আপনি ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা?

গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু হতে আরো দিন বিশেক বাকি। তবে বিশ্বকাপের উত্তাপের আঁচটা গায়ে লাগতে শুরু করেছে। সেই আঁচ পেতে কিন্তু আপনাকে রাশিয়া বা জার্মানি বা ল্যাতিন আমেরিকায় যেতে হবে না।

বাংলাদেশে বসেই আপনি পাবেন সেই উত্তেজনা; বাংলাদেশে বসে নয় শুধু, ঘরে বসেই টের পাবেন সেই আঁচ। শুধু পাবেন বললে কম বলা হবে।

আমার ধারণা, বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার চেয়ে বাংলাদেশে কম নয়। এই যে বললাম, ঘরে বসে টের পাবেন। কিভাবে? আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোনেই পাবেন সব খবর, সব উত্তেজনা।

বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষও ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল জগতে ঢুকে গেছে। মানুষের হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-অনুভ‚তি সব এখন ভার্চুয়াল। বিশ্বকাপ শুরুর মাসখানেক আগে থেকেই বাংলাদেশের মানুষ ফেসবুকে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। শুরু করে দিয়েছে না বলে, বলা ভালো প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আসল লড়াই হবে আসল সময়ে। এখন চলছে ওয়ার্মআপ। কে কোন পক্ষ তা জানান দেওয়া, নিজেদের দল ভারী করা, ট্রল করা চলছে সমানতালে। ফেসবুকের নিউজফিডে বিশ্বকাপের হরেক তথ্যের ছড়াছড়ি। নিজের পছন্দের দলের সাফল্য উদযাপনের চেয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই মানুষের আগ্রহ বেশি।

বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বললে কারো মনে হতে পারে, বিশ্বকাপে দুটি দল খেলেÑ ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। এবার ফেসবুকে যত মাতামাতি, বাস্তবে কতটা হবে জানি না। তবে বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশের দিগন্ত ছেয়ে যায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকায়। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশে যত পতাকা ওড়ে, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় তত নয়। আচ্ছা বাংলাদেশে যে এত ফুটবলভক্ত, চার বছর এরা কোথায় থাকেন?

বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে তো কারো মাতামাতি দেখি না। চার বছর ক্রিকেটে বুদ হয়ে থাকা মানুষ, হঠাৎ ফটবলে মজে যায় কোন জাদুমন্ত্রবলে? আমার ধারণা বাংলাদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে ফুটবল।

সত্তর ও আশির দশকে সেটা আমরা দেখেছি। কিন্তু ফুটবলের ক্রমাবনতি আর পাশাপাশি ক্রিকেটের একের পর এক সাফল্যে বাংলাদেশে চিত্রটা পাল্টে গেছে। এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ বুঝি সাফল্যের পূজারি। সফলের গলায়ই শুধু মালা দেয়। কিন্তু আমি আপনাদের বলছি, বাংলাদেশের মানুষ ফুটবল ভালোবাসে; নিছক ফুটবল নয়, শৈল্পিক ফুটবল।

নইলে ৩২ বছর আগে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জেতা আর্জেন্টিনার এত সমর্থক থাকত না বাংলাদেশে। ৭০-এ পেলেতে মজে যাওয়া বাঙালি কিন্তু ২৪ বছর ব্রাজিলের পাশে ছিল।

সাফল্যই যদি সব হতো, তাহলে গত বিশ্বকাপে দুর্দান্ত স্টাইলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বকাপ জিতল জার্মানি, তাতে তো তাদের সমর্থকই সবচেয়ে বেশি থাকার কথা।

বাংলাদেশে জার্মানির রোবটিক ফুটবলের কিছু সমর্থক আছে বটে, তবে সেটা তাদের অর্জনের সমান্তরাল নয়। ইতালির খেলোয়াড়রা হ্যান্ডসাম, এ কারণে তাদের কিছু সমর্থক আছে বটে, তবে তাও তাদের সাফল্যের কারণে নয়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ হয় ব্রাজিল, নয় আর্জেন্টিনা। নিজেদের পক্ষের যুক্তি হিসেবে ব্রাজিল ৫ শিরোপার কথা বললে আর্জেন্টিনা ৭ গোলের কথা বলে। আর্জেন্টিনার ৩২ বছর শিরোপা খরার কথা বললে তারা বিশ্বকাপ ফেলে কোপায় চলে যান।

কিন্তু আমি জানি, এসব আসলে ঝগড়ায় জেতার, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার যুক্তি। বাংলাদেশের মানুষ পরিসংখ্যান নয়, ভালোবাসে ফুটবল। সাফল্য নয়, বাংলাদেশের মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি।

বিশ্বকাপ নিয়ে মানুষের এই আবেগ, উত্তেজনা আমার ভালো লাগে। এক মাসের জন্য আমি নিজেও ভেসে যাব। রাত জেগে বিশ্বকাপ দেখার মজাই আলাদা। ঘরে ঘরে চলছে তার প্রস্তুতি। একটাই খালি অনুরোধ, খেলা যেন খেলার জায়গাতেই থাকে।

সমর্থন যেন ঝগড়ায় বদলে না যায়। আমরা যেমন শৈল্পিক ফুটবলের অনুরাগী, আমাদের তর্কেও যেন থাকে শিল্পের ছোঁয়া। মেসি কোনো প্লেয়ারই না, নেইমার একটা ফালতু;

প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে এ ধরনের কথা বলে যেন ফুটবল রস থেকে বঞ্চিত না হই। এবার সিট বেল্ট বেঁধে তৈরি হোন বিশ্বকাপ নামের রোলার কোস্টারের জন্য।

আচ্ছা আপনি ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা?

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ

শেয়ার করুন: