নারী

অনুগ্রহ করে ছোটরা পড়বেন না- কোথায় যাচ্ছে সমাজটা

মিরপুর বাংলা কলেজের কাছাকাছি বাসটি আসার পর জনৈক ভদ্রমহিলা তার পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা তোমার বয়সী আমার ছেলে রয়েছে (তাদের কেউ একজন ভদ্রমহিলার গায়ে হাত দিয়েছিল)।

ছাত্রগুলো ছিল বাংলা কলেজের ক্ষমতাসীনদলের নেতাগোছের। ভদ্রমহিলার কথা শুনে তাদের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠল, আপনাকে এখন বাস থেকে নামিয়ে কলেজের হোস্টেলে ঢুকিয়ে সবাই মিলে যা যা করার সব করে কাপড় খুলে ছেড়ে রাস্তায় দিব। পুরো বাস ভর্তি মনুষগুলো অনেকটা থমকে যায়। হঠাৎ করেই পঁয়তাল্লিশ উর্ধ্ব একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে যায়। খুবই সাহসী ও বলিষ্ঠ ভঙ্গিমায় বলে ওঠেন, হে তরুণেরা শোন- তোমাদের জন্ম হয়তো ১৯৮৪-৮৫ পরে।

১৯৭৪-৭৫ সালে যখন কোন মা সম্মান রক্ষার্থে তাদের যুবতী সন্তানদের নিয়ে বাসায় থাকতে পারত না। তখনকার পরিনতি তোদের জানা নেই। ক্ষমতায় আছিস তো কি হয়েছে? তোদের সবগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে ভাসিয়ে দিব, দেখি কে তোদের বাঁচাতে আসে। তার এ কথাগুলো উচ্চারনের সাথে পুরো বাস যেন দাঁড়িয়ে যায়। আর বখাটে ছাত্র নামের কলঙ্কগুলো ক্ষমা চেয়ে মাথা নিচু করে বাস থেকে নেমে যায়।

ঘটনা- ২: ষাটোর্ধ রহমত আলি প্রতিবেশি এক ভাতিজার সাথে জীবিকার সন্ধানে জীবনে প্রথম বারের মত সুদূর ঠাকুরগাঁও থেকে ঢাকা আসছিলেন। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে নামার পরে সায়েদাবাদের উদ্দেশ্যে ৮ নম্বর বাসে উঠছিলেন। বাসে প্রচন্ড ভীড় থাকায় গ্রাম থেকে আসা অনভ্যস্ত সরল প্রকৃতির প্রবীন মানুষটির দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল।

এরই মধ্যে কল্যাণপুর থেকে বাসটিতে উঠা হাল যামানার ডিজুস প্রকৃতির একটি ছেলে চাচা মিয়ার ( রহমত আলি) পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা ধাক্কা লাগায় খুবই উদ্ধত, রুক্ষ ও বাজে ভাষায় প্রবীণ মানুষটিকে ধমকাতে থাকে। তাচ্ছিলের স্বরে তরুণটি আরো বলে ওঠে, “যতসব ক্ষেত-রাবিশগুলো যে কোথা থেকে আসে!?”

ঘটনা- ৩: ভীড়ের মধ্যে বাসের সিটে বসা পঞ্চাশোর্ধ একজন ব্যক্তি তারচেয়েও বয়সে প্রবীণ দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে তার সিটে এনে বসিয়ে দিলেন। রাজধানীতে যাত্রীদের বিশেষ করে মহিলাদের বাসের দুর্ভোগ সহজেই দূর করা যায়: রাজধানীতে পরিবহন সমস্যা কতটা প্রকট তা ভুক্তভোগী মাত্রই অবগত। এক্ষেত্রে মহিলা যাত্রীদের সমস্যা আরো মারাত্বক।

সত্যিকার অর্থে তাদের জন্য বাসের অর্ধেক কিংবা সবগুলো সিট সংরক্ষণ করে কিছু সার্ভিস চালু করা যায়। একবার মহিলাদের জন্য আলাদা বাস চালু করা হয়েছিল , কিন্তু প্রথম আলো পত্রিকার বিরোধীতা ও অপপ্রচারে সে সার্ভিস ভালো করতে পারেনি।

ঢাবির ছাত্র বাসগুলোতেও প্রচন্ড ভিড় হয় , মেয়েদের জন্য সামনে ও ছেলেদের জন্য পেছনে বরাদ্দ থাকার দরুন একদিকে যেমন কোন সমস্যার উদ্ভব হয়না, অন্যদিকে অধিক শিক্ষার্থী যাতায়াত করতে পারে।

এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলোর মত মহিলারা সামনের গেট দিয়ে সামনে সিটগুলোতে বসে বা দাঁড়িয়ে যাবেন আর পুরুষদের জন্য থাকবে পেছনের গেট ও সিটগুলো। সেক্ষেত্রে ঝামেলাবিহীন ও শালীনভাবে বর্তমানের চেয়ে অধিক যাত্রী পরিবহনও সম্ভব। কেন যে এই সহজ ব্যবস্থাটি করা হয় না!!!!

নারী বাদীরাও কখনো এই দাবীটি করেছেন বলে আমার জানা নেই। বাসের অধিকাংশ হেলপারই মহিলা যাত্রীদের সহযোগিতার নামে সংকীর্ণ গেটটিতে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত খারাপ আচরন করে থাকে। এক্ষেত্রে যাত্রী বোনেরা কেউ কেউ নিরবে হজম করতে বাধ্য হন।

আমার পরামর্শ হলো বাসে ওঠা কিংবা নামার সময় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি ঘটার আগেই হেলপারকে ধমকের সরে সরে দাঁড়াতে বলুন- আশা করি এতে শতভাগ কাজ হবে। নারীদের নিরাপদ যাতায়াত ও শপিংয়ের সুযোগ করা যায় অনায়াসেই। অথচ এই দু’টি ক্ষেত্রেই আমাদের মা-বোনেরা প্রতিনিয়ত হয়রানী ও বিব্রতকর অবস্থার শিকার হচ্ছেন। গাউসিয়ার মতো শপিং সেন্টারগুলোর ভীড় কতটা ভয়াবহ বিশেষ করে ঈদের মার্কেটে তা নিশ্চয়ই কম বেশি সকলেই অবগত। আজ থেকে প্রায় ১৫ বছরে পূর্বে যখন ঢাকা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম তখনকার গাউছিয়ার অবস্থা কতটা ভয়াবহ ছিল, তা ব্লগে প্রকাশ করার মতো নয়। অবশ্য এই দীর্ঘ সময় পরে অধপতন কতদূর গড়িয়েছে তা ধারনাও বাইরে।

বাংলাদেশে এখনও আমাদের মা-বোনেদের প্রায় ৮০ শতাংশই বাইরে কোন চাকরি করেন না। ফলে শপিংয়ের কাজটা মহিলারা করতে পারলে তা চাকরিজীবী পুরুষদের জন্য অনেকটাই সুবিধার।

মহিলাদের অনেক প্রয়োজনীয় কেনা-কাটাও করতে হয় কোন পুরুষ সেলস ম্যানের কাছ থেকে। যা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জন্য বিব্রতকর। তাদের শপিংয়ের জন্য আলাদা ফিমেল কর্নার হওয়া উচিত। এতে নারীদের কর্ম সংস্থানেরও সুযোগ হবে। শুধু রাজধানীতেই মহিলাদের পোশাকের কমপক্ষে ১০ হাজার স্টোর রয়েছে। যার ৯৯% এর বিক্রেতাই পুরুষ।

এগুলো নারীদের দ্বারা পরিচালিত হওয়াটাই সমীচীন ছিল। তাছাড়া গাউছিয়ার মত শপিং সেন্টারগুলোতে ফিমেলদের জন্য ‘ফিমেল আওয়ার’ কিংবা ‘ফিমেল ডে’ (যে ঘন্টা কিংবা দিবস গুলোতে কেবল মহিলারাই শপিং করতে পারবে) ঘোষণা করার মাধ্যমে সহজেই তাদের নিরাপাত্তার সাথে কেনা-কাটার সুযোগ দেয়া যায়। অবশ্য নারীবাদীরা এর বিরোধিতাও করতে পারে।

পর্দা নারীর অধিকার ও উন্নতি পথে অন্তরায় নয়, বরং পর্দাহীনতাই তার জন্য জুলুম। তুরস্কের ফার্স্ট লেডিকে স্কার্ফ পরার কারনে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি আপনার মাথাটাই ঢেকে ফেলেছেন। তার জবাব ছিল- মাথা ঢাকলেও মগজ ঢাকিনি।

মুসলিম মেয়েরা আমাদের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা তথা সর্বোপরি মহান প্রতিপালকের হুকুম পালনে মাথা ঢাকলেও মগজ ঢাকেনা। এক্ষেত্রে ইসলামপন্থিরা সময়কে যথার্থ অর্থে ধারণ করতে না পারায় তরুণ সমাজকে অন্ধকারে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল সুশীলরা আরো সহজেই বিপথগামী করতে পারছে:

বাংলাদেশের ইসলামপন্থী মা-বোনেরা স্কুল-কলেজ-শপিং সব জায়গাতেই শালীনভাবে অংশ নিচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমরা তাদেরকে জাতীয় ইস্যুতে কথা বলতে কিংবা অন্যায়ের প্রতিবাদে কোন ভূমিকায় অংশ নিতে দেখছি না কিংবা অজানা যুক্তিতে বিরত রাখা হয়েছে। তাদেরকে অনেকটাই নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে মসজিদের মত পবিত্র তথা নৈতিক শিক্ষার স্থানগুলো থেকেও।

ভিকারুন্নিসা, ঢাবি কিংবা দেশের অন্য কোথায়ও যখন নারী নির্যাতনের দু:খজনক ঘটনা ঘটে তখনও ইসলাপন্থি কোন নারী সংগঠনের কোন জোড়ালো প্রতিবাদ-মানববন্ধন চোখে পড়েনি। অথচ যাদের সাথে এদেশের মাটি-মানুষের মূল্যবোধের কোন সম্পর্ক নেই-

এমনকি যেসব তথাকথিত নারীবাদীরা নিজেরাই নারীত্বের বেশ-ভূষা ও মর্যাদা ধারন করা থেকে যোজন যোজন দূরে তারাই সরব হয়ে ওঠে। ফলে নারীর সত্যিকার অধিকার ও মর্যাদার বিরোধী তথাকথিত নারীবাদীরাই নারীদের পক্ষের শক্তি হিসেবে প্রচার পায়।

দীর্ঘ ১৪০০ বছর আগে ইসলামে নারীরা যুদ্ধ করতে পারলে আজকে আমাদের মা-বোনেরা কি একটি মানববন্ধনও করতে পারবে না?? মনে রাখতে হবে আমরা তাদের কাজে ব্যস্ত না রাখলে, অভিজ্ঞ শয়তান কিন্তু বসে থাকবে না। নারীদের অধিকার ও মর্যাদার জন্য অনেক বিষয়েই ইসলামপন্থি নারীরা সোচ্চার হতে পারেন- যা তথাকথিত নারীবাদীরা কখনোই করবে না।

কিছু কিছু পেশা আছে, যেগুলোতে মেয়েরা তাদের স্বভাবগত কারণেই, সুযোগ পেলে যাওয়া উচিত। যেমন, ডাক্তার (বিশেষতঃ গাইনী), নার্সিং, কিংবা কিন্ডারগার্টেন লেভেলে শিক্ষকতা…। দরকার নারীদের জন্য উপযোগী কর্মক্ষেত্র তৈরি। আর বাস্তবতা হচ্ছে সদিচ্ছা থাকলে নিজেকে ভালো রাখা যায়।

দুঃখ হয়, একটি মেয়ের বর্তমান সমাজের দৃষ্টিভংগী কারণে, পড়াশোনা করে চাকরী করতে পারাকেই জীবনের সাফল্য ব্যর্থতার মাপকাঠি হিসেবে নেয়। আর, ফলাফল চাকুরীজীবি মায়ের অবহেলিত সন্তানেরা, একটি ট্রাবলড চাইল্ডহুড কাটায়!

আমরা মূর্খ পুরুষরা যতদিন না বুঝবো, হোম মেকিং এবং পরবর্তী জেনারেশনকে শিক্ষিত করে তোলার গুরুদায়িত্বের ওজন, ততদিন আমাদের স্ত্রী এবং মেয়েরা, পুত্রবধু এবং মায়েরা আরেকজনের দাসত্ব করাকেই জীবনের মোক্ষ হিসেবে জানবে, এবং তাই ই করতে চাইবে!

তবে যেটা খারাপ সেটা নারী-পুরুষ সবার জন্যই খারাপ। আমরা নারী-পুরুষ একে অপরের সাথে বিতর্ক, বড় হওয়া, প্রভাব খাটানো ও অধিক আদায় করে নেওয়ার প্রতিযোগিতা না করে সবক্ষেত্রে ত্যাগ তথা দেওয়ার প্রতিযোগিতা করতে পারিনা?

নারীবাদীরা যেমন বলেন নারীদের অধিকার আদায় করতে হবে। এটার মধ্যে নারী-পুরুষের বিশ্বাস ও সহযোগিতার পরিবর্তে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়।

আমাদের উচিত পরস্পরের মধ্যে নেওয়ার পরিবর্তে দেওয়ার তথা সহযোগিতার প্রতিযোগিতা করা। আর মহান প্রতিপালকের বিধানই শাশ্বত। সমস্যার প্রকৃতি ও ধরন প্রায় সবই আমাদের জানা। তাই সে বিষয়ে সমাধানের ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ আশা করছি…… লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া।

শেয়ার করুন: