সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ কত?

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশ থেকে পাচারকৃত টাকার প্রধান গন্তব্য সুইস ব্যাংকগুলো। সুইজারল্যান্ডের সুইস ব্যাংকে পাঁচ বছর ধরেই বাড়ছে বাংলাদেশীদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ।

কিন্তু বিদায়ী বছরে এসে বাংলাদেশীদের জমাকৃত আমানত দেড় হাজার কোটি টাকার মতো কমেছে। ২০১৭ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশীদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার সুইস ফ্রাঁ।

বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্রাঁ ৮৪ টাকা ৫২ পয়সা হিসাবে)। ২০১৬ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ৬১ হাজার সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।

গতকাল সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের মতোই পাকিস্তানিদের জমাকৃত আমানত কমেছে। তবে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে সুইস ব্যাংকে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল শেষে সুইস ব্যাংক পাকিস্তানিদের জমাকৃত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ।

২০১৬ সাল শেষে ওই ব্যাংকগুলোয় পাকিস্তানিদের ১৩৮ কোটি ৬৬ লাখ সুইস ফ্রাঁ জমা ছিল। সে হিসাবে বিদায়ী বছরে সুইস ব্যাংকে পাকিস্তানিদের জমাকৃত আমানত কমেছে ২৮ কোটি ৫৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ।

গত বছর সুইস ব্যাংকগুলোয় পাকিস্তানিদের আমানত কমলেও ভারতীয়দের ৩৩ কোটি ৪২ লাখ সুইস ফ্রাঁ বেড়েছে। ২০১৭ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় ভারতীয়দের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ কোটি ৯০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০১৬ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় ভারতীয়দের জমাকৃত অর্থ ছিল ৬৬ কোটি ৪৮ লাখ সুইস ফ্রাঁ।

এসএনবির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশভিত্তিক জমাকৃত আমানতের পরিমাণ উল্লেখ থাকলেও গ্রাহকদের বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। কয়েক বছর ধরে দেশভিত্তিক আমানতের পরিমাণ প্রকাশ করে আসছে এসএনবি। বরাবরের মতোই গ্রাহকদের বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করেছে ব্যাংকটি।

তবে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী, কোনো বাংলাদেশী নাগরিকত্ব গোপন করে অর্থ জমা রাখলে ওই অর্থ এ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত নয়। গচ্ছিত স্বর্ণ বা মূল্যবান সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমানও হিসাব করা হয়নি প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের অর্থ কম দেখানোর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত. বিদেশে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে যাদের ব্যাপারে সন্দেহ আছে, তাদের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। টাকা পাচারকারীদের ওপর এর প্রভাব কাজ করতে পারে।

দ্বিতীয়ত. সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ অর্থ পাচার রোধে কিছুটা সক্রিয়। সংস্থাটি ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে। তৃতীয়ত. অন্য দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা রাখার ক্ষেত্রে সুইস ব্যাংকগুলোর ওপর সে দেশের সরকার কড়াকড়ি আরোপ করেছে।

এজন্য ওই দেশের ব্যাংকগুলো পাচারকৃত টাকার উৎস খুঁজে দেখছে। চতুর্থত. এরই মধ্যে সুইস ব্যাংকে জমাকৃত টাকা হয়তো বিভিন্ন খাতে পাচারকারীরা বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে সে দেশে কিংবা অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে।

এছাড়া সুইস ব্যাংকের ওপর কড়াকড়ির কারণে পাচারকৃত টাকার গন্তব্য অন্য কোনো দেশে স্থানান্তর হতে পারে। টাকার গন্তব্য হয়তো পানামা, বারমুডা, সিঙ্গাপুর কিংবা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ কোনো দেশের দিকে ঘুরে গেছে।

তবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমাকৃত টাকার পরিমাণ কমাটা সাময়িক বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর। তার মতে, ভবিষ্যতে এটি আবার বেড়েও যেতে পারে।

সেটি যাতে না হয়, সেজন্য সরকারের দায়িত্ব হবে সুইস ব্যাংকগুলোয় জমাকৃত টাকার উৎস ও জমাকারীদের খুঁজে বের করা। পাচারকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হলেই কেবল দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ হবে।

প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে সুইস ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমার ক্ষেত্রে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করেছে সে দেশের সরকার। আমানত জমা নেয়ার ক্ষেত্রে সম্পদ অর্জনের উৎস জানতে চাইছে সে দেশের ব্যাংকগুলো।

এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ পাচারকারীরা সুইস ব্যাংকে টাকা জমা না রেখে অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ পানামা, বারমুডা, লুক্সেমবার্গ, কেম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, এমনকি মালয়েশিয়ার মতো দেশের দিকে ঝুঁকছে।

২০১৭ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জমাকৃত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৯৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ;

বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। ২০১৬ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোয় এসব দেশের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫৭৮ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ।

শেয়ার করুন: