বড় ছেলে আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলুর কারণে গুলশানের সরকারি বাড়ি ছেড়েছেন জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। বাবলুর ওপর রাগ করে তিনি গত ১৮ মার্চ ওই বাড়ি ছেড়ে গিয়ে উঠেছেন ধানমণ্ডিতে ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবুর ফ্ল্যাটে। ওই দিনই অন্য তিন ছেলে-মেয়েসহ গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নালিশও করেছেন তিনি বড় ছেলের বিরুদ্ধে। এর তিন দিন পর তিনি বড় ছেলেকে নিজের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
জানা গেছে, সংসদ উপনেতা বাড়িটি ছাড়ার পরপরই তা বুঝে নিতে চিঠি দিয়েছেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে। ওই বাড়ি থেকে সংসদ উপনেতার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ ও অন্যান্য স্টাফ প্রত্যাহার করা হয়েছে। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। তা সত্ত্বেও ওই বাড়িতে বসবাস করছেন আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলু।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে সাজেদা চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলুর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করেছেন তার মধ্যে আছে তদবির বাণিজ্য, রাজনৈতিক সহকর্মী ও নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং তাদের মারধর ও মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা।
এ ছাড়া বনানীতে রাজউক থেকে সাজেদা চৌধুরীর নামে বরাদ্দ পাওয়া পাঁচ কাঠার একটি প্লট বড় ছেলে তাঁর নামে লিখিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। পাঁচ কাঠার ওই প্লটের হস্তান্তর দলিল বাতিলের জন্য গত মাসে ঢাকার এক নম্বর যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আবেদন করেছেন সাজেদা চৌধুরী। পরিবারের একাধিক সদস্য জানান, ২০১৫ সালের নভেম্বরে স্বামী গোলাম আকবর চৌধুরী রাজধানীর একটি হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় থাকাবস্থায় সাজেদা চৌধুরী নিজেও গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। ওই সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কথা বলে আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলু প্লটের হস্তান্তর দলিলে মায়ের সই নিয়েছিলেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলু গত বৃহস্পতিবার বলেন, তাঁর মাকে কায়দা করে ছোট ভাইয়ের বাসায় নিয়ে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। প্লট লিখিয়ে নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার কিছু নেই বলে আম্মা আমাকে প্লটটি স্বেচ্ছায় লিখে দিয়েছেন।’ কোনো রকম তদবির বাণিজ্যে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন বাবলু। কর্মীদের মারধর করার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে শাসন করার জন্য তিনি মাঝেমধ্যে হাত উঠিয়েছেন।
গুলশান এক নম্বর সার্কেলের ৬ নম্বর সড়কের এই বাড়ি সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর নামে বরাদ্দ। সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবু গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘বড় ভাই আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলুর কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে আম্মা গুলশানের সরকারি বাড়ি ছেড়ে ধানমণ্ডিতে আমার ফ্ল্যাটে এসে উঠেছেন।
তাঁর জন্য ধানমণ্ডিতে নতুন বাড়ি খোঁজা হচ্ছে।’ মাকে জোর করে নিজের বাসায় রেখেছেন বলে তাঁর বড় ভাই যে অভিযোগ করেছেন সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিজের মা হলেও তিনি তো সরকারের বড় একটি পদে রয়েছেন। তাঁকে কি আটকে রাখা সম্ভব?’ পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের অন্যতম কাণ্ডারি সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বর্তমানে বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় তাঁর চলাফেরাও সীমিত হয়ে পড়েছে। তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ে।
মেজ ছেলে সাজেদ আকবর ও একমাত্র মেয়ে শামা রহমান জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবু কৃষি বিষয়ে গবেষণার জন্য এ বছর বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পেয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সাজেদা চৌধুরী বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তাঁর স্বামী বিশিষ্ট বীমা ব্যক্তিত্ব প্রয়াত গোলাম আকবর চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে এই পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সাজেদা চৌধুরীর বড় ছেলে আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলু মায়ের সঙ্গে গুলশান এক নম্বর সার্কেলের ৬ নম্বর সড়কে সরকারি বাড়িতে বসবাস করে আসছেন। বাবলুর স্ত্রী-সন্তান থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর সাজেদা চৌধুরী দ্বিতীয় দফায় সংসদ উপনেতা মনোনীত হলে তাঁর এপিএস নিযুক্ত হন আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলু।
অভিযোগ আছে, সংসদ উপনেতার এপিএস নিযুক্ত হওয়ার আগে থেকেই বাবলু নিয়মিত সংসদ ভবনে উপনেতার কার্যালয়ে বসে স্টাফদের আদেশ-নির্দেশ দিয়ে আসতেন। এপিএস হওয়ায় তাঁর খবরদারি আরো বেড়ে যায়। কার্যালয় বা বাসভবনে কেউ দেখা করতে গেলে বাবলু তাদের নানা প্রশ্ন ও দুর্ব্যবহার করতেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তাঁদের একমাত্র বোন সংগীতশিল্পী শামা রহমান মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এক দিন গুলশানে সরকারি বাসভবনে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বাড়িতে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে যান। বাবলু দারোয়ানকে আগেই বলে রেখেছিলেন যেন তাঁর অনুমতি ছাড়া বাড়িতে কেউ ঢুকতে না পারে। শামা রহমান নিজের পরিচয় দিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে দারোয়ান তাঁকে বাবলুর কথা বলেন। এরপর ক্ষোভে অভিমানে সেখান থেকে ফিরে বিষয়টি অন্য ভাইদের জানান শামা।
আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলু ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি হরহামেশাই দলের নেতাকর্মীদের চড়-থাপ্পড় দেন। তাঁর মতের সঙ্গে অমিল দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায়। কথার আগে চলতে শুরু করে হাত। এ ক্ষেত্রে রেহাই পান না দলের নেতারাও। সালথা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনকে এক দিন জনসভায় প্রকাশ্যে মারধর করেন তিনি। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ওই নেতাকে ৯ মাস জেলও খাটানো হয়। এ ধরনের আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে আয়মন আকবর চৌধুরী বাবলুর বিরুদ্ধে।