৈঠক করেন। তারপর তাদের সঙ্গে পরিচিত হন হান্নানরা।
ওই বৈঠকে বাবর বলেন, ‘গতকাল যে গ্রেনেডগুলোর কথা বলছি ওইগুলা আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি।’ এরপর তিনি কালো রঙের একটা ব্যাগ থেকে গ্রেনেডগুলো বের করে দেন। প্রথমে দুইটা প্যাকেট বের করেন তিনি সেখানে পাঁচটা করে গ্রেনেড ছিল।
‘সেটা আমি নিয়ে টেবিলে রাখি। ওখানে দুইটা গ্রেনেডের মুখ খোলা ছিল মোট ১২টা গ্রেনেড বাবর সাহেব আমাদের হ্যান্ডওভার করে দেন’-বলেন হান্নান।এই গ্রেনেড দিয়েই ২১ আগস্ট হামলা হয় আওয়ামী লীগের জনসভায়। আর এতে প্রাণ হারায় ২৩ জন। আহত হয় কয়েকশ।