অনেকে বলেন, আমার মৃত্যুর পর কবরে ঘাস গজালো নাকি তাজমহল উঠল তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কথাটা সত্য বটে, তবে সব দেশ-জাতি-গোষ্ঠীর বেলায় নয়। যেমন, আফ্রিকার দেশ ঘানা। সেখানকার একটি গোত্র তাদের শেষ পারানির তরী অর্থাৎ কফিন কেমন হবে তাও ভাবে। এ নিয়ে সেদেশে গড়ে উঠেছে ব্যতিক্রমী এক শিল্প।বিদেশী সাময়িকী অবলম্বনে আফরোজা খানম লিখেছেন
১৯৫০ সালের শেষ দিকের কথা। ঘানা নামের আফ্রিকান দেশটির রাজধানী আক্রা তখন সবে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। নির্মাণকাজের ধুন্ধুমারে নগরটির চার দিক ধুলায় ধূসর। আক্রা নগরীর কেন্দ্রস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে কতোকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ সবে শেষ হয়েছে, চালু হয়েছে বিমানবন্দরটির। উড়োজাহাজ উড়ছে, নামছে।
বিমানবন্দরের কাছেই তেশি শহর। ওই শহরের এক বৃদ্ধা নারী তার বাড়ির বাইরে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেখেন তার মাথার ওপর দিয়ে বিশাল উড়োজাহাজের সগর্জন আসা-যাওয়া। তার ভারি অবাক লাগে, মজাও পান। একদিন পরিবারের সদস্যদের সাথে কথায় কথায় বলে ফেলেন, ‘একদিন ওই উড়োজাহাজগুলোতে চড়ে কোথাও যেতে পারতাম, খুব মজা হতো।’
প্রবীণার মনের সাধ পূরণ হয়নি। তার আগেই মৃত্যু এসে নিয়ে যায় তাকে। কিন্তু বুড়ির মনের কথা শুনেছিলেন তার নাতি সেখ কানে কেওয়েই। দাদির অপূর্ণ সাধ পূর্ণ করতে অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসলেন তিনি। দাদির কফিনটি বানালেন হুবহু একটা বিমানের মতো করে। তাতে চড়েই দাদিবুড়ি অগন্ত্যযাত্রা করলেন। পরলোকগতা দাদির প্রতি কাঠমিস্ত্রি নাতির এ অদ্ভুত শ্রদ্ধা প্রদর্শন শহরের গা-গোত্রের মধ্যে সাড়া ফেলে দিলো। এই সাড়াই সেখানে জন্ম দিলো নতুন এক ব্যবসার, যার নাম ‘আবেদুউ আদেকাই’, যা এখনো চলছে।
ওই ঘটনার পর গা-গোত্রে ওইরকম কফিন বানানোর ধুম পড়ে গেল। এমন কফিন, যা দেখে লোকটাকে চেনা যায়। যেমন, কোনো জেলে বা মৎস্যশিকারির কফিন হয় রেইনবো বা অন্য কোনো মাছের আদলে। সঙ্গীতশিল্পীর কফিন গিটারের মতো কিংবা শিক্ষকের কফিন বলপেনের মতো। অনেক মেহনতে বানানো এবং চমৎকার সাজে সজ্জিত এসব কফিন লাশ নিয়ে এক দিন সারা শহর প্রদক্ষিণ করে, তারপর তার স্থান হয় শহরের গোরস্থানে, ছয় ফুট মাটির তলায়।
কানে কেওয়েই এরকম ব্যতিক্রমী কফিন বানিয়েছিলেন অনেক আগে। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ ৬০ বছর। তার নাতি এরিক অ্যাডজেটেই আনাং (৩২) এখন ঠাকুরদাদার ওয়ার্কশপের হাল ধরেছেন। তিনি একজন ভাস্কর এবং সুদক্ষ কফিন-নির্মাতা। তিনি বলেন, দাদু তো উড়োজাহাজের মতো কফিন বানানোর চল করে দিয়ে গেছেন।
এখন দেখুন তা কতভাবে এর ব্যবহার হচ্ছে। আগে ধরুন গা-গোত্রের প্রধানরা লোকজনের কাঁধে বহন করা চেয়ারে পথ চলতেন, তাদের মাথার ওপর ধরা থাকত ছাতা। এখনো তারা লোকজনের কাঁধেই চড়ে বেড়ান, অনেকের বেলায় দেখবেন আসনের চেহারাটি বদলে গেছে। সেটি হয়তো হয় ঈগলের মতো, নয়তো মাছ বা কুমিরের মতো।
ঘানার রাজধানী আক্রা প্রধানত কওয়া জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত। এ জনগোষ্ঠীতে আছে গা-আদাংবে, আকান, ইওয়ে, আকওয়াপিম, ফান্তি, কওয়াহু, আকিম ও আশান্তি গোত্র। প্রতিটি গোত্রেরই আছে নিজস্ব রীতিপ্রথা এবং পরিযায়ী স্বভাব, কিন্তু গা গোত্র বহুকাল থেকেই পুরনো আক্রায় ঘাঁটি গেড়ে আছে।
১৯৫০ সালেরই শেষ দিকের কথা। আক্রার কোনো এক গোত্রের প্রধান চাইলেন তাকে বহনকারী চেয়ারটি হবে কোকো ফসল রাখার ঝুড়ির মতো। সেমতে বানানোর কাজও শুরু হলো, কিন্তু কাজ শেষ হবার আগেই মারা গেলেন গোত্রপ্রধান।
এরিক বলেন, ‘দাদু তখন গোত্রপ্রধানের আত্মীয়-স্বজনকে বোঝালেন, নির্মাণাধীন ওই চেয়ারটিকেই তার কফিন করা হোক।’ তা-ই হলো। ঘানার প্রধান রফতানিমুখী কৃষিপণ্য কোকো রাখার ঝুড়িতেই অন্তিম শয়ানে শায়িত হলেন গোত্রপ্রধান।
এর কিছু দিন পরেই ঘটল সেই ঘটনা। উড়োজাহাজে চড়ার অপূর্ণ সাধ নিয়েই অনন্তের পথে যাত্রা করলেন কেন কেওয়েইর দাদি আর দাদির ইচ্ছাপূরণ করতে তিনি দাদির কফিন বানালেন উড়োজাহাজের আকৃতিতে। সে সময় ওই শহরে কোনো লাশঘর ছিল না আর লাশঘরের বাইরে রাখা লাশ পচেগলে যাওয়ার ভয় ষোলো আনা। তাই কেন কেওয়েইকে উড়োজাহাজ-কফিনটি বানানোর কাজটি করতে হয়েছে পাগলের মতো। পাঁচ দিনের মাথায় কাজটি শেষ করেন তিনি। সবাই অবাক! এত তাড়াতাড়ি ও কাজটি করল কিভাবে?
এরপর কেন কেওয়েইর সামনে খুলে গেল নতুন দিগন্ত। উপকূলজুড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন পরিবার থেকে বিচিত্র ধরনের কফিন বানানোর ফরমায়েশ পেতে থাকলেন কেন কেওয়েই। কেউ চাইলেন মাছের মতো, কেউ বা মাছধরা নৌকার মতো। কেনও ফরমাশমাফিক তা বানাতে থাকলেন। তার বাড়ির পেছনের উঠানটি ভরে উঠতে থাকল বিচিত্র চেহারার সব কফিনে।
১৯৭০ সালে কেন দেখলেন বাড়ির উঠোনে আর জায়গা হচ্ছে না। তিনি এবার কারখানা নিয়ে গেলেন তেশি শহরের প্রধান সড়কের পাশে। নাম দিলেন ‘কেন কেওয়েই কার্পেন্ট্রি ওয়ার্কশপ’। কেন কেওয়েই’র মৃত্যুর পর কারখানার দায়িত্ব নেন তার ছেলে আনেস্ত ‘চেদি’ আনাং কেওয়েই। ২০০৫ সালে তার কাছ থেকে কারখানা বুঝে নেন তার ছেলে এরিক, যিনি এখনো এর দায়িত্বে।
এরিকের বয়স তখন মাত্র ২০ বছর। পরিবারের কেউই চাইছিলেন না এরিক এ কাজে জড়িয়ে পড়–ক। তারা চাইছিলেন ছেলেরা লেখাপড়া করবে। ডাক্তার হবে, আইনজীবী হবে। কফিন বানানোর পেশায় কোনো সম্মান আছে!
কিন্তু এরিক অদম্য। তিনি সবার শঙ্কা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকে থোড়াই কেয়ার করে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিলেন কারখানায়। তার কাণ্ড দেখে কারখানার কর্মীরাও অবাক! আরে, ও তো স্কুলে যেতো। আর এখন কিনা সে কফিন মিস্ত্রি হতে চায়! কী আশ্চর্য!
সেই এরিক এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন শিল্পী। তার কারখানায় প্রতি বছর কমবেশি ৩০০টি কফিন তৈরি হয়। গত কয়েক বছরে তিনি ডেনিশ ইমেজেস আর্টস ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শনের জন্য বানিয়েছেন ২৪টি কফিন আর তার কারুশিল্প শিক্ষা দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এরিকের কারখানায় ঝোলানো রয়েছে রাশিয়ান মাত্রিয়োশকা পুতুলের মতো একটি কফিন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদপ্রত্যাশী আলেক্সান্দার দনস্কয়ের অনুরোধে এটি বানানো হয়েছে।
কফিনের কয়েকটি ডিজাইন বেশ জনপ্রিয়। যেমন, বিভিন্ন প্রজাতির মাছের আকৃতির কফিন। এরিক বলেন, আমরা উপকূলের মানুষ। আমাদের আছে অনেক রকম মাছ। তাই সবাই মাছের পিঠে চড়েই পরপারে যেতে চায়। এ ছাড়া কোকো ফসলের ঝুড়ির আকৃতির কফিনও অনেকে পছন্দ করে। কারণ, আমরা পৃথিভীর দ্বিতীয় সর্বাধিক কোকো উৎপাদক দেশ।
আবার ধার্মিক মানুষেরা বাইবেলেও যেতে চান। তবে ধর্মযাজকেরা বাইবেল আকৃতির কফিন গির্জায় রাখার অনুমতি দেন না। তারা এটাকে ধর্মসম্মত মনে করেন না। এরিক ছাড়াও ঘানায় আরো ক’জন জনপ্রিয় কফিন-কারিগর আছেন। এ রকম একজন হচ্ছেন দানিয়েল মেনাশ অব্লি। তিনি বলেন, একটি কফিন কোনো পরিবারের মর্যাদার প্রতীকও বটে। যেমন, কেউ এসে হয়তো বলবেন, এই মানুষটি আমাদের পরিবারের নেতা ছিলেন। তাকে সিংহের পেটে ঘুমাতে দিন।
কাঠের গুণগত মান ও কফিনের নির্মাণশৈলীর ওপর এসব কফিনের দাম নির্ভর করে। স্থানীয় লোকজন সাধারণত যেমন ডিজাইন পছন্দ করে, সে রকম একটা কফিনের দাম পড়ে কমবেশি ৫০০ মার্কিন ডলার। আবার কোনো বিদেশি ক্রেতা এসে হয়তো চাইলেন অপ্রচলিত কিংবা জটিল ডিজাইনের কফিন, তখন ওই কফিনের জন্য তাকে গুনতে হয় ১৫০০ থেকে ৩০০০ হাজার মার্কিন ডলার। সারা বছর তাই এরিককে বানাতে হয় অনেক ছাদের কফিন কাঁকড়া, শামুক, কচ্ছপ, স্টেথিস্কোপ, সিরিঞ্জ, রোবট, পিয়ানো এমনকি পেট্রলপাম্প পর্যন্ত।
সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছিল স্টিংরে (এক প্রকার বিষাক্ত মাছ, যা মেরুদণ্ডের সাহায্যে প্রচণ্ড আঘাত হানতে পারে) আকৃতির কফিন বানানো। এরিক স্মরণ করেন, ‘এটি নিয়ে আমাকে চার দিন ভাবতে হয় যে, কিভাবে বানাবো। কারণ, স্টিংরে একেবারেই চ্যাপ্টা একটি মাছ।’ যে দেশের গড় মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১৪০০ মার্কিন ডলারের মতো, সে দেশে একটি বাহারি কফিনের দাম এত দাম একটু বাড়াবাড়িই মনে হয় বৈকি। তবে ঘানা নামে দেশটিতে মৃতের শেষকৃত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান।
তাদের লৌকিক বিশ্বাস হলো, মৃতরা জীবিতদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। কাজেই তাদের ভালোমতো বিদায় জানানোটা (শেষকৃত্য) খুব দরকার। এ বিশ্বাস থেকেই মৃতের আত্মীয়স্বজন চায় মৃতের শেষকৃত্য যত বেশি সম্ভব লোকসমাগম ঘটাতে। এ জন্য তারা শেষকৃত্যের খবর জানিয়ে বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দেয়।
দানিয়েল বলেন, সবার কাছ থেকে অল্প-অল্প টাকা নিয়ে এমনকি একজন নিতান্ত দরিদ্রজনও একটি সুন্দর শেষকৃত্য পেতে পারে, বিশেষ করে ওই ব্যক্তি যদি জীবদ্দশায় জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। এরিক বলেন, শেষকৃত্য অনেকটা বিয়ে বা বাগদান অনুষ্ঠানের মতো। মৃত ব্যক্তির প্রিয়জনরা যত দূরেই থাকুন না কেন, তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঠিকই চলে আসেন। কাজেই আমাদের অর্থাৎ গা-গোত্রের মানুষদের জন্য, গাস ও আশান্তি গোত্রের জন্য,
একটা খুব বড় অনুষ্ঠান এটা। এখানে মাঝে মাঝে এমন সব আত্মীয়স্বজনের দেখাও মেলে, যাকে আপনি আগে কখনো দেখেনইনি। শেষকৃত্যের মতো বড় অনুষ্ঠানে তাই অনেক আত্মীয়স্বজনের সাথে অনেকের সাথে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগও ঘটে। সব দেখেশুনে এরিক তার কাজের স্থায়িত্ব সম্পর্কে অনেকটা দার্শনিকসুলভ উদাসীন হয়ে গেছেন। তাই তো তিনি বলেন, ‘সব কিছুই মাটির তলায় চলে যায়। আমরা কত পরিশ্রম করেই না একেকটি কফিন বানাই। কিন্তু যার জন্য বানালাম সেই মানুষটিই যদি না-থাকেন, তবে আর এই শিল্পকর্মের কী মূল্য!’