রাজশাহী ও বরিশাল সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই মেয়রপ্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ হেসে-খেলে জয় পেলেও সিলেটের চিত্রটা ভিন্ন।
বিএনপির মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। ১৩৪ কেন্দ্রের মধ্যে ১৩২টিতেই ধানের শীষে ভোট পড়ে ৯০ হাজার ৪৯৬টি। আর কামরান পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট। অর্থাৎ ৪ হাজার ৬২৬ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন আরিফ। বাকি দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করায় তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা যায়নি। এতে মোট ভোটার ৪ হাজার ৭৮৭ জন।
সেই হিসাবে বিজয় নিশ্চিতের জন্য আরিফের প্রয়োজন আরও ১৬১ ভোট। এদিকে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়েও কেন কামরানের এই দশা, সেই আলোচনা এখন সিলেটের গ-ি পেরিয়ে সারাদেশে। তবে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশ কয়েকটি কারণে এমন কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী।
ব্যক্তি কামরান সজ্জন এবং সদালাপী হলেও দলীয় কোন্দল ও ভোটারদের সঙ্গে তার দূরত্বকেই মোটাদাগে দেখা হচ্ছে। তা ছাড়া সিলেটের মানুষ প্রশাসক হিসেবে কামরানের চেয়ে আরিফকেই বেশি যোগ্য মনে করেন। সর্বশেষ মেয়াদে খাল উদ্ধার, রাস্তা প্রশস্তকরণ, ফুটপাতে হকার উচ্ছেদের মতো কিছু দৃশ্যমান কাজের কারণে আরিফের প্রতি একটা সফটকর্নারও রয়েছে সিলেটবাসীর।
তবে কামরানের বর্তমান পরিণতির জন্য সিলেটের দলীয় কোন্দলকেই দুষছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে কামরানের সঙ্গে থাকলেও ভেতরে ভেতরে বিরোধিতাই করেছেন। নির্বাচন ঘিরে বেশ কয়েক দিন শহরে অবস্থান করেও সেই কোন্দল মেটাতে পারেননি দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। যদিও অভিযোগ রয়েছে, সিটি নির্বাচনের চেয়ে আহমদ হোসেন বেশি সময় ব্যয় করেছেন আগামী সংসদ নির্বাচনে সিলেট বিভাগের দলীয় এমপি পদপ্রত্যাশীদের সঙ্গে।
শুধু তা-ই নয়, জেলার প্রভাবশালী নেতা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অনুসারীরা কামরানের পক্ষে ছিলেন নাÑ এমনটিই মনে করেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, ভোটের দিন অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে কামরানের ভোট কমেছে। ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, ‘আরিফ ও কামরান দুজনই ভালো প্রার্থী।’ এ ছাড়া তিনি একজন হিন্দু কাউন্সিলর প্রার্থীকে ‘গুন্ডি’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওই গুন্ডিটা যেন জিততে না পারে।’ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওই নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর বিপক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলায় নারী এবং হিন্দুদের ভোটেও প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন সিলেটের অনেকে।
জানতে চাইলে কামরানের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দীন সিরাজ আমাদের সময়কে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের মধ্যে বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন না। আর ওইসব ওয়ার্ডেই আমাদের দলের হেভিওয়েট নেতারা থাকেন। ফলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী না থাকায় সেগুলোয় বিএনপি ও জামায়াতের কাউন্সিলররা প্রকাশ্যে অবস্থান নেন। এ কারণেই সেগুলোয় আমাদের প্রার্থী ভালো ফল করতে পারেননি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কামরানের নিজের ওয়ার্ড ১৪ নম্বরে কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছেন বিএনপির নজরুল ইসলাম মুনিম, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদউদ্দীন আহমদের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডেও জয় পেয়েছেন বিএনপির রাশেদ আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সহসভাপতি আশফাক আহমদ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে জিতেছেন বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কোয়েস লোদী। এ রকম বেশকিছু ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোনো শক্তিশালী অবস্থান ছিল না, যার প্রভাব পড়েছে মেয়র পদে কামরানের ভোটে।
এ ছাড়া সিলেট সিটি নির্বাচনে দুটি বড় ফ্যাক্টর সনাতন ধর্ম ও মণিপুরি সম্প্রদায়ের ভোটারদের ভোট। অন্যান্য জায়গায় সংখ্যালঘুদের ভোট এটচেটিয়া নৌকা প্রতীকে পাড়লেও সিলেটে সেটা হয়নি। অনেক আগে থেকেই নানা কারণে ব্যক্তি কামরানের সঙ্গে দূরত্ব রয়েছে এখানকার সংখ্যালঘুু ও মণিপুরি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। তার ফল মিলেছে ভোটের বাক্সেও। ধারণা করা হচ্ছে, লক্ষাধিক সনাতন ও মণিপুরির ভোট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কামরান। তাদের অনেকে ভোট দিতেই যাননি।
সিলেট জেলায় জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সুসর্ম্পক রয়েছেÑ এমন কথা নগরীর পাড়ায় পাড়ায় শোনা যায়। এবারের নির্বাচনেও জামায়াতের মেয়রপ্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় সিলেটের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অনেকের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের কারণেই সিলেটে জামায়াতের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পেরেছেন।