চুয়াডাঙ্গায় ২০ জনের চোখ হারানোর ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। সোমবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। পরে চোখ হারানো ২০ জনকে ক্ষতিপূরণ দিতে জারি করা রুলের শুনানি মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করেন আদালত।
সোমবার শুনানির শুরুতে অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনের পক্ষে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন দুটি দাখিল করেন। ওই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দুটি তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হলেও রিপোর্ট দুটিতে দুই রকম মতামত দেয়া হয়েছে।
তাই রিপোর্ট দুটি প্রসঙ্গে আদালত রিটকারী আইনজীবী অমিত দাস গুপ্তের মতামত জানতে চান। আদালত বলেন, প্রতিবেদন বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য আছে কিনা? তখন এ আইনজীবী বলেন, দুইটি প্রতিবেদনেই দুই রকমের মতামত দেয়া হয়েছে।
এরপর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবিএম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার বলেন, একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ওই ওষুধগুলো দেশে আনা হয়েছে, কিন্তু সেগুলো রেজিস্টার্ড ছিল না।
এ সময় আদালত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, তাহলে ড্রাগ অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া কীভাবে ওষুধ আনলেন? আপনারা জানেন না, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে?
তার মানে আপনাদের নলেজে ছিল। ওষুধ বা অপারেশন যন্ত্রপাতিতে যদি সমস্যা থাকে তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া এসব দেশে আসে কীভাবে? এটা মানা যায় না। এটা বলে আপনারা (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) দায় এড়াতে পারেন না।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবিএম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার আদালতকে বলেন, এই রিটটি চলমানযোগ্য নয়। স্বাস্থ্যসেবার অধিকার, মৌলিক অধিকার নয়। তখন আদালত জানতে চান, এই রিটটি জনস্বার্থে করা হয়েছে কিনা? তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হ্যাঁ।
এরপর আদালত বলেন, রিটটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে কিনা সেটি আমরা রুল শুনানিতে দেখব। সাংবিধানিক বিষয়টি আমরা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছে শুনব। পরে আদালত এ বিষয়ে জারি করা রুলের পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করেন।
আদালতে রিটের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অমিত দাস গুপ্ত, সঙ্গে ছিলেন শুভাষ চন্দ্র দাস। ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
পরে রিটকারী আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত বলেন, চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে একটি চক্ষুশিবির অনুষ্ঠিত হয়।
ওই চুক্ষশিবিরে চিকিৎসা নিয়ে ২৪ জনের মধ্যে ২০ জন চোখ হারায়। এ ঘটনায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে আমরা একটি রিট দায়ের করি। রিটের প্রেক্ষিতে আদালত রুল জারি করেন।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে রুলের জবাব না দেয়ায় আদালত স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনকে তলব করেন। গত ৯ জুলাই তারা আদালতে এসেছিলেন। পরে তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত লিখিত জবাব দিতে সময় দেন।
অমিত দাস গুপ্ত বলেন, আজকে তাদের দুজনের পক্ষ থেকে লিখিত জবাব দাখিল করা হয়। ওই জবাবের মধ্যে দেখা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দুটি কমিটি করা হয়েছে।
ওই দুই কমিটি দুটি রিপোর্ট দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম রিপোর্টটি করা হয় ১৩ মে, আর দ্বিতীয় রিপোর্ট দায়ের করা হয় ১৫ জুলাই। আজকে এ দুটি রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করা হয়।
তিনি বলেন, এখানে দেখা যায় দুটি রিপোর্টে পরস্পরবিরোধী মতামত রয়েছে। প্রথম রিপোর্টে ইমপ্যাক্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ত্রুটির কথা বলা হয়েছে।
এখানে ত্রুটি মানে অবহেলা। এ মর্মে মতামত প্রদান করা হয়েছে। আর পরের রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, এই অপারেশন করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কোনো অবহেলা ছিল না। বরং তারা ইতিপূর্বে আরও অনেক অপারেশন করেছে। তাতে তারা সফলও হয়েছে।
রিটকারী আইনজীবী বলেন, এ ঘটনার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ তারা উল্লেখ করেননি। এ বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে আদালত তখন বলেন, অপারেশন করার ক্ষেত্রে ইমপ্যাক্ট কর্তৃপক্ষকে অনুমতি প্রদান করেছিল মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এ ধরনের অপারেশনে যদি ত্রুটি হয় এতে যদি নাগরিকদের ক্ষতি হয় তাহলে এর দায় মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।
তিনি বলেন, যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে সেটি জীবাণুমুক্ত কিনা সেটি দেখার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের ছিল, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ছিল। এ কারণে এর ক্ষতি দায় তারা এড়াতে পারেন না। এছাড়া ওই অপারেশনের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির বিষয়ে আদালত বলেছেন, এগুলো বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, না আমাদানি করা হয়েছে সেটি ওষুধ প্রশাসনের দেখার কথা থাকলেও তারা সেটি দেখেননি। এর দায়ও মন্ত্রণালয় এড়াতে পারেন না।
রিপোর্ট তৈরিতে সব ভিকটিমকে সাক্ষাৎকার নেয়া উচিত ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু সেটি তারা করেননি। বরং ভিকটিমদের বাইরের লোকজনকে সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এ রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কোনো পক্ষপাতিত্ব করেছেন কিনা সেটি আদালত জানতে চেয়েছেন।
গত ২৯ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ‘চক্ষুশিবিরে গিয়ে চোখ হারালেন ২০ জন!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৪ মার্চ থেকে চুয়াডাঙ্গার ইমপ্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে তিন দিনের চক্ষুশিবিরের দ্বিতীয় দিনে ২৪ জন নারী-পুরুষের চোখের ছানি (ফ্যাকো) কাটা হয়। ওই অস্ত্রোপচারের দায়িত্বে ছিলেন চিকিৎসক মোহাম্মদ শাহীন।
পরদিন বাসায় ফেরার পর ওই রোগীদের চোখে সংক্রমণ দেখা দেয়। চোখে জ্বালা-পোড়া নিয়ে তারা যোগাযোগ করেন ইমপ্যাক্ট হাসপাতালে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব না দিলেও পরে কয়েকজন রোগীকে স্থানীয় এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। ওই চক্ষু বিশেষজ্ঞ তাদের জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন।
এদের মধ্যে চারজন রোগী নিজেদের উদ্যোগে স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরে ইমপ্যাক্ট থেকে ১২ মার্চ একসঙ্গে ১৬ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু তত দিনে দেরি হয়ে যাওয়ায় ১৯ জনের একটি করে চোখ তুলে ফেলতে হয়। আরেক নারীর অপারেশন করা বাম চোখের অবস্থাও ভালো নয়। ঢাকায় দ্বিতীয় দফায় অপারেশন করলেও দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসেনি তার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ২০ রোগীর সবাই দরিদ্র। কেউ স্বজনের কাছে ধারদেনা করে, কেউ বাড়ির ছাগল-মুরগি বিক্রি করে, কেউ এনজিও থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ইমপ্যাক্ট হাসপাতালে গিয়েছিলেন চোখ সারাতে।
পরে আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি সংযুক্ত করে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় গত ১ এপ্রিল রিট দায়ের করেন। রিটের শুনানি নিয়ে চুয়াডাঙ্গা শহরের ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে চক্ষু শিবিরে চিকিৎসা নিতে এসে চোখ হারানো ২০ জনের প্রত্যেককে ১ কোটি টাকা করে কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন, চুয়াডাঙ্গার ডিসি ও এসপি, ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টার, ডা. মোহাম্মদ শাহীনসহ মোট ১০ জনকে বিবাদীকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
আদালত পৃথক এক রুলে চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে তিন দিনের চক্ষুশিবিরে চক্ষু চিকিৎসায় ২০ জনের চোখ অস্ত্রোপচারে কার্যকর, যথাযথ ও পর্যাপ্ত নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণে নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চান। একই সঙ্গে ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তারের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না, তাও জানতে চান আদালত।