প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই ‘টাকার অভাবে’ একমাত্র ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) পড়াতে না পারার কথা জানালেন শেখ হাসিনা।
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশে ‘খুবই সীমিত খরচে’ লেখাপড়ার সুযোগ থাকার বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে একথা জানান তিনি।
বুধবার জাতীয় সংসদে এই আলোচনায় অর্থাভাবে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীরও অক্সফোর্ডে পড়তে না পারার কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তাদের ছেলে-মেয়েরাও লেখাপড়া করেছেন বিদেশে।
জয় ভারতের নৈনিতালের সেন্ট জোসেফ কলেজে লেখাপড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটন থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক করেন। পরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে লোক প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেন তিনি।
শেখ রেহানার ছেলে-মেয়েরাও লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাজ্যে। তার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক এখন লন্ডনের একটি আসন থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য।
ছেলে-মেয়ে ও ভাগনে-ভাগ্নিদের লেখাপড়া নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করেছে, চাকরি করেছে। পড়ার মাঝে গ্যাপ দিয়ে চাকরি করে আবার পড়াশুনা করেছে।
“একবার গ্রাজুয়েশন হয়েছে, কিছু দিন চাকরি করেছে, স্টুডেন্ট লোন নিয়েছে, সেটা শোধ দিয়েছে আবার ভর্তি হয়েছে মাস্টার্স ডিগ্রি করেছে। আবার সেই লোন শোধ দিয়েছে। এইভাবে পড়েছে। পড়াশুনা করা অবস্থায়ও ঘণ্টা হিসেবে কাজ করেছে, পার ঘণ্টা একটা ডলার পেত, সেটা দিয়ে তার চলত।”
টাকার অভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে দুই সেমিস্টার পড়ে ছেলে জয়ের সেখান থেকে চলে আসার কথা বলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ভারতের ব্যাঙ্গালোর ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক করার পর জয় কিছু দিন চাকরি করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এরপর আরও উচ্চ শিক্ষার জন্য এমআইটিতে (আমেরিকা) চান্স পেল।
আমি তার শিক্ষার খরচ দিতে পারিনি। দুটো সেমিস্টার পড়ার পর নিজে কিছু দিল, আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধব সহযোগিতা করল, যার জন্য যেতে পারল।
“আর আব্বার বন্ধু আমার ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উনি বলতেন, তুমি পলিটিক্স করো এটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তিনি না থাকলে আমি পড়াতে পারতাম না।
এমনকি মিশনারি স্কুলে তারা পড়েছে। সাত দিনই সবজি বা ডালভাত খেতে হত, একদিন শুধু মাংস খেতে পারত। এভাবে কৃচ্ছ সাধন করে এরা বড় হয়েছে।”
কষ্টের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “যখন এমআইটিতে দিতে পারলাম না। আমি প্রধানমন্ত্রী, আমার দ্বিধা হল, কাকে বলব টাকা দিতে বা কীভাবে আমি টাকা পাঠাব, বুঝতে পারিনি। কার কাছে দেনা হব? আমার কারণে তার পড়া হল না। দুটো সেমিস্টার করে তাকে বিদায় নিতে হল। তারপর সে চাকরিতে ঢুকল।”
২০০৭ সালে মায়ের অনুরোধেই হার্ভার্ডে ভর্তির আবেদন করেন সজীব ওয়াজেদ জয়। সেই সময়ের কথা তুলে ধরে হাসিনা বলেন, “২০০৭ সালে বউমা অসুস্থ হলে দেখতে গেলাম। তখন তাকে অনুরোধ করলাম।
কারণ আমার ভেতরে এই জিনিসটা খুব কষ্ট লাগত যে, আমি প্রধানমন্ত্রী হলেও তার পড়ার খরচ দিতে পারিনি। তখন আমি বললাম, তুমি হার্ভার্ডে আবেদন কর। আমি অনুরোধ করার পর সত্যি সে আবেদন করল। চান্স পেয়ে গেলে।”
ছেলেকে প্রথম সেমিস্টারের টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হয়ে তা আর সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি কথা দিয়েছিলাম, ফার্স্ট সেমিস্টারের টাকা আমি দেব। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার আগে গ্রেপ্তার হয়ে গেলাম। তবে আমি চেয়েছিলাম, চান্স যখন পেয়েছে যেভাবে পারুক চালাক।
পরে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে তা ভাড়া দিয়ে সেই ভাড়ার টাকা দিয়ে, কলেজ থেকে দূরে বাসা নিল যাতে সস্তায় বাসা পায়, গাড়ি রেখে মটরসাইকেল চালিয়ে সে আসত।
“রেহানার মেয়ে অক্সফোর্ডে চান্স পেয়েছে সে পড়াশুনা করল- স্টুডেন্ট লোন নিয়ে তারপর পড়াশুনা শেষে চাকরি করে লোন শোধ দিল, যে ২১ বছর বয়স থেকে চাকরি করে। কয়েক বছর চাকরি করার পর সে মাস্টার্স ডিগ্রি করল। আবার চাকরি করল।”
সুযোগ পেয়েও অর্থের অভাবে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর অক্সফোর্ডে পড়তে যেতে না পরার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “মাননীয় স্পিকার অক্সফোর্ডে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবার ওখানে পড়ার খরচ দেওয়ার সেই সংগতি ছিল না। এজন্য তিনি ভর্তি হতে পারেননি।”
সেই তুলনায় বাংলাদেশে কম খরচে শিক্ষার সুযোগের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের ছেলে-মেয়েরা পৃথিবীর সব থেকে অল্প খরচে লেখাপড়া শেখে। এত অল্প খরচে পৃথিবীতে কেউ লেখাপড়া করতে পারে না।”
“আমাদের দেশে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে, তাদের সিট ভাড়া কত? তাদের খাবার টাকা কত? পড়াশুনার ফিস কত? কয় টাকা খরচ করে? বলতে গেলে একেবারে বিনা পয়সায় আমরা পড়াই। তারপরও তারা যদি রাস্তায় নামে, ভিসির বাড়ি ভাংচুর করে, লুটপাট করে- এর থেকে লজ্জার কী হতে পারে?”
ঘোষণা অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল নিয়ে কাজ চলছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এত বছর ধরে যে জিনিসটা চলেছে তাকে তো রাতারাতি...আমি বলেছি থাকবে না। এখন এই থাকবে ‘না’ টা কীভাবে কার্যকর করা যায় তার জন্য এই কমিটি গঠন করা হয়েছে, যাতে করে এটা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
“এরপর যদি মফস্বলের কেউ চাকরি না পায় তার জন্য কিন্তু আমাদের দায়ী করতে পারবে না।”
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে গত এপ্রিলে সংসদে দাঁড়িয়েই কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
বুধবার সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা থাকতে হবে।
এই কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যই তো আজকে স্বাধীন। তাদের অবদানেই তো আজকে এই দেশ পেয়েছি।”
১৯৭২ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু থাকার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের অনেক অনুন্নত এলাকা রয়েছে, সেই এলাকা, মেয়েদের জন্য, প্রতিবন্ধীদের জন্য- এই কোটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম শিক্ষার্থীরা সব ঝাঁপিয়ে পড়ল- কোটা পদ্ধতি বাতিল করার জন্য। সেই যাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা তারাই যদি না চায় তাহলে ওটা রাখার আর দরকারটা কী?”