শাজাহান খানকে কি সরকারের এতটাই দরকার?

শাজাহান খান, উচ্চতা ৫ ফুট সাড়ে ১১ ইঞ্চি, গায়ের রং ফরসা—এই হচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে নৌমন্ত্রীর আট পৃষ্ঠাব্যাপী জীবনবৃত্তান্তের প্রথম লাইন। তাঁর জীবনের পুরো বৃত্তান্ত পড়লে চমৎকৃত হতে হয়। সেখানে তাঁর পেশা লেখা আছে রাজনীতি, সমাজসেবা ও ইউনিয়নিস্ট।

জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, তিনি ১৯৭২ সাল থেকে মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। ১৯৭২ সালেই তিনি আবার মাদারীপুর মহকুমা নৌকা মাঝি সমিতি ও হরিজন সমিতি গঠন করে সভাপতি হয়েছিলেন।

এরপর তাঁর ‘ইউনিয়নিস্ট’ পেশার আরও পসার ঘটে ১৯৮৭ সাল থেকে। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্যসচিব নির্বাচিত হন।

এরপর ১৯৯০ সালে সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের তিনটি ফেডারেশন এক করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদ গঠন এবং ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও বাংলাদেশ ট্রাক ড্রাইভার্স ফেডারেশন ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করেন।

তিনি এখনো এর কার্যকরী সভাপতি। এখানেই শেষ না। এরপর তিনি হাত বাড়ান পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর দিকে। ২০১৩ সালে ৫২টি গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠন করা হয় গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। এরও প্রধান তিনি।

ইউনিয়নিস্ট পেশায় শাজাহান খানের বিশাল এক সাফল্যের উদাহরণও দেওয়া আছে জীবনবৃত্তান্তে। সেখানে বলা আছে, ১৯৮৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে ড্রাইভার হারুণ অর রশিদকে ফাঁসির আদেশ এবং সুপারভাইজার মজিবর রহমান ও হেলপার আজিবর রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশের প্রতিবাদে আন্দোলন করে তাঁদের মুক্ত করেন। এই আন্দোলনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

শাজাহান খানের রাজনৈতিক জীবনও কিন্তু আলোচিত। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের মার্চে তিনি মাদারীপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের কৃষি সম্পাদক হয়েছিলেন। তবে ওই বছরেরই অক্টোবরে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। এরপর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান।

১৯৮৬ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন। এরশাদ পতনের পরে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনে শাজাহান খান জাসদের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করলেও হেরে যান।

এর ঠিক এক মাস পরেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নৌকায় চড়ে বসেন এবং উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে মাদারীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। সেই থেকেই তিনি নৌকায় আছেন।

এ রকম একজন ব্যক্তি ৯ বছর ধরে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী। যদিও মন্ত্রীর চেয়ে তাঁর কাজকর্মে ‘ইউনিয়নিস্ট’ পেশাতেই বেশি ব্যস্ত দেখা যায়। তারপরেও এ রকম একজন রাজনীতিক ও ইউনিয়নিস্টকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়ায় সরকারের কাজকর্ম অনেক বেশি গতিশীল হওয়ারই কথা। কিন্তু আসলেই কি তাই? নাকি তিনি সরকারের বোঝায় পরিণত হয়ে আছেন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে এভাবে ছোট শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামার ঘটনা ইতিহাসে আর একটিও আছে কি না সন্দেহ। আর এর দায় অবশ্যই অনেকটাই শাজাহান খানের।

তিনি যদি পাঁচ দিন আগে দুর্ঘটনার দিন হাসিমুখে বাংলাদেশের দুই শিক্ষার্থীর ওপর বাস উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে ভারতের মহারাষ্ট্রের দুর্ঘটনার উদাহরণ টেনে এনে বিষয়টি উড়িয়ে না দিতেন, তাহলে ক্ষোভ এতটা হয়তো বাড়ত না। নৌমন্ত্রীর বিদায় চাওয়া আন্দোলনের একটি বড় দাবি। যদিও তিনি বাধ্য হয়ে কৌশলী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, তিনি নাকি ঘটনা তখনো জানতেন না, হেসেছেন অন্য কারণে।

এমন নয় যে এ ধরনের অসংবেদনশীল মন্তব্য এটাই তাঁর প্রথম, সুতরাং ক্ষমাযোগ্য। এই কাজটি তিনি প্রায়ই করেন। কয়েকটি উদাহরণ দিই। ২০১১ সালে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনির নিহত হলে চালকদের লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কথা উঠলে শাজাহান খান বলেছিলেন, ‘গরু-ছাগল চিনতে পারলেই তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে।’

আবার ২০১৫ সালে পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে কোটি মানুষের বাস। এর মধ্যে ঢাকায় থাকেন দুই কোটি মানুষ। তাই এমন ঘটনা ঘটতেই পারে।’

২০১৭ সালে তার ছত্রচ্ছায়ায় সারা দেশে পরিবহন শ্রমিকেরা ধর্মঘটে গেলে শাজাহান খান বলেছিলেন, ‘বাসচালকরা ধর্মঘট করছেন না, তাঁরা স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন।’

একই বছর সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে ঢাকার আদালত ট্রাকচালকের ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন। ফাঁসির এই রায়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘ফাঁসি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে-তা ভুল ধারণা। একজন মন্ত্রীর সন্তান কুকুর বাঁচাতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। তাই বলে কি সে কুকুরের ফাঁসি হবে?’

অবশ্য বেফাঁস কথা বলায় বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রীরই কিছু হয় না। সুতরাং শাজাহান খানের কিছু হবে না তা বলা যায়। অথচ বেফাঁস কথা বলার জন্য মন্ত্রিত্ব হারানোর ঘটনা সারা বিশ্বে কম নেই।

যেমন, বেফাঁস কথা বলার জন্য ২০১৭ সালে পদত্যাগ করেছিলেন জাপানের পুনর্গঠন মন্ত্রী মাসাহিরো ইমামুরা। তিনি জাপানে সুনামির আঘাত নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন,

‘সুনামি টোকিওতে আঘাত না করে তোহোকু (ফুকুশিমা, ইওয়াতে, মিয়াগি) অঞ্চলে হয়েছিল। ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। যদি টোকিওতে ২০১১ সালের মার্চের সুনামিটি আসত, তাহলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করত।’

কিছুদিন আগে কানাডার ক্রীড়ামন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। কারণ, তিনি এক নারী সহকর্মীকে এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যা যৌন হয়রানিমূলক। ওই সহকর্মী কথাটি কেবল টুইটারে দিয়েছিলেন, তাতেই পদত্যাগ।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের চিফ হুইপ এন্ড্রু মিচেল পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ, তিনি ডাউনিং স্ট্রিটে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে নীচু জাতের বলেছিলেন। এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল ব্যাপক।

এখন অনেকে বলতে পারেন, এসব পদত্যাগ আমাদের মতো দেশে ঘটে না। তাঁদের জন্য বলি, বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে পড়তে আসা নেপালি নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন দেশটির আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী শের বাহাদুর তামাং। সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেন এই তো সেদিন, ২৪ জুলাই।

একজন ইউনিয়নিস্ট আর সরকারের কাজের মধ্যে পরস্পরবিরোধী স্বার্থের একটি বিষয় রয়েছে। সড়ক নিরাপত্তা আইনে আইনমন্ত্রীর ভাষায় ‘পর্যাপ্ত শাস্তি’ দেওয়ার বিধান শাজাহান খান মানবেন, নাকি সেই ১৯৮৭ সালের মতো আন্দোলন করবেন।

তিনি কি সরকারের প্রতিনিধি হবেন, নাকি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের প্রধান হিসেবে চালকদের পক্ষে নামবেন। অতীত বলে, এই সরকারের মন্ত্রী থাকার সময়েই তিনি চালকদের পক্ষে ছিলেন বরাবর।

সুতরাং দুই পক্ষেই আছে এ রকম একজন ব্যক্তি বড় কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য নিশ্চয়ই সহায়ক হবেন না। এটা যত দ্রুত অনুধাবন করা যাবে, ততই মঙ্গল।

আবার গতকালই শাজাহান খানকে একটি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া। জানতে চাওয়া হয়েছে কোন ক্ষমতাবলে তিনি সাংবিধানিক পদে থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি পদে আছেন। কেননা, সাংবিধানিক পদে থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি থাকা বেআইনি ও নৈতিকতাবিরোধী।

কিন্তু গতকাল শাজাহান খান সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বললেন, তাঁর পদত্যাগের দাবি নাকি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নেই, এটা বিরোধী দলের দাবি। বিএনপির এই দাবি নিয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না।

শাজাহান খান একেকটি ঘটনা ঘটান, আর প্রতিবারই প্রশ্ন জাগে তাঁকে কি সরকারের এতটাই দরকার? আর এবার তো এই প্রশ্ন বলা যায় সারা দেশবাসীর। তাঁকে নিয়ে আর কত দিন? সূত্র- প্রথম আলো

শেয়ার করুন: