দেশজুড়ে নির্বাচনের আবহ শেষ। তিন সিটি কর্পোরেশনে নগরপিতা বাছাই হয়ে গেছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভোটের আয়োজন করা হয়েছে, প্রার্থীরা প্রচারণা চালিয়েছেন মাসব্যাপী, সেখানেও টাকার ছড়াছড়ি কম হয়নি।
নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কি হয়নি, সেটা পরের ব্যাপার। যারা জেতার, তারাই জিতেছে, যাদের ক্ষমতা আছে, তারাই পদে বসেছে। মাঝখানে বরিশাল মেয়র পদের পরাজিত প্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী বিসিএস জেনারেশনকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন সেই আগের জায়গায়।
ফেসবুকে যাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ‘আই হেট পলিটিক্স’ ছিল, মনীষার পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে সেটার ভিত্তি আরো মজবুত হল! সবকিছুই যদি এভাবে নির্ধারিত থাকবে, তবে এসব উঠতি তরুণ-তরুণীদের নিয়ে ছেলেখেলা কেন? কেন শুধু শুধু এতগুলো টাকা আর সময়ের অপচয় করা?
বরিশালে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছিলেন বাসদের ডা. মনীষা চক্রবর্তী। বরিশালের ইতিহাসে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রথম নারী প্রার্থী তিনি। প্রচারণার সময়েই দারুণ আলোচনায় এসেছিলেন এই তরুণী। স্পষ্টভাষী আর শিক্ষিত এই তরুণীকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন সবাই। এমনকি আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল, মনীষাকে তারা স্বাগত জানাচ্ছে, এমনকি এটাও বলা হয়েছিল, তাকে যেন কোন রকমের অসুবিধার মধ্যে ফেলা না হয়, নারী বলে মনীষা চক্রবর্তীকে যেন বিন্দুমাত্র অসম্মান করা না হয়।
কিন্ত গতকাল সদর গার্লজ স্কুল কেন্দ্রে তাকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন আওয়ামীলীগের কয়েকজন কর্মী। পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়ার খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিলেন মনীষা। শেষমেশ নির্বাচন বর্জন করেছেন তিনি। ভোটে মনীষা হয়তো এমনিতেই জিততেন না, তবুও কেন তার গায়ে হাত তোলা? অথচ এই মনীষা সবসময় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার। বরিশালের প্রান্তিক মানুষের সমস্যা নিয়ে রাজপথে কয়েক বছর ধরেই সক্রিয়। তাই ৩৪তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মানুষের অধিকার আদায়ের রাজনীতিকেই বেছে নিয়েছেন তিনি।
বরিশালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হওয়ার পেছনেও তাঁর লক্ষ্য ছিল ওই একটাই- অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়। তারুণ্যে উদ্ভাসিত মনীষা চক্রবর্তী বিসিএস জবের চিন্তা থেকে তরুণ-তরুণীদের বের করে নিয়ে আসতে পারতেন। তরুণরা যখন একটি সরকারি চাকুরির জন্য মাথাখারাপ হয়ে রাজপথে হৈচৈ করছে, তিনি তখন বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। কীর্তনখোলার তীরে প্রতিদিন ভোর থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন, তার ফলাফল কী দাঁড়ালো?
আমাদের পৌণ:পুণিক ব্যর্থতার ইতিহাস বলে, আমরা সবসময় এমন নেতৃত্বেরই স্বপ্ন দেখি, সমাজ পরিবর্তনের ভারি ভারি বুলি আওড়াই। কিন্তু দিনশেষে সেই কালো-টাকার মালিক, সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক, লুটেরা শাসক শোষকের দালালদেরকেই মনোনীত করি৷ এই চিন্তার পরিবর্তন পালে হাওয়া দিতে চেয়েছিলেন মনীষা। মনীষা হেরে গিয়েও যদি সম্মানটা পেতেন, তবে লাখ লাখ তরুণ বিসিএসের জন্য যৌবন ক্ষয় না করে রাজনীতিতে আসতেন।
এছাড়া দ্বি-দলীয় লুটপাটের রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরেও একটা জগৎ থাকতে পারে, সাধারণ জনগণের কিছু চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে, সেই মেসেজটা সময়ের কাছে জানান দিতে চেয়েছিলেন মনীষা৷ তিনি সফল হলে আমাদের জেনারেশনটা বিসিএস থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিজেদের আরো বিস্তৃত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি পারেননি, ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতা মনীষার একার নয়, আমাদের সবার। আমরা মনীষাককে জিতিয়ে না দিতে পারি, অন্তত সম্মান দিতে পারতাম। তার বদলে বরং হাত ভেঙে দিয়েছি। বর্তমান প্রজন্মের রাজনৈতিক মনোবল ভেঙে আরো বিসিএসমুখী করার জন্য এটাই যথেষ্ট নয় কী?