ড্যান্ডি হল এক প্রকার গ্লু গাম বা আঠা জাতীয় উদ্বায়ী পদার্থ বা সাধারণ তাপমাত্রায় সহজেই বাষ্পে বা ধূম্রে পরিণত হয়। সাধারণত চার প্রকার জৈব যৌগ যথা- টলুইন, বেনজিন, অ্যাসিটোন ও কার্বন ট্রাই ক্লোরাইড এই গাম জাতীয় পদার্থে বিদ্যমান থাকে।
বিভিন্ন প্রকার বাবার ও চামড়া জাতীয় পদার্থ যেমন- জুতা, চাকার রাবার-টিউব প্রভৃতির মেরামতকল্পে সংযোজক কারক হিসেবে এর বহুল ব্যবহার বিদ্যমান।
এই প্রকার উদ্বায়ী গাম জাতীয় পদার্থ বাষ্প বা ধূম্রাকারে গন্ধ শুকা বা শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে শ্বসনতন্ত্র হয়ে রক্তের মাধ্যমে মানব মস্কিষ্কে প্রবেশ করে, প্রথমে জাগায় আনন্দের শিহরশ আর অনিয়ন্ত্রিত উম্মাদনা, পরবর্তীতে তাহা দেহে আনে এক শিথীলতার ভাব।
ফলে দীর্ঘমেয়াদে এই পদার্থের অপব্যবহারের ফলে এর প্রতি সৃষ্টি হয় এক চরম আসক্তি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যা ‘গ্লু স্নিফিং’ বা বাংলায় ‘গ্লু গাম শুকা’ নামে পরিচিত। আর সাধারণ মানুষ ও নেশাগ্রস্তদের নিকট ইহা ড্যান্ডি নামে পরিচিত।
লিখেছেন ডা: মো: কফিল উদ্দিন চৌধুরী যদিও এই নেশার প্রকোপতা সম্পর্কে আমাদের দেশে এখনও সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই, তথাপি বিগত দুইদশক ধরে এই প্রকার নেশায় আসক্তদের সংখ্যা আমাদের দেশে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
সাধারণত বড় বড় শহরের বা সমাজের সুবিধা বঞ্চিত কিশোর-কিশোরী ও সদ্য বয়োপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যেমন- রাস্তার টোকাই, ভবঘুরে, কুলি-মজুর শ্রেণীর মধ্যে এই প্রকার নেশা যেন দিন থেকে দিন যেন এক সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
সাধারণত সহজ প্রাপ্যতা, সহজ লভ্যতা ও আইনত নিষিদ্ধ পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত না হওয়ায় এই প্রকার নেশার প্রকোপ যেন এক মহামারী রূপ নিয়েছে। এই নেশার কালো থাবা যেন আজ সমাজের নিম্নশ্রেণী হয়ে মধ্যবিত্ত সমাজে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে।
হার্ডওয়ারের দোকানসমূহে এই প্রকার নেশা তথা গ্লু গাম সহজলভ্য। এই প্রকার গামের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড হল- ডায়ামন্ডনাল, ফ্রেশ প্রভৃতি।
এই নেশার প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ কারা?
# সমাজের সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কিশোর-কিশোরী ও সদ্য বয়োপ্রাপ্ত শ্রেণী।
# অন্য প্রকার নেশায় আসক্ত ব্যক্তিবর্গ।
# শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের স্বীকার অল্প বয়স্ক জনগোষ্ঠী।
# আচরণগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু।
# অতি চঞ্চল ও অমনযোগী শিশু।
# হতাশা, উদ্বিগ্নতা, অত্যধিক মানসিক চাপে থাকা জনগোষ্ঠী।
# এই প্রকার নেশার প্রতি কৌতুহল প্রবণ কিশোর-কিশোরী।
# অসৎ সঙ্গ,তীব্র শারীরিক ও মানসিক আঘাত পরবর্তী মানসিক চাপ ও এন্টি সোস্যাল পার্সনালিটি সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ।
প্রভৃতি ফ্যাক্টর এই প্রকার নেশায় আসক্ত হবার প্রবণতা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
এই নেশার ক্ষতিকর প্রভাব :
এই প্রকার নেশায় আসক্তগণ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে নানা মনো-আচরণগত, শারীরিক ও সামাজিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। এছাড়া মানব শরীরের শ্বসন, পরিপাক, স্নায়ু ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের উপর এই প্রকার নেশার ক্ষতিকারক উপাদানসমূহ নানা বিরূপ প্রভাব ফেলে।
(ক) মনো-আচারণগত সমস্যা :
১। স্বল্পমেয়াদে-কলহ প্রবণতা, উত্তেজনা তথা উম্মত্ততা, উদাসীনতা, বিবেক-বুদ্ধি লোপ পাওয়া, চিত্তবিভ্রম, শ্রুতি ও দৃষ্টি বিভ্রম ইত্যাদি।
২। দীর্ঘমেয়াদে-হতাশা, উদ্বিগ্নতা, মনোবৈকল্য, স্মৃতিভ্রম, আত্মহত্যা ইত্যাদি।
(খ) শারীরিক সমস্যা :
১। স্বল্পমেয়াদে-মাথা ঘোরা, চলাচলে অসংলগ্নতা, কথা জড়িয়ে আসা, হাঁটতে অসুবিধা, অবসাদ, হাত কাঁপা, চোখে ঝাপসা দেখা, ক্ষুধামন্দা, বমি বা বমি ভাব, রক্ত বমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। এমনকি নেশার অতিমাত্রায় শ্বসন ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে কিংবা শ্বাসরোধ বা দুর্ঘটনার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটতে পারে।
২। দীর্ঘমেয়াদে-যক্ষ্মা, এইডস, যৌন বাহিত নানা রোগ, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, সাইনোসাইটিস, লিভার সিরোসিস, লিভার ও ফুসফুসে ক্যান্সার ইত্যাদি।
(গ) সামাজিক সমস্যা :
- পারিবারিক ও সামাজিক টানাপোড়েন
- বিবাহ বিচ্ছেদ
- নারী ও শিশু নির্যাতন
- পেশাগত, সামাজিক ও ব্যক্তিগত কর্মদক্ষতা হ্রাস পাওয়া
- ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত দায়বদ্ধতা কমে যাওয়া
- অপরাধ প্রবণতা তথা- মাদক ব্যবসা, চোরাচালন, চুরি, ডাকাতি, খুন প্রভৃতির প্রকোপ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
চিকিৎসা:
(ক) তাৎক্ষনিক তথা স্বল্পমেয়াদের চিকিৎসা-
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্রকার নেশায় আক্রান্তদের সমস্যাসমূহ সংক্ষিপ্ত সময়ের ও মৃদু প্রকৃতির হয়। তাই এই সমস্যা মৃদু প্রকৃতির হলে রোগীকে কেবল আশ্বস্ত করাই যথেষ্ট যে- এই সমস্যা গুরুতর কিছু নয়।
স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই সমস্যাসমূহ হতে রোগী আরোগ্য লাভ করবেন। তবে সমস্যার তীব্র পর্যায়ে, যেমনÑ রোগী সংজ্ঞাহীন হলে, শ্বসনতন্ত্র ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া লুপ্ত হলে কিংবা রক্ত বমি হলে আক্রান্ত রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রোগে নিবিড় চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
রোগীর মনো-আচরণগত সমস্যা, যেমন- উম্মত্ততা, মারমুখীভাব তীব্র হলে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক এন্টিসাইকোটিক ঔষধের প্রয়োজন হতে পারে। ঘুমের ঔষধ এই ক্ষেত্রে ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
(খ) দীর্ঘমেয়াদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন-
# সর্বাগ্রে প্রয়োজন রোগীকে আশ্বস্তকরণ। অতপর রোগীকে এই সমস্যা সম্পর্কে দিতে হবে ব্যাপক স্বাস্থ্য শিক্ষা।
# প্রয়োজন রোগীর জন্য পর্যাপ্ত পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তার।
# সেই সাথে নিশ্চিত করতে হবে এই সমস্যার জটিলতা ও সহযোগী হিসেবে থাকা নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যার যথাযথ চিকিৎসা।
# গুরুত্ব দিতে হবে ফ্যামিলি থেরাপীর দিকে।
# ক্ষেত্রবিশেষে এই রোগের চিকিৎসার প্রাথমিক বিফলতার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে একজন যথাযথ অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত
ফোস্টার কেয়ার, রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার প্রভৃতি।
# সেই সাথে নিশ্চিত করতে হবে রোগী তথা রোগীর পরিবার ও সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থান উন্নয়ন। এই ক্ষেত্রে নানা আর্থ-সামাজিক ও পেশাগত পুনর্বাসন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
# তাছাড়া এই সমস্যায় চিকিৎসায় রোগীর সমাজের দায়বদ্ধতা বাড়ানোর মাধ্যমে এইচিকিৎসার সফলতার হার অনেক বাড়ানো যেতে পারে।
এই সমস্যার বিস্তার প্রতিরোধে করণীয় :
# সবার আগে প্রয়োজন এই প্রকার নেশা ও নেশার সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরী। এই ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সমূহ প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
# ড্রাগের অবৈধ বিস্তার প্রতিরোধকল্পে বাড়াতে হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা।
# নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে এই প্রকার নেশার অবাধ কেনা-বেচা ও পাচারের উপর।
# প্রয়োজন সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন।
# সর্বোপরি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই নেশাসহ অন্যান্য সকল নেশার বিরুদ্ধে সৃষ্টি করতে হবে ব্যাপক গণপ্রতিরোধ।
# এই নেশাসহ অন্যান্য সকল প্রকার নেশা জাতীয় বস্তু কেনা-বেচা ও পাচারের সাথে জড়িতদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে উপযুক্ত শাস্তির। সেই সাথে প্রয়োজন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ।
লেখক : মেডিসিন ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
ফোন : ০১৫৫৭৪৪০২৮৭