ভাঙা সড়কে গরুর কান্না

চট্টগ্রাম বিবির হাটে গরুর বাজারে ১০-১২টি গরুবাহী ট্রাকের সারি। প্রতিটি ট্রাকের দরজা একটি একটি করে খুলছে আর দড়ি খুলতে না খুলতেই প্রতিটি গরু লাফ দিয়ে নিচে নেমে পড়ছে।

অবস্থা এমন যে, ট্রাক থেকে নেমেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচছে গরুগুলো। গরুগুলো তখনো কাঁদছে অঝোরে। চোখে-মুখেও রাজ্যের আতঙ্ক। শুক্রবার ভোরে আসা ট্রাকগুলোর শতাধিক গরুর প্রায় প্রতিটিরই এই অবস্থা।

কিন্তু কারও নজর কি একবারও পড়ে সেদিকে। গরুর কান্না ও আতঙ্ক নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী থ-২৭১০ নম্বর ট্রাকের চালক নজির মিয়া বলেন, মানুষ কান্দে আর গরু কাঁদবে না? বোবা বলে কি ওদের ব্যথা নাই?

দু’রাইত একদিন ট্রাকের উপর বাঁধা গরুগুলান (গরুগুলো) যা কষ্ট পাইছে। মানুষ হইলে মইরা (মরে) যাইত। সিটের ওপর আরামে বইসা (বসে) গাড়ি চালায় নিজের শরীলডা (শরীর) নাড়াইতে (নাড়াতে) পারি না। গরুগুলান দাঁড়াইতে দাঁড়াইতে কি হাল হইছে একবার ভাবুন তো।

তিনি বলেন, বুধবার রাইতে ফরিদপুর থাইকা (থেকে) গরু নিয়া গাড়ি ছাড়ছি। যতদুরাই আইছি ভাঙা সড়কে ঝাঁকুনি খেয়ে কাহিল হয়ে গেছি। এরমধ্যে এমন কিছু সড়ক আছে বড় বড় গর্ত। যেখানে পড়লে গাড়ি লাফাইয়া উঠে। আর ট্রাকে বাঁধা গরুগুলো হাম্বা-হাম্বা করে চিৎকার করে। শুনলে মনটা বিগড়ে উঠে।

তিনি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রামের মহাসড়কের কিছু অংশ ছাড়া সব রাস্তায় ভাঙা। যেখানে রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। বিশেষ করে ফেনীর পরে মীরসরাই থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার সড়কের পুরাটাই ভাঙাচোরা।

যার ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়েছে। একইভাবে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় প্রবেশ পর্যন্ত সড়ক বেহাল। যেখানে গাড়ি চলেছে লাফাইয়া-লাফাইয়া। আর এই সময় গরুগুলোর কি চিৎকার। ভয়ে এবং ঝাঁকুনিতে ব্যথা পেয়ে গরুগুলো হাম্বা-হাম্বা করে ডাক ছেড়েছে শুধু।

একই কথা বলেছেন, খাগড়াছড়ি থেকে গরু নিয়ে আসা একটি ট্রাকের সহকারী সোলায়মান আলী। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের বিভিন্ন অংশ বেহাল। বিশেষ করে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রানীরহাট থেকে মুরাদপুর বিবিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা।

সড়কের অসংখ্য গর্তে পড়ে ট্রাকে বাধা গরুগুলো হাম্বা-হাম্বা করে শুধু চিৎকার করেছে। সড়কের ট্রাকের ঝাঁকুনিতে গরুগুলো খুব কষ্ট পেয়েছে। প্রতিটি গরু কান্না করছে বলে জানান তিনি।

একই হাল চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের। এরমধ্যে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শান্তিরহাট থেকে বিবিরহাট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার সড়ক নড়ক হয়ে গেছে। এ সড়কে গর্ত এখন ডোবায় পরিণত হয়েছে। ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালানোও দায় হয়ে পড়েছে।

কাপ্তাই ও রাঙ্গুনিয়া থেকে পাহাড়ি গরু নিয়ে আসার সময় ট্রাকগুলো হেলে-দুলে চলেছে। এমন কথা বলেছেন বিবিরহাটে গরু নিয়ে আসা রাঙ্গুনিয়ার গরু ব্যবসায়ী মোবারক আলী।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের ভগ্নদশার কথা জানান টেকনাফ থেকে গরু নিয়ে আসা ট্রাকচালক আতিক উল্লাহ। তিনি বলেন, টেকনাফ থেকে ৯টি বড় গরু নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে রওনা হই।

কিন্তু সড়ক বেহালের কারণে থেমে থেমে গাড়ি চালাতে হয়েছে। সড়কের গর্তে পড়ে ট্রাক লাফিয়ে উঠলে গরুগুলো চিৎকার করে। যা অসহ্য লেগেছে। শুক্রবার সকালে বিবিরহটে নেমে দেখি গরুগুলোর চোখে কান্নার জলধারা।

তিনি জানান, কক্সবাজার-রাঙামাটি সড়কের চন্দনাইশ এলাকায় ভাঙা সড়কে পড়ে শুক্রবার ভোর সাড়ে তিনটার দিকে গরুবাহী একটি ট্রাক উল্টে গেছে। এতে দুটি গরু মারা গেছে। বাকিগুলো প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। আহত গরুগুলোকে আরেকটি ট্রাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে।

সড়কের গর্তে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের সীতাকুণ্ড মাদামবিবির হাট এলাকায় গরুবাহী একটি ট্রাক উল্টে যায়। এ সময় পাশে থাকা যাত্রীবাহী একটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চালকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় চারজন গরু বেপারি ও দু’জন বাসযাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন। আহত হয়েছে ট্রাকে পরিবহন করা ১৬টি কোরবানির গরুও।

বৃহস্পতিবার সকালে ঘটে এ দুর্ঘটনা। নিহত বাস চালকের নাম-মোহাম্মদ মিয়া (৩৫)। তিনি সীতাকুন্ডের ফকিরহাট এলাকার মো. আনিসুল হকের ছেলে বলে জানিয়েছেন হাইওয়ে পুলিশের বার আউলিয়া থানার ওসি আহসান হাবিব।

ওসি আহসান হাবিব জানান, ফরিদপুর থেকে কোরবানির গরুবাহী ট্রাকটি চট্টগ্রামে আসছিল। সীতাকুন্ডের মাদামবিবির হাট এলাকায় পৌঁছে ট্রাকটি সড়কের গর্তে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গিয়ে সাত নম্বর রুটের যাত্রীবাহী একটি মিনি বাসকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়।

ফলে বাসের চালক ঘটনাস্থলে নিহত হয়। বাসের আরও দুজন যাত্রী গুরুতর আহত হয়। এছাড়া উল্টো গিয়ে ট্রাকে পরিবহন করা ১৬টি গরুও আহত হয়। শক্ত দড়িতে বাধা গরুগুলো বেঁচে থাকলেও ভেতরে আঘাত হয়েছে। যেকোনো সময় গরুগুলোর মৃত্যু ঘটতে পারে বলে জানান ওসি।

ট্রাকচালক ও ব্যবসায়ীসহ ভুক্তভোগীরা জানান, শুধু গর্তে পড়ে নয়; ভাঙা সড়কের কারণে সড়ক-মহাসড়কে যানজটে পড়ে মানুষের পাশাপাশি কোরবানির পশুগুলোও চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। ট্রাকের উপর পশুগুলো অঝোর ধারায় কাঁদছে।

তারা বলেন, সকালে ট্রাক থেকে নামানোর সময় ট্রাকের দরজা খোলা পেয়ে দড়ি ছাড়ার আগেই গরুগুলো লাফ দিয়ে নেমে পড়ছে। দেখলে মনে হয় ট্রাক থেকে নেমে গরুগুলো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে।

বিবিরহাট গরুর বাজারের ইজারাদার আবদুল মান্নান বলেন, চট্টগ্রামে সবচেয়ে বড় গরুর বাজার বিবিরহাট ও সাগরিকা পশুরহাট। এই দুই বাজারে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গরু আসে।

টেকনাফ ও বান্দরবান থেকে গরু আসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দিয়ে। রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে গরু আসে চট্টগ্রাম রাঙামাটি সড়ক এবং চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক দিয়ে। অথচ চারটি সড়কই ভাঙচোরা। যার ওপর দিয়ে কোরবানির পশু পরিবহনে মানুষের পাশাপাশি গরুগুলোর ভোগান্তি ও দুঃখ কষ্ট বেড়েছে ব্যাপকভাবে।

শেয়ার করুন: