পাসপোর্টে আবেদনকারীর নামের বানান, জন্মের তারিখ পরিবর্তন কিংবা সংশোধন নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর। নাম ও জন্মের তারিখ সংশোধনের জন্য আবেদনকারীদের জমা দেয়া পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিচ্ছে অধিদফতর।
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনেকেই একাধিকবার নিজেদের নাম ও জন্মের তারিখ পরিবর্তনের আবেদন করেন। প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট দেখে অধিদফতর তাদের পাসপোর্টের নাম পরিবর্তন করে দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে পরবর্তীতে সমস্যা তৈরি হয়।
দেখা যায়, নাম ও জন্মের তারিখ পরিবর্তনের কারণে একই ব্যক্তির তিন ধরনের নামে তিনটি পাসপোর্ট ইস্যু হয়। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন বিভাগের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে পাসপোর্টে নাম ও জন্মের তারিখ পরিবর্তন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদফতর।
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পাসপোর্টে উল্লেখিত নাম (নামের বানান) ও জন্মতারিখ আর কখনও সংশোধন হবে না। আমরা এটা বন্ধ করেছি। এ ধরনের কাজের জন্য আমাদের ইমপ্রেশন ডাউন হচ্ছে।’
‘পৃথিবীর কোনো দেশে এই তথ্য সংশোধন হয় না। আপনি কেন নাম পরিবর্তন করবেন? একটা মানুষের জন্মের তারিখ একাধিক হতে পারে না। কেউ যদি কারেকশন (সংশোধন) করতে আসেন তাহলে আমাদের সন্দেহ হয় যে, সে টেরোরিস্ট অ্যাক্টিভিটিজের (সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে) সঙ্গে জড়িত কি না? তাই আমরা সংশোধন বন্ধ রেখেছি।’ ‘তবে আবেদনকারীরা বৈবাহিক অবস্থা, বর্তমান ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি তথ্য পরিবর্তন করতে পারবেন’- যোগ করেন তিনি।
অধিদফতরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে একটি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বিদেশিরা বাংলাদেশি কয়েকজন ব্যক্তির পাসপোর্ট উপস্থাপন করেন। দেখা যায়, এক বাংলদেশির চারটি পাসপোর্ট (দুটি হাতে লেখা, দুটি এমআরপি)। পাসপোর্ট চারটির জন্মতারিখ ছিল চার রকম।
‘একজন মানুষের চার রকম জন্মতারিখ কীভাবে হয়?’ সভায় পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মকর্তাদের কাছে এমন প্রশ্ন রাখেন দূতাবাসের প্রতিনিধিরা। অধিদফতরের কর্মকর্তারা একে ‘প্রিন্টিং মিসটেক’ (ছাপানোয় ভুল) বলে উল্লেখ করলেও সেটি কোনো বিদেশির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
তারা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বলেন, ‘কয়বার ভুল হয়? একটা মানুষের জন্মতারিখ চারবার কীভাবে ভুল হয়?’ তারা পাসপোর্টে ভিন্ন ভিন্ন নামধারী বাংলাদেশিদের পরবর্তীতে তাদের দেশে প্রবেশের অনুমতি না দেয়ার মতো কঠোর সিদ্ধান্তের কথাও জানান।
দূতাবাসের প্রতিনিধিদের ওই কঠোর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পাসপোর্ট অধিদফতর নাম ও জন্মের তারিখ পরিবর্তন কিংবা সংশোধনের সুযোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একবার পুলিশি ভেরিফিকেশন হয়। অনেকেই প্রথমে আসল নামে পাসপোর্ট তৈরি করেন। পরে ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে নাম পরিবর্তন করেন। নাম পরিবর্তনের সময় কোনো ধরনের পুলিশি ভেরিফিকেশন হয় না। এজন্য স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট কিংবা স্থানীয় কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র থাকলেই চলে।
পাসপোর্টে নাম পরিবর্তন করে অনেকেই অপরাধ সংঘটিত করে দেশ থেকে পালিয়ে যান। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) থেকে এমন কয়েকজনের বিরুদ্ধে এ ধরনের তথ্য পাওয়ার কথা জানান অধিদফতরের ওই কর্মকর্তা।
এদিকে পাসপোর্টে নাম ও জন্মতারিখ সংশোধন বন্ধ করে দেয়ায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অনেককে। মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম নাহিদ নামে এক আবেদনকারী বলেন, সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল।
জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) নামের প্রথম অংশ মোহাম্মদ একটি ‘এম’ দিয়ে লেখা। কিন্তু পাসপোর্টে দুটি ‘এম’ বসানো হয়েছে। নামের দুই বানানের কারণে দূতাবাস এখন আমাকে ভিসা দিচ্ছে না।
এছাড়া স্কুল সার্টিফিকেট ও পাসপোর্টে জন্মতারিখে ভুল থাকায় অনেকেই বিদেশে চাকরি ও ভিসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সাকি চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ী জানান, সাভারের গেন্ডায় এক দালালকে দিয়ে ২০০১ সালে হাতে লেখা পাসপোর্ট করাই। সেখানে তিনি আমার জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি উল্লেখ করেন।
এমনকি এলাকার আরও যারা তাকে দিয়ে পাসপোর্ট করিয়েছেন, সবার জন্মসাল ঠিক রেখে তারিখ ১ জানুয়ারি করা হয়েছে। এখন অনেক চেষ্টা করেও তা পরিবর্তন করতে পারছি না। একবার সংশোধনের জন্য দেয়া হলেও দুই মাস পাসপোর্ট আটকে রেখে বলা হয়, সংশোধন সম্ভব নয়।
একই অভিযোগ পুরান ঢাকার এক বাসিন্দার। তিনি জানান, নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশনের সময় শিক্ষক আমাদের নামের আগে এমডি (মোহাম্মদ) জুড়ে দিয়েছিলেন। জাতীয় পরিচয়পত্রেও এমডি উল্লেখ আছে। কিন্তু পাসপোর্ট করাতে আসলে তারা জানান, পাসপোর্টে ‘এমডি’ উল্লেখ করা যায় না। এ কারণে ‘এমডি’ বাদ দিয়েই আবেদন করেছি।
২০১৮ সালে ম্যারিনারের ১৮তম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে বের হয়েছেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার রবিনসন অর্ণব দাস। তার এসএসসি সার্টিফিকেট ও এনআইডিতে জন্মতারিখ ১১ নভেম্বর ১৯৯৮ দেয়া। কিন্তু পাসপোর্টে ‘ভুলবশত’ ৪ মে ১৯৯৫ ছাপা হয়েছে। তিনি জানান, ভবিষ্যতে তার ক্যাপ্টেন হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এই ভুলের জন্য তিনি বিদেশি কিংবা দেশি কোনো জাহাজে চাকরি পাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ‘পাসপোর্টে সংশোধন আনা হলে অনেক দেশ আমাদের ভিসা দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আমরা আবেদনকারীদের আগেও বলেছি এবং এখনও বলছি যে, পাসপোর্ট করার পর আর কেউ তথ্য পরিবর্তন করতে পারবেন না।’
‘অ্যাপ্লিকেশন প্রসেসে তাকে একটা প্রুফ কপি দেয়া হবে। আবেদনকারী সেটা চেক করে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর দেবেন যে, তিনি সজ্ঞানে দেখেছেন এখানে কোনো ভুলভ্রান্তি নেই। এরপর আর কোনো সংশোধন কিংবা পরিবর্তন হবে না’- যোগ করেন তিনি।