জাবালে নূরের সেই তিন চালককে নিয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য বেড়িয়ে আসল, তাহলে তারা কিভাবে…

মালিক পক্ষ। কার লাইসেন্স নেই, কার কাছে আছে তা দেখার বালাই নেন।’ যে তিন বাসের যাত্রী তোলার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তার কলেজপড়ূয়া মেয়ের প্রাণ গেল,

সেগুলোর চালকরাই যেন দিয়ার বাবার ওই মন্তব্যের কঠিন সত্য উদাহরণ। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, এই তিন চালকের কারও যাত্রীবাহী বাস চালানোর লাইসেন্স নেই! প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কীভাবে তাদের হাতে বাসের স্টিয়ারিং তুলে দিল মালিক পক্ষ?

পাল্লা দিয়ে আগে গিয়ে যাত্রী তুলতে পারলে তাদের ভাড়া নিজেদের পকেটে ভরার সুযোগ পান বাসচালক ও হেলপাররা। বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী তোলার পর সেই হিসাব সাধারণত ‘ওয়ে বিলে’ উল্লেখ করা হয় না।

বাস মালিক পক্ষের সুপারভাইজারকে কখনও ফাঁকি দিয়ে, কখনও ‘ম্যানেজ করে’ চলতি পথে তোলা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা ভাড়া হাতিয়ে নেন বাসের অসাধু চালক ও তার সহকারী। তাই স্টপেজ ছাড়াই পথের মধ্যে পাল্লাপাল্লি করে যাত্রী তুলতে দেখা যায় বিভিন্ন বাসকে।

এমনই এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বাসচাপায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের সড়কে প্রাণ হারান দুই শিক্ষার্থী, আহত হন বেশ কয়েকজন। ঘাতক জাবালে নূর বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৯২৯৭) চালক মাসুম বিল্লাল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছেন, লোভের বশবর্তী হয়ে যাত্রী তুলতে গিয়ে রোববার এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

বরগুনা থেকে গ্রেফতারের পর এরই মধ্যে পুলিশ-র‌্যাব তাকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এ ছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছে দুর্ঘটনায় জড়িত আরও দুই চালক জোবায়ের ও সোহাগ আলী এবং তাদের দুই সহকারী এনায়েত হোসেন ও রিপনকে।

মূল ঘাতক বাসের চালক ছাড়া অন্য চারজনকে গতকাল মঙ্গলবার আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। ঢাকা মহানগর হাকিম এইচএম তোয়াহা আসামিদের কারাগারে পাঠিয়ে শুনানির জন্য ৬ আগস্ট দিন ধার্য করেন।

আদালত সূত্র বলছে, পুলিশের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ঘটনার দিন জাবালে নূর পরিবহনের কয়েকটি বাসের চালক তাদের হেলপারদের উস্কানিতে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন।

শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বাসে ওঠার জন্য ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিশ আদালতকে জানায়, গ্রেফতার চারজন জানেন মূল ঘাতক কে।

ঘটনার দিন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত চারজনের নাম জানার পর র?্যাবের সহায়তায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে মূল ঘাতক বাসচালক এখনও ‘পলাতক’।

ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি কাজী শাহান বলেন, এখনও ঘাতক বাসের মূল চালককে তারা হাতে পাননি। সে র‌্যাবের কাছে রয়েছে। তাকে হাতে পাওয়া গেলে আদালতে তোলা হবে।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানান, গ্রেফতার জাবালে নূরের ঘাতক বাসচালক মাসুম বিল্লালসহ অন্য দুই ড্রাইভার জোবায়ের ও সোহাগ আলীর কাছে যাত্রীবাহী বাস ও মিডিয়াম ভেহিক্যাল চালানোর কোনো লাইসেন্স নেই।

তবে তাদের মোটরসাইকেল ও হালকা যান চালানোর লাইসেন্স রয়েছে। তাদের কাছে পাওয়া গেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) অপেশাদার চালকের লাইসেন্সের তিনটি কার্ড। এসব কার্ডে ইংরেজি বর্ণে লেখা আছে এলসি (হালকা যান)।

এ ধরনের লাইসেন্স ব্যবহার করে কোনোভাবেই পেশাদার চালক হিসেবে ভারী যান চালানোর কথা নয়। অপেশাদার লাইসেন্স দিয়ে কীভাবে ট্রাফিক পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা যাত্রীবাহী বাস চালালেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অনেকেই বলছেন, হালকা যানের লাইসেন্সধারীকে দিয়ে যাত্রীবাহী বাস চালানোর দায় মালিক পক্ষ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। তিন চালকের লাইসেন্স যাচাই করতে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পর পেশাদার চালক হিসেবে যে কেউ লাইসেন্স পেতে পারেন। অপেশাদার লাইসেন্সধারী একজন চালক সর্বোচ্চ ১২ আসনের বেশি যানবাহন চালাতে পারবেন না।

গত রোববার জাবালে নূরের তিন বাসের পাল্লাপাল্লিতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত ও ১০ জন আহত হন। বনানী ফ্লাইওভারের ঢালে আগে থেকেই জাবালে নূরের দুটি বাস দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছিল।

ওই দুটি বাসের নম্বর হলো- ঢাকা মেট্রো ব-১১-৭৬৫৭ এবং ঢাকা মেট্রো ব-১১-৭৫৮০। পেছনে থেকে ঢাকা মেট্রো ব-১১-৯২৯৭ নম্বরের গাড়িচালক মাসুম এসে তাড়াহুড়া করে বাঁ দিক থেকে অপর বাসকে অতিক্রম করে যাত্রী তুলতে গিয়ে সেখানে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের ওপর গাড়ি তুলে দেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি ধাক্কা খায় পাশের একটি গাছের সঙ্গে।

নিয়ম অনুযায়ী, সেখানে কোনো বাস থামানোর ও যাত্রী তোলার কথা নয়। কারণে ফ্লাইওভারের ঢাল স্বাভাবিক কারণেই বিপজ্জনক। মূলত তিন চালক ও তাদের সহকারীদের যাত্রী তোলার অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেই সেখানে দুর্ঘটনার ক্ষেত্র তৈরি হয়। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার ফ্লাইওভারটি ২৩ ফুট চওড়া।

শেয়ার করুন: