কান্না থামছে না বাসের ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে পড়ে নিহত আকিফার কুষ্টিয়ার বাড়িতে। আকিফার সারা দিনের খেলার সাথী সেই পুতুলকে দেখছেন আর কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বাবা হারুন উর রশিদ ও মা রিনা বেগম।
অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন তারা। কিছুতেই মনকে বোঝাতে করতে পারছেন না রিনা বেগম। নিজের কোল থেকে আদরের সন্তানকে কেড়ে নিয়ে যাওয়ার সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি সারাক্ষণ তাকে তাড়া করছে। সন্তানকে রক্ষা করতে না পারার যন্ত্রণা তাকে বারবার কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিছুতেই তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না।
তাদেরকে সান্তনা দিচ্ছেন তাদের ১২ বছরের মেয়ে সুরাইয়া খাতুন রানী। সান্তনা দিতে গিয়ে সেও মাঝে মাঝে কেঁদে উঠছে। বাড়িতে তখন রয়েছে আশপাশের মানুষ। সরাব চোখেই জল।
আকিফা বাবা-মায়ের সঙ্গে যে ঘরে থাকত সেই ঘরের ঢুকতেই দেখা গেল, বিছানায় পড়ে আছে তারই খেলার সাথী পুতুল। যেই পুতুলকে নিয়ে অনেক স্মৃতি রয়েছে আকিফার। সেই পুতুলের সঙ্গে তোলা আকিফার একটি ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে শিশু আকিফা খাতুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে তখনও শোকের মাতম চলছে। আদরের সন্তানকে হারিয়ে সেই থেকে মা রিনা খাতুন কেঁদেই চলেছেন। বাবা হারুন অর রশিদ যেন পাথর হয়ে গেছেন। কেউই তাদেরকে সান্তনা দিতে পারছেন না। গত দুদিন ধরে না খেয়ে আছেন রিনা খাতুন।
রিনা খাতুন আর হারুন অর রশিদ দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছিল আকিফা খাতুন। বয়স মাত্র এক বছর। সবার বড় ছেলে রোহান (১৫) কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র।
আর মেয়ে রাণী (১২) কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুলের ষষ্ট শ্রেণির ছাত্রী। হতদরিদ্র হারুন উর রশিদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। জীবিকার তাগিদে কখনো ভূষা মাল আবার কখনো সবজির ব্যবসা করেন হারুন অর রশীদ।
কান্নায় ভেঙে পড়ে আকিফার মা রিনা খাতুন বলেন, সেদিন কেন যে বাপের বাড়ি যেতে চাইলাম। না গেলে হয়তো বাস আমার আকিফাকে এভাবে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারতো না।
শিশুটির বাবা হারুন উর রশিদ বলেন, মেয়ে আকিফাকে নিয়ে মঙ্গলবার সকালে রিনা দহকোলায় আমার শ্বশুরবাড়ি যেতে চায়। কিন্তু আমার পকেটে একটা টাকাও ছিল না। রিনাকে বলি তুমি চৌড়হাসের নুপুর বেকারি থেকে আমার কথা বলে একশো টাকা চেয়ে নিয়ে দহকোলা চলে যাও।
এদিকে শিশু আকিফার মৃত্যুর ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন, গঞ্জেরাজ বাসের মালিক জয়নাল আবেদিন, চালক খোকন মিয়া ও সুপারভাইজার ইউনুচ মাষ্টার। এদের সবার বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। বৃহস্পতিবার রাতে নিহত আকিফার বাবা হারুন উর রশিদ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার বাদীর অভিযোগ, দণ্ডবিধি ৩০২ ধারায় মামলাটি আমলে নেয়ার দাবি করলেও পুলিশ তা নেননি। তবে পুলিশ বলছে, নিরাপদ সড়ক আইনটি এখনো গেজেটভুক্ত হয়নি। তাই দণ্ডবিধি ৩০২ ধারায় মামলা নেয়া হয়নি।
মামলার বাদী ও শিশুটির বাবা হারুন উর রশিদ বলেন, আমার মেয়েকে ওরা ইচ্ছা করে বাসচাপা দিয়ে হত্যা করেছে। আমি পুলিশের কাছে বার বার আকুতি করেছি হত্যা মামলা নিতে। কিন্তু পুলিশ আমাকে নানাভাবে বুঝিয়ে দন্ডবিধি ৩০৪(খ) ধারায় মামলা নিয়েছে। যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছরের জেল।
তিনি বলেন, ভিডিওটি দেখলেই বুঝতে পারবেন, বেপরোয়া বাসচালক আমার স্ত্রীকে তিনবার ধাক্কা দিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কায় আমার মেয়ে তার মায়ের কোল থেকে পড়ে যায়নি। তৃতীয়বার ধাক্কা মারার পর আমার মেয়ে তার মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে যায়।
নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, টাকা কিংবা ক্ষমতার কাছে নত হব না। যাতে আর কোন বাবা-মা’য়ের কোলে মৃত সন্তানের লাশ বহন করতে না হয়। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম বলেন, চালকের অবহেলায় দুর্ঘটনার বর্তমান আইনের শাস্তি রীতিমত হাস্যকর।
একজন গাড়িচালক বেপরোয়াভাবে অথবা ইচ্ছে করে মানুষ মেরে ফেলে শাস্তি হবে সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল বা জরিমানা। এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।