মনযূরুল হক ইসলাম: দগোনদাজি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাধ্যমেই তার প্রথম ও একমাত্র সেক্যুলার স্কুলে পড়ার সুযোগ ঘটে। এ সময়ই ঘটনাক্রমে একদিন সকোটো প্রদেশের ১৮তম সুলতান ইবরাহিম দাশুকির সঙ্গে মোলাকাত হয়। ইসলামের একটি ছোট্ট বিধান জানতে সুলতান স্কুলের দিকে আসছিলেন।
পথিমধ্যে গুমির কাছে রসিকতার ছলেই মাসআলাটি জিজ্ঞেস করেন এবং গুমি তৎক্ষণাৎ সুলতানকে সন্তোষজন জবাব প্রদান করেন। মাত্র ৮ বছরের একটি শিশুর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে সুলতান হতবাক হয়ে যান এবং স্কুলে ছাত্রদের ধর্মীয় কর্মকা- পরিচালনার জন্য তাকে হাকিমিন সাল্লা (ইমাম) নিযুক্ত করার সুপারিশ করেন।
মাত্র এক বছরের মধ্যেই গুমি সকোটো মাধ্যমিক স্কুলে স্থানান্তরিত হন, যেখানে উত্তর নাইজেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী আহমদ বেলো শিক্ষাদান করতেন। সেখানেই নাইজেরিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট (১৯৭৯-১৯৮৩) শেহু শাগারি, ইতিহাসবিদ মুহাম্মাদু জুনাইদু (১৯২৫-১৯৯৭) ও ওস্তাদ মালাম ইয়াহিয়া গুসাউয়ের (১৯১৫-২০০৮) সঙ্গে পরিচিত হনÑ যিনি পরবর্তী সময়ে আবুবকর গোমির সঙ্গে প্রখ্যাত নাইজেরিয়ান মুসলিম সংগঠন ‘জামায়াত নাসরুল ইসলাম’ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন।
তার পুরো নাম শায়খ আবু বকর মাহমুদ গুমি। ১৯২২ সালের ৫ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন উত্তর-পশ্চিম নাইজেরিয়ার সকোটো শহরের গুম্মি গ্রামে। পিতা মাহমুদও ছিলেন একজন ইসলামিক স্কলার এবং গুম্মি গ্রামের আলকালি (বিচারক)।
বাবার কাছে পারিবারিক পরিম-লেই ইসলামি শিক্ষায় হাতেখড়ি হয় তার। পরে সকোটো প্রদেশে মুসা নামের জনৈক মালামের (মাওলানা) তত্ত্বাবধানে স্কুলে যাতায়াত শুরু করেন। সেখানেই ফিকহের সঙ্গে পরিচিত হন এবং নবীজির (সা.) জীবনী পাঠের শিক্ষা পান।
মাধ্যমিক পাঠ শেষ হলে আইন অধ্যয়নের ইচ্ছায় পার্শ্ববর্তী কানো শহরে গমন করেন এবং শরিয়া আইনের ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার জন্য ‘কাজি’ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কিন্তু কাজি আতাউরুর কাছে নবিশি শুরু করার পরই ছকবাঁধা জীবনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন; বরং এর চেয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে জনগণের সামনে কোরআনের তফসির করাকেই আকর্ষণীয় মনে হয় তার।
১৯৪৭ সালে কানোর সেই ল’ স্কুলে পাঠদান শুরু করেন। এ সময়ে মাহদিয়া আন্দোলনের নেতা তিনি শায়খ সাঈদ হায়াতুর সাক্ষাৎ পান, যাকে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ক্যামেরুন থেকে জোরপূর্বক নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। গুমি নিজেও মাহদিয়া আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং এমনকি হায়াতুর কন্যা মরিয়মকে বিয়েও করেনÑ যদিও একটি পুত্রসন্তান জন্মদানের পরপরই তার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে।
কানো ছেড়ে মারু শহরে পাড়ি জমান এবং ১৯৪৯ সালে একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পানÑ যেখানকার বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের নেতা আমিনু ক্যানো (১৯২০-১৯৮৩), যিনি উত্তরাঞ্চলে শিক্ষক সমিতির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং কয়েকটি মুসলিম স্কুলের পরিচালকও ছিলেন।
উভয়ে একতাবদ্ধ হয়ে ইসলামি বিশ্বাসের বলয়ে ঐতিহ্যবাহী সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন এবং বিদা শহরের সুফি ব্রাদারহুডের সংকীর্ণ আচরণকে ধর্মপরিপন্থি বলে আখ্যায়িত করেন। ইসলামকে আরও গভীরভাবে জানতে কানো শহরে ফিরে অ্যারাবিক স্টাডিজ অধ্যয়ন শুরু করেন।
দুই বছর পরে এখানেই অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। এরপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য চলে যান সুদান। দেশে ফিরে আসেন উত্তর নাইজেরিয়ান গভর্নমেন্টে সৌদি আরব বিষয়ক মুখপাত্র হিসেবে। সরকারি কাজে যোগদানের পরে উত্তর নাইজেরিয়ার কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক ও ধর্মীয় নির্দেশক হিসেবে ক্রমেই আস্থাভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি।
১৯৫৫ সালে তিনি আহমাদু বেলোর সঙ্গে প্রথমবারের মতো হজযাত্রা করেন। মক্কায় তিনি বেলো ও কিং সাউদের মধ্যকার সংঘটিত বিভিন্ন চুক্তিপত্র ও ইসলামিক রিলিজিয়াস কর্মকা- ভাষান্তরের কাজ করেন। এ সময় সৌদি আরবের বেশ কয়েকজন ইসলামিক স্কলারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, যাদের অনেকে আহমাদু বেলোর মৃত্যুপরবর্তী সময়ে (১৯৬৬ সালে) তাকে সহায়তা করেছেন।
এই সূত্রেই ১৯৬২ সালে সৌদি আরবে মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের (রাবেতা আলম-আল ইসলামি) প্রতিষ্ঠা হলে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখেন এবং রাবেতার ফিকহ একাডেমির সুপ্রিম মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া কায়রো আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পরিষদ ও মদিনা বিশ্ববিদ্যলায়ের সর্বোচ্চ পরিষদের সদস্যও মনোনীত হন।
নাইজেরিয়া ফেরার পর জামায়াত নাসর আল ইসলামের (জেএনআই) অধীনে বেশ কয়েকটি মুসলিম স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে হাউসা ভাষায় ইসলামিক শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতা এবং উত্তর নাইজেরিয়ার বিপুল জনগোষ্ঠীর ইসলামি শিক্ষার চাহিদা পূরণে কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যামূলক আরবি মৌলিক গ্রন্থগুলো হাউসা ভাষায় রূপান্তরের কাজ হাতে নেন।
এ ভাষার বৃহত্তর মুসলিম শ্রোতাদের জন্য নিয়মিত টেলিভিশন প্রোগ্রাম শুরু করেন। ১৯৬২ সালে (১৯৬৮ পর্যন্ত) উত্তর নাইজেরিয়ার শরিয়া কোর্টের প্রধান বিচারপতি (গ্র্যান্ড কাজি) হিসেবে যোগ দেন। মুসলিম অধ্যুষিত নাইজেরিয়ার উত্তরাংশকে খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ অংশ থেকে পৃথক করে সে অঞ্চলে নিখাদ শরিয়া আইনি ব্যবস্থা প্রবর্তনেও ব্যাপক ভূমিকা রাখেন।
এর পরই শায়খ গুমি আন্দোলনে নামেন হজবোর্ডের চেয়ারম্যান জিব্রিল মার্টিন পরিচালিত কাদিয়ানিদের আহমাদিয়া ও তিজানিয়া এবং সুফিদের কাদেরিয়া গ্রুপের বিরুদ্ধে। ছাত্রদের মধ্যে এই আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং হাজিরাও হজবোর্ডকে বয়কট করা শুরু করলে অল্পদিনের মধ্যে নাইজেরিয়ায় কাদিয়ানি আন্দোলন গুটিয়ে যায়। কিন্তু আহমাদু বেলোর মৃত্যুর পর গুমির প্রধান নাইজেরিয়ান রাজনৈতিক সমর্থনেরও মৃত্যু ঘটে। এ সময় নারীদের ভোটদানের অধিকারবিষয়ক আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে সমর্থন ব্যক্ত করেন।
সত্তরের দশকে মুদি সালা নামক জনৈক মুসলিম নেতার পরিচালিত বৃহৎ একটি রাজনৈতিক সংগঠন ‘ফিতিয়ান আল ইসলাম’ খুন ও অপহরণের মতো ধ্বংসাত্মক কাজে জড়িয়ে পড়লে তিনি পুরনো ছাত্রদের নিয়ে আবারও মাঠে নেমে আসেন।
জেএনআইর ম-াধ্যমে বিচার বিভাগে নিজের মতাদর্শী লোকদের বিস্তার ঘটাতে বিপুল পরিমাণে ছাত্রসমাবেশ ঘটান। একই সঙ্গে ভ-পীরদের বিরুদ্ধে ‘ইযালাতুল বিদাআহ ওয়াইকামাতুস সুন্নাহ’ (মুভমেন্ট ফর দ্য রিভাইভাল অব দ্য সুন্নাহ) নামে নতুন দল গঠন করেন, যা ইযালা আন্দোলন নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সারা দেশে তাকে ‘ইযালার জনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ সময় সুফি ও ননমুসলিমদের বিরাট একটি অংশ গুমির আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকার পরিচালিত সুপ্রিম মিলিটারি কাউন্সিলের বিচার বিভাগীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে দখলদার সামরিক বাহিনীর হাত থেকে জনপ্রতিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। ব্রিটিনের ইনডিপেন্ডেন্ট নিউজের ভাষ্যমতে, এই একটি ঘটনার জন্য হলেও নাইজেরিয়ার মানুষের কাছে তিনি চিরায়ত স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। গুমি বিশ্বাস করতেন এবং সামরিক সরকারের সমালোচনায় সরাসরি তিনি বলেছেনও, নাইজেরিয়ান মুসলিমদের কখনও কোনো অমুসলিম শাসককে মেনে নেওয়া উচিত নয়, যদিও অমুসলিমদের সঙ্গে মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে কোনো বাধা নেই।
১৯৮৭ সালে তিনি নাইজেরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘কমান্ডার অব দ্য ফেডারেল রিপাবলিকে’ (ওএফআর) ভূষিত হন এবং এ বছরই হাউসা ভাষায় কোরআনের অনুবাদের জন্য তিনি মুসলিম বিশ্বের নোবেল সমপর্যাদার পুরস্কার ‘বাদশা ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ লাভ করেন। তার লিখিত ‘রদ্দুল আযহান ইলা মা’আনিল কুরআন (দি ইন্টেলিজেন্ট রিপ্লাই কনসার্নিং দ্য মিনিং অব দি কোরআন) গ্রন্থখানি ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্রদের পাঠ্যতালিকাভুক্ত, যা কোরআনের গতানুগতিক তফসিরের সঙ্গে আইনানুগ ব্যাখ্যাও দিয়েছে। এছাড়াও তিনি ‘আল আকিদাতুস সহিহা বিমুওয়াফাকাতিশ শারিয়া’ নামেও একটি ফিকহি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
শায়খ আবু বকর গুমি উত্তর নাইজেরিয়ায় কেবল ইসলাম পুনরুজ্জীবনে অবদান রাখেননি, বরং ধর্মীয় পা-িত্যে তার কাছাকাছি ব্যক্তিত্বও নাইজেরিয়ায় বিরল। ১৯৯২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর খ্যাতিমান এই মুসলিম স্কলার লন্ডনে ইন্তেকাল করেন।